দুর্নিবার সাহা-দীপন মিত্র
প্রতিদিন অজস্র মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় আপনাদের গান শুনছেন। সেলিব্রিটিরাও তারিফ করছেন গানের। সবার মুখে মুখে এখন আপনাদের নাম। নার্ভাস লাগছে?
দীপন: আমি আগেও এই ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। এই মঞ্চে আসার আগেও স্কুল যেতাম আর গান গাইতাম। এই মঞ্চ ছেড়ে যাবার পরও তাই করব। যখন গান করি, কার সামনে গাইছি, কারা শুনছে, এগুলো নিয়ে একদম ভাবি না। গানের মধ্যে ঢুকে যাই।
দুর্নিবারকে নিয়ে ফেসবুকে তিন-তিনটে ফ্যান পেজ। সেখানে কমপক্ষে দশ হাজার লাইক। কেউ কেউ তো শ্যুটে এসে অটোগ্রাফও চাইছে। কেমন লাগছে এই জনপ্রিয়তা?
দুর্নিবার: গান গেয়ে জনপ্রিয়তা এসেছে ঠিকই। জীবনটা বদলে গিয়েছে। আমি আর সেই আইটি সেক্টরে চাকরি করা ইঞ্জিনিয়ার নই। আগে বোহেমিয়ান লাইফ লিড করতাম। দিনরাতের ঠিক ছিল না। ইচ্ছে হল তো ক্যামেরা নিয়ে ইভেন্টের ছবি তুলে বেড়াতাম। ‘সারেগামাপা’য় এসে নিয়ম নামক শব্দটা আমার জীবনে এল। আগে চব্বিশ ঘণ্টা গান শুনতাম। এখন শুধু ঘুম আর গান। অভিজ্ঞতাটা এনজয় করছি।
কিন্তু এই অভিজ্ঞতা নিয়েই তো বহু শিল্পী প্রতিযোগিতার মঞ্চ থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। শ্রেয়া ঘোষালের পর আর কোনও নাম করতে পারবেন?
দীপন: দেখুন, শ্রেয়া ঘোষালের প্রতিভা আর ভাগ্য দুটোই ক্লিক করেছে। ধৈর্য ধরে সাধনাটা চালিয়ে যেতে হবে। নামের পেছনে ছুটলে হবে না। আমি যেমন আমার গুরুজি রাশিদ খানের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আমি জানি উনিই আমায় ঠিক রাস্তা দেখাবেন। হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাতেই আমি বিশ্বাস করি না। স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ কি পড়াশোনা ভুলে যায়, না হারিয়ে যায়? এই মঞ্চটা আমাদের কাছে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা নয়। বরং একটা কালচারাল ট্রেনিং সেন্টার। শুধু গান তুললাম আর গাইলাম— এই রকম হচ্ছে না এখানে। এখানে গ্রুমিং থেকে যেটা পাচ্ছি সেটাই পরবর্তী জীবনে গান নিয়ে বাঁচতে সাহায্য করবে।
দুর্নিবার: আমার তো আগে থেকে কোনও মিউজিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। সেই আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাল চাকরি ছেড়ে পেশা হিসেবে গানটাকে নেব ভাবছি। এই বিশ্বাসটা আমায় ‘সারেগামাপা’ দিয়েছে। রাস্তাটা নিজেদের খুঁজে বের করতে হবে। কী ভাবে এগোব, সেটাই এখন ভাবার।
রাস্তা কিন্তু হারিয়ে যায়। এত প্রচারের আলো —দিক ভুল হয় বারবার। বিশেষত যখন গানের বাজারে মন্দা।
দুর্নিবার: গানের বাজারে মন্দা আসতে পারে। সিডি কম বিক্রি হতে পারে। কিন্তু ভাল গান শোনার লোকের অভাব নেই। নয়তো ‘সারেগামাপা’র সমস্ত প্রতিযোগী এত জনপ্রিয় হত না। ভাল গান শোনানোর মাধ্যমটা বদলে গিয়েছে। এখন তো আইটিউনসে গান বাজছে। ভাল গান কী ভাবে শোনানো যায় সেই রাস্তাটাই খুঁজে বের করতে হবে। অন্য রকম করে ভাবতে হবে। আর চ্যানেলের এই ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকলেই আমার মনে হয় রাস্তাটা ক্রমশ বেরোবে। ভাবুন তো কী ধরনের সঙ্গ আমরা পাচ্ছি এখানে!
‘সারেগামাপা’য় আসার পর কি প্রেমসঙ্গটা বদলে গিয়েছে?
দুর্নিবার: একেবারেই না। আমার গার্লফ্রেন্ড বদল হয়নি।
গার্লফ্রেন্ড বদল না হোক। যোগ তো হয়েছে?
দুর্নিবার: এখানে আসার পর প্রতিযোগিতা, তাকে ঘিরে নানা প্রস্তুতির জন্য বাইরের সঙ্গে আমাদের সে রকম যোগাযোগ নেই। সোশ্যাল মিডিয়াই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। সেখানে দেখছি অনেক মেয়েই আমার জন্য পাগল। আসলে কী জানেন, আমি যেমন আধুনিক গান গাই, তেমনি পুরনো রোম্যান্টিক বাংলা গানও গাই। এই কারণেই বোধহয় ১৮ থেকে ৫০ সব বয়সের মহিলাই আমার ভক্ত।
স্টেডি গার্লফ্রেন্ড। অথচ এত বিচিত্র মহিলা ফ্যান সামলাচ্ছেন কী করে?
দুর্নিবার: (চোখে দুষ্টু হাসি) বলব একটা কথা? দেখুন, পঁয়তাল্লিশের মহিলা হলে বড়দি বলি। আঠারো হলে বোন, আর সাতাশ হলে বন্ধু। (বলে একগাল হাসি)। এটা কিন্তু মজা করে বললাম!
দীপন এত চুপ কেন?
দীপন: কী বলব? গার্লফ্রেন্ড বা প্রেম কোনওটাই নেই আমার। আর ফেসবুক করতেও ভালবাসি না। আসলে আমার মনে হয় আমি যে ধরনের গান গাই সেটার সব দর্শকই যে ফেসবুক করে এমন নয়। তবে হোয়াটসঅ্যাপ করি। কিন্তু হ্যাঁ এই রকম কয়েকবার হয়েছে, ফেসবুকে আলাপ করে কয়েকজন মেয়ে সমানে বিরক্ত করে গিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের নম্বরের জন্য। আমি দিইনি। তবে ফ্যানের কথা যদি বলতেই হয়, আমার এক জন ফ্যান আছেন যিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। আমাকে একটা নামী কোম্পানির কম্পিউটার সেট উপহার দিয়েছেন। আর স্কাইপে ওঁকে আমি গান শেখাই। (দুষ্টু হেসে) আসলে আমার দুর্নিবারদার মতো মহিলা ফ্যান বা ক্রেজ নেই।
দুর্নিবার: আরে! গোটা একটা কম্পিউটার পেয়ে গেলি! তাও বলছিস ক্রেজ নেই?
কী ধরনের ক্রেজ?
দুর্নিবার: আগে দীপন বলুক।
দীপন: না, দুর্নিবারদাই বলুক আগে। ও গুছিয়ে বলতে পারে।
দুর্নিবার: আগে বল আমাকে থেকে থেকে দুর্নিবারদা বলছিস কেন? আমাদের দু’জনের আসল নামটা বল...
দীপন: ওটা তো এখানকার নাম। বলে ফেলব? আমি আসলে মান্না দে-র গানের অন্ধ ভক্ত। তাই আমার নাম ‘মাদীপন্না’ আর দুর্নিবারদা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভক্ত তাই ওকে আমরা ‘হেবার’ বলে ডাকি। ‘হেবার’ আসলে আমাদের সকলের দাদা। কোনও কিছুতেই ওর রেসট্রিকশন নেই।
দুর্নিবার: (বড় বড় চোখ করে) দীপনের যেমন অনেক রেসট্রিকশন। গানের জন্য ফুচকার তেঁতুল জলটা বাদ দিতে হয়েছে ওকে। দই খাওয়া একেবারে বন্ধ। ও এই টিমের গুড বয়। আর আমি, তীর্থ —এরা সব ‘ত্যাঁদর বয়’। আমাদের ট্যাকল করতে হয়।
সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতার কথাটা বলবেন?
দীপন: তন্ময় স্যার (বসু) যেদিন এসেছিলেন সেই দিনটার কথা কোনও দিন ভুলব না। আমার মতো ছেলে বারোটা তবলার সঙ্গে যে অনায়াসে গান গাইতে পারবে, কোনও দিন ভাবিনি। এই প্রতিযোগিতায় হার জিত যাই হোক, এই অভিজ্ঞতাগুলোই পাওয়ার। শান্তনু স্যার (মৈত্র) ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়তন’ শুনে বলেছিলেন, ‘‘তোমার এই গানটা যদি ফাইনাল এপিসোডের গান হত, তা হলে তুমিই সেরা প্রতিযোগী নির্বাচিত হতে।’’ যিশুদাকে রোজ এত কাছ থেকে দেখতে পাই... খুব এক্সাইটেড লাগে। কোয়েলদি যেদিন এসেছিল, দারুণ লেগেছিল।
দুর্নিবার: আমার জিৎদাকেও দারুণ লাগে। আমার মিউজিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স ছিল জিরো। ‘সারেগামাপা’য় সেটা পাঁচশো থেকে হাজার হয়েছে। প্রথম দিককার গ্রুমিং ক্লাসগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। প্রভাতী (মুখোপাধ্যায়) ম্যাম, রাঘব (চট্টোপাধ্যায়) স্যার, তন্ময় স্যার যে টিপসগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো আজও গাইতে গিয়ে কাজে লাগে। গান গাওয়ার সময় প্রখ্যাত মিউজিশিয়ানের সাপোর্ট পেয়েছি, কোনও দিন ভেবেছিলাম রোশন আলির সারেঙ্গির সঙ্গে গান গাইতে পারব! কার্তিক দাস বাউল, রামচন্দ্রনের মতো বিখ্যাত গিটারিস্ট আমার গানের সঙ্গে সঙ্গত করবেন! আজও গায়ে কাঁটা দেয়। আর বিচারকরাও কত সুন্দর মন্তব্য করেন।
অনেকেই বলছেন দীপন ‘জাজেস চয়েজ’।
দুর্নিবার: (প্রচণ্ড হেসে) তা হলেই বুঝুন। এমনিতেই তো লোকসঙ্গীতের প্রতিযোগীরা প্রত্যেক বারই পারফরম্যান্স অব দ্য উইক সম্মান নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর আমরা বাটি হাতে বসে আছি। এখানে লোকসঙ্গীতের কেউ নেই বলে কথাটা বললাম।
দীপন: হ্যাঁ, ওরা ভাল গায়। লোকসঙ্গীত সব পুরস্কার নিয়ে নিলে খারাপ তো একটু লাগবেই।
সে কি! তীর্থ আর আপনি তো হরিহরআত্মা। তার পরেও এই মন্তব্য?
দুর্নিবার: আরে আমি তীর্থর সামনেও বলি এটা। এখানে রাখঢাকের তো কিছু নেই। ওরা সবাই দুর্দান্ত পারফর্ম করছে। তাই পুরস্কার পাচ্ছে। সোজা হিসেব। তবে একটা কথা বলতে চাই। শোভাজি একবার আমার গান শুনে বলেছিলেন, আমার গানে একটা ‘অসর’ আছে। আমার গানের এই এফেক্টটাই রাস্তা বাছতে সাহায্য করবে বলে মনে হয়।
আচ্ছা, অরিজিৎ সিংহ শোনেন?
দুর্নিবার: হ্যাঁ শুনি। আর এখনকার বাংলা গানের চেয়ে আশা-লতা-আরতি-হেমন্ত-মান্না, এই সময়ের গান শুনতে বেশি ভাল লাগে।
দীপন: অরিজিৎ সিংহ খুব ভাল লাগে।
দুর্নিবার, অভিষেক এলিমিনেট হওয়ার পর আপনি খুব কেঁদেছিলেন...
দুর্নিবার: খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা রুমমেট ছিলাম। এমন কোনও দিন যায়নি গ্রুমিং সেরে, রেকর্ডিং করে, শ্যুট করে যত রাতই হোক ঘরের দরজা বন্ধ করে দু’জনে অন্তত ঘণ্টাখানেক গল্প করেছি। হয়তো তখন ও পাশ ফিরে আছে। আমি এ পাশ ফিরে আছি। গানের ক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি ওর কাছ থেকে।
দীপন: অভিষেকদাকে খুব মিস করব। গানের সময় অনেক হেল্প করেছে আমায়।
অদ্রিজার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে আপনারা দু’জনেই নাকি খুব পছন্দ করেন? ব্যাপারটা কী?
দুর্নিবার: ব্যাপার কিন্তু যে রকম ভাবছেন সে রকম নয়। আমি তো বৃষ্টির সঙ্গেও ডুয়েট গেয়েছি। আগে তো কখনও ডুয়েট গাইনি। গাইবার সময় ওর থেকে অনেক কিছু শিখেওছি।
দীপন: অদ্রিজাদির মতো মানুষ হয় না। ব্যাপার এইটাই।
(প্রশ্ন করার আগেই গিটার হাতে ইমনে রেওয়াজ করতে বসে গেলেন দু’জনে। গানের ফাঁকেই চলল কথা।)
দুর্নিবার: দীপনের আসলে ওপেন হতে সময় লাগে। ওকে একটু কথা বলার ক্লাস নিতে হবে দেখছি। সারাক্ষণ দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। এত ছোট যে বলতেও পারি না প্রেম কর। কিন্তু গানটা ফাটিয়ে গায়।
দীপন: মোটেই দুঃখমুখে ঘুরি না। হেবার যে অসাধারণ ছবি আঁকে, সেটাও তো এখানে চেপে গিয়েছিল। ওর রুমে চক দিয়ে দেওয়ালে যা এঁকেছে তা দেখার মতো। তবে ও বড্ড বেশি রোনাল্ডোর ভক্ত।
দুর্নিবার: এটা একদম ভুল। আমিও কিন্তু সচিন-সৌরভের ডাইহার্ড ফ্যান। তবে ক্রিকেট, ফুটবল কোনওটাই খেলার সুযোগ পাই না এখানে। কেবল গান-গান খেলা...
(থামানো যাচ্ছিল না দীপন আর দুর্নিবারকে। মনে হচ্ছিল যেন প্রতিযোগী নয়, দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে চলেছে।)
লোকেশন সৌজন্য: পার্পল মুভি টাউন
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy