(বাঁ দিক থেকে) পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত সেন, স্বরূপ বিশ্বাস। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিন মাস কর্মবিরতি। তার পরেও নিজের চেষ্টায় জোগাড় করা কাজ কেড়ে নিচ্ছে হেয়ার ড্রেসার গিল্ড, ফেডারেশন। মাথায় দেনার দায়। এক শিফ্টে কাজ করে সংসার চালাতে পারছেন না, এই অভিযোগে গত শনিবার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহননের চেষ্টা করেন কেশসজ্জা শিল্পী। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও এক বার ডিরেক্টর্স গিল্ড-ফেডারেশন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। সপ্তাহের তৃতীয় দিন, বুধবার ফেডারেশন এবং ছোট পর্দার প্রযোজকদের সংগঠন নিজেদের বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়েছে। ফেডারেশনের দাবি, “আমাদের অন্তর্ভুক্ত ২৬টি গিল্ড এত দিন একসঙ্গে সঙঘবদ্ধ ভাবে কাজ করেছেন কিন্তু তার মধ্যে একটি গিল্ড সব সময় চেষ্টা করছে একপেশে ভাবে তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার।” ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অফ টেলিভিশন প্রোডিউসারস (ডব্লিউএটিপি)-এর দাবি, ফেডারেশনের একুশে আইনের চাপে কোণঠাসা ছোট পর্দার প্রযোজকেরা। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম মানতে মানতে নাভিশ্বাস প্রত্যেকের। এই জায়গা থেকে টেলিপাড়ার অন্দরে নাকি বেশ কয়েক মাস ধরে শোনা যাচ্ছে, ফেডারেশন-গিল্ডের এই বিবাদের কারণেই পরিচালক সংগঠন বেরিয়ে আসতে চাইছে। একই মনোভাব সম্ভবত ছোট পর্দার প্রযোজক সংগঠনেরও। যাদের অস্তিত্বই শিকার করে না ফেডারেশন।
কেশসজ্জা শিল্পীকে সামনে রেখেই কি আলাদা সংগঠন তৈরির পথে হাঁটতে চলেছেন প্রযোজক-পরিচালকেরা?
এই প্রশ্ন নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল পরিচালকদের সংগঠনের সভাপতি সুব্রত সেনের সঙ্গে। ফেডারেশনের বিরুদ্ধে পরিচালকদের যে একাধিক ক্ষোভ, বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেননি। পাশাপাশি এ-ও জানিয়েছেন, কিছু নিয়মকানুন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ-সহ একাধিক বিষয়ে এই ক্ষোভ। তার মানে এই নয়, তাঁরা ফেডারেশনের থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তাঁর কথায়, “দুই সংগঠনের মধ্যে মতবিরোধ থাকতেই পারে। সেটা থাকাই কাম্য। তার মানে এই নয় কোনও সংগঠনকে ভেঙে বা সরিয়ে নতুন কোনও সংগঠন তৈরি হবে। আমরা চাই, সব পক্ষ একসঙ্গে বসে বৈঠক করে সমাধান বার করুন। সেটাই মঙ্গল। কারণ, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। সমস্যার কথা তুলে আমরা ফেডারেশনের নজর আকর্ষণ করতে চাইছি। তার থেকে বেরিয়ে আসার কোনও ভাবনা কোনও পরিচালকের নেই।” তাঁর আক্ষেপ, “যদিও এটা সম্পূর্ণ ডিরেক্টর্স গিল্ডের ভাবনা। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস তো আমাদের সংগঠনের সদস্য বলেই স্বীকার করেন না। তাই তিনি সংবাদমাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়েছেন, পরিচালকেরা ফেডারেশনের সদস্য কি না তাঁর অন্তত জানা নেই!”
সুব্রতের আরও বক্তব্য, “একই ভাবে ফেডারেশন প্রত্যেকের উপরে বেশ কিছু নিয়ম নিজেরা তৈরি করে চাপিয়ে দেয়। সেটা ঠিক নয়। কারণ, গিল্ডের সদস্যরা ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত। অন্তর্ভুক্ত বা অধীনস্থ নয়। ফলে, কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার ফেডারেশনের নেই। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে বলেই কেশসজ্জা শিল্পী আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। একই ভাবে ফেডারেশনের সদস্য না হলে তাঁদের কাজ করতে দেওয়া হবে না, ফেডারেশনের চাপানো এই নিয়মও সঠিক নয়।” এই বক্তব্য কমবেশি প্রায় প্রত্যেক গিল্ডের এবং সদস্যদের। বিষয়টি নিয়ে ফেডারেশনের সঙ্গে কেন আলোচনায় বসা হচ্ছে না? এই প্রশ্নের জবাবে গিল্ড সভাপতির দাবি, “ফেডারেশনের অন্তর্গত দুটো বডির বৈঠক হয়। এক্সিকিউটিভ বডি মিটিং, ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং। কিন্তু গত দু’মাস ধরে এই বৈঠকগুলোতে আমাদের ডাকা হচ্ছে না। ফলে, আমরা কোনও কথা বলতেই পারছি না। আমরা সব সময় আলোচনার পক্ষে।” সুব্রতের মতে, রাহুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে ফেডারেশনের সঙ্গে গিল্ডের টানাপড়েনের পর থেকেই পরিচালক গিল্ডকে আর কোনও বৈঠকে ডাকছে না ফেডারেশন।
সুব্রতের এই বক্তব্য প্রযোজক-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়েরও। তিনি গিল্ডের ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য। তিনিও গিল্ডের সভাপতির ভাবনা সমর্থন করেন? এই প্রশ্ন আনন্দবাজার অনলাইন সম্প্রতি জানতে চেয়েছিল তাঁর কাছে। তিনিও সেই সময় জানিয়েছিলেন, মতবিরোধ মানেই ফেডারেশনের থেকে বেরিয়ে আসা নয়। বরং একসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জমে থাকা ক্ষোভ মুছে দেওয়া। এই বক্তব্য কি ছোট পর্দার প্রযোজকদেরও? না কি নিত্য দিনের সংঘাত এড়াতে তাঁরা নতুন সংগঠন গড়তে চান? বিষয়টি নিয়ে নিজের মত জানিয়েছেন গিল্ডের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, “সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে আর একটা সংগঠন তৈরি করা সমস্যার সমাধান নয়। সমস্যার সমাধান পেতে চাইলে ফেডারেশনের পুরনো নিয়মের বদল ঘটাতে হবে।” পাশাপাশি, স্বরূপের প্রতি তাঁর বার্তা, কোনও সংগঠন ব্যক্তিনির্ভর নয়। এখানে তাই ব্যক্তিস্বার্থ দেখা উচিত নয়। বরং সকলে মিলে সমাধান খুঁজলে আখেরে বাংলা বিনোদন উপকৃত হবে।
জানতে আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলেছিল বড় এবং ছোট পর্দার অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশনের কর্ণধার ফিরদৌসুল হাসানের সঙ্গে। তিনিও সুব্রতের কথাতেই মান্যতা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “একসঙ্গে পথ চলতে গেলে সংঘাত বাধবে। বিরোধ তৈরি হবে। তার মানে এই নয় যে যার বা যাদের সঙ্গে সংঘাত তাদের আমরা ত্যাগ করব। আমার মতে, সময় দিয়ে সকলে মিলে আলোচনা করলে সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব। যার যা ক্ষোভ সেটাও দূর করা যায়।” একই সঙ্গে প্রযোজকদের স্বার্থরক্ষার দিকটিও পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন। পাশাপাশি এ-ও জানিয়েছেন, এই ভাবনা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। তাঁর আশা, বাকিরাও হয়তো তাঁর ভাবনাকেই সমর্থন করবেন। তা হলেই হয়তো কেশসজ্জা শিল্পীর মতো আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা আটকানো সম্ভব হবে। ছোট পর্দার প্রযোজক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন অর্গ্যান ইংকের প্রযোজক অর্ক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও ছোট পর্দার একাধিক জনপ্রিয় ধারাবাহিক প্রযোজনা করেছেন। তাঁর মত, “আমাদের এই সংগঠন আদতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমরা ফেডারেশনের অংশ নই। প্রত্যেকে ব্যবসায়ী সংস্থা। আমরা নিজেদের সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে এক ছাতার নীচে রয়েছি। ফলে, আমাদের ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসার কোনও প্রশ্নই নেই।”
এই প্রসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল ইম্পার সভাপতি পিয়া সেনগুপ্ত, ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস, প্রযোজক স্নেহাশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে। যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় পরিচালক সংগঠনের কার্যকারী সমিতির সদস্য পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর সঙ্গেও। এঁরা প্রত্যেকে ফোনে অধরা।
বদলে কথা বলেছেন যাঁদের বিরুদ্ধে কেশসজ্জা শিল্পীর অভিযোগ সেই হেয়ার ড্রেসার গিল্ডের সভাপতি রিনা মণ্ডল। তাঁর দাবি, “ফেডারেশন সভাপতি যখন বৈঠক ডাকেন তখন সকলের আগে তাঁদের বক্তব্য জানতে চান। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের গিল্ড বসে সকলের শেষে। আমাদের সঙ্গে কথাও বলেন শেষে। সে ক্ষেত্রে পরিচালকদের যদি কোনও মত বা নিয়ম নিয়ে আপত্তি থাকে তখনই তাঁরা জানাননি কেন?” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “এর আগে যখন ১৩ জন পরিচালকের বিরুদ্ধে গোপনে শুটিংয়ের অভিযোগ ওঠে তখন কিন্তু পরিচালক সংগঠন ফেডারেশনকে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, এই ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য। পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের সময় থেকেই বিষয়টি অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy