‘হীরালাল’ ছবির দৃশ্য
হীরালাল সেন একজন বিস্মৃতপ্রায় কৃতী বাঙালি। সম্প্রতি তাঁর জীবন অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নাম ‘হীরালাল’। এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জনক কে? দাদাসাহেব ফালকে, না হীরালাল সেন? হীরালাল সেন ছিলেন তখন দেশের এক নম্বর স্টিল ফোটোগ্রাফার। ফোটোগ্রাফি থেকে বায়োস্কোপের নেশায় মেতে ওঠেন। পরবর্তীকালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও স্বপ্নের জোরে তৈরি করেছিলেন ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। থিয়েটার ব্যক্তিত্ব অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সংস্পর্শে এসে তিনি ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ পূর্ণাঙ্গ নাটকটি ক্যামেরাবন্দি করেন। ১৯০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি তা দেখানো হয়। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার ক্ষেত্রেও হীরালাল সেন পথিকৃৎ। পারিবারিক কারণে তাঁর সমস্ত সৃষ্টি অন্যের দখলে চলে গিয়েছিল। ১৯১৭ সালে তিনি মারা যান আর সে বছরই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় তাঁর তোলা সমস্ত ছবির স্টক। দাদাসাহেব ফালকে-র প্রথম ছবি ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ মুক্তি পায় ১৯১৩ সালের ৩ মে। তার প্রায় ১০ বছর আগেই দেখা গিয়েছে হীরালালের ‘আলিবাবা’। চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণন পরিষ্কার বলেছেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃতের স্বীকৃতি যদি কাউকে দিতে হয়, তো তিনি হীরালাল সেন।
যাঁর ছবি ‘হীরালাল’ সূত্রে এত কথা উঠে আসছে আবার, সেই পরিচালক অরুণ রায়ের সঙ্গে কথা হল।
প্রশ্ন---হীরালাল সেনকে নিয়ে ছবি কেন?
অরুণ রায়---বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের একটা লজ্জা হওয়া উচিত যে, আমরা প্রত্যেকে মেনে নিয়েছি দাদাসাহেব ফালকে ভারতীয় সিনেমার জনক। দাদাসাহেব ফালকে-র অবশ্যই অবদান আছে। কিন্তু তিনি ভারতীয় সিনেমার জনক নন। জনক হীরালাল সেন। ১৯০৪ সালে তাঁর ‘আলিবাবা’ প্রদর্শিত হয়। দাদাসাহেব ফালকে-র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ১৯১৩ সালের। হীরালাল সেনের কথা আমরা দিব্যি ভুলে আছি। আমার ছবিতে সেই বিস্মৃত অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন--- অনেকে মনে করেন যে, হীরালাল সেন থিয়েটারকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। একটা নাটককে ক্যামেরায় তুলে নিয়েছিলেন তিনি, এটা চলচ্চিত্র নয়। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?
অরুণ রায়--- তা হলে চলচ্চিত্র কাকে বলে? দেখুন দাদাসাহেব ফালকে যেটা বানিয়েছিলেন... 'রাজা হরিশচন্দ্র'... সেখানে মেয়েদের ভূমিকায় সব ছেলেরা অভিনয় করেছিলেন। তা হলে তাকে কেন আমি চলচ্চিত্র বলব? হীরালাল সেন যেটা তুলেছিলেন সেখানে কিন্তু মেয়েদের ভূমিকায় মেয়েরাই অভিনয় করেছিলেন। তখনকার দিনের একজন স্টার কুসুমকুমারী দেবী অভিনয় করেছিলেন। আমার ছবিতে কোনও গল্প নেই, সবটাই সত্য। গবেষণা করেই কাজটা হয়েছে।
প্রশ্ন---গবেষণার কাজে আপনাকে কেউ সাহায্য করেছিলেন?
অরুণ রায়--- হ্যাঁ। রুদ্ররূপ মুখোপাধ্যায়।
প্রশ্ন---নাটকের অনেক অভিনেতাকে এই ছবিতে নিয়েছেন। সেটা কি বিশেষ কোনও কারণে?
অরুণ রায়--- বিশেষ বলতে... দেখুন আমার এই ছবিতে অনেক নতুন মুখ দরকার হয়েছিল। হীরালাল সেনের যে কয়েকটা ছবি আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি, তাতে তাঁর চেহারার সঙ্গে মিল আছে এমন একজনকে দরকার হয়েছে। তবে শুধু মুখের মিল নয়, অভিনয় দক্ষতাও বড় ব্যাপার। হীরালাল সেনের ভূমিকায় এই ছবিতে অভিনয় করেছেন নতুন মুখ কিঞ্জল নন্দ। আমি বলব, অত্যন্ত শক্তিশালী এই তরুণ অভিনেতা।
প্রশ্ন---কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে হীরালাল সেনের সম্পর্কের বিষয়টি এ ছবিতে কেমন ভাবে আছে?
অরুণ রায়--- টাচ দেওয়া আছে। যেটুকু যেটুকু জানা গেছে, তার সবটাই আমার ছবিতে দেওয়া আছে। মনগড়া কোনও কিছু নেই। তথ্যের ভিত্তিতে সবকিছু করা।
প্রশ্ন--- হীরালাল যে সময়টায় কাজ করেছিলেন, থিয়েটারের জগতের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন তিনি, তাঁকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে নিশ্চয়ই সেই সময়টাকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে... সেই সব ঐতিহাসিক চরিত্র…
অরুণ রায়---ছবিটাই তো সেই সময়ের। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, কুসুমকুমারী সবাই আছেন। ছবিটা দেখলেই দর্শক হীরালাল সেনের বিচিত্র জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অদ্ভুত প্রাণশক্তিতে ভরা সময়টাকে অনুভব করতে পারবেন।
প্রশ্ন--- আপনার প্রথম ছবি ‘এগারো’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সাহেব টিমের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের গৌরবময় জয়ের গল্প। সেখানেও অনেক নতুন ছেলেমেয়ে অভিনয় করেন।
অরুণ রায়--- হ্যাঁ, সেটা হয়েছিল। প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি নতুন বিষয় নিয়ে ছবি করার।
প্রশ্ন---পরবর্তী ছবি ‘চোলাই’।
অরুণ রায়--- দেখুন এই ছবির বিষয়বস্তু শাসকদলের পছন্দ না হওয়ায় অফিশিয়ালি এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল...সিনেমা হল থেকে... ছবিটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন---নায়ক নায়িকা, প্রেম-প্রতিবাদ কেন্দ্রিক যে ছবিগুলো মানুষ সহজে পছন্দ করে, সেই ধরনের ছবি বানানোয় আকর্ষণ বোধ করেন না?
অরুণ রায়--- ভিড় বাড়িয়ে লাভ কী? আসলে আমার ছবির সাবজেক্ট এমন হয় যে নায়ক-নায়িকা সেই অর্থে...। তা ছাড়া পরিচিত মুখ এলে ছবিটা দেখতে ভাল হবে না মনে হয়... এ আমার ব্যক্তিগত মত।
প্রশ্ন--- হিন্দি ছবিতেও এখন বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে। সেখানে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে কোনও বদল এসেছে বলে আপনার মনে হয়?
অরুণ রায়--- সেই তো বছরে একটা ডিটেকটিভ, একটা রোমাঞ্চকর, কুড়িটা প্রেম-- আমি এগুলো বানাব না।
প্রশ্ন---শেষে বলুন যে হীরালাল সেনের মূল অবদানটা কী, যা আপনি এই ছবির মাধ্যমে সবাইকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে, জানাতে চেয়েছেন।
অরুণ রায়--- অবদানটা হচ্ছে, এক কথায়, এই যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি... এই সিনেমাটা ভারতবর্ষে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। ইতিহাস ভুলে থাকা ঠিক নয়। সত্যের অমর্যাদা করা উচিত নয়। প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র তিনি বানিয়েছিলেন... জবাকুসুম তেল...কোম্পানিটা টিমটিম করে হলেও এখনও আছে।
প্রশ্ন---বাঙালি তাঁকে ভুলে গেল কেন? আপনার কী মনে হয়?
অরুণ রায়---- ভোলা কি উচিত হয়েছে? এই প্রশ্ন থেকেই ছবিটা বানিয়েছি। এটুকুই আমার ক্ষমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy