Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
racism

ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে শুনতে হয়েছিল, ‘কালো তো, হিরোইন মেটিরিয়াল নয়!’

শ্রুতির প্রতি প্রেমিকের বিশেষ উপদেশ ছিল, ‘রোজ গায়ে কাঁচা হলুদ মাখ। ফর্সা হয়ে যাবি।’

শ্রুতি দাস

শ্রুতি দাস ইনস্টাগ্রাম

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২১ ২২:৪৩
Share: Save:

জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার মতো ঘটনা ঘটে গেল এ দুনিয়ায়। গোটা পৃথিবীর মানুষ নেমে পড়ল রাস্তায়। প্রতিবাদের জেরে একাধিক প্রসাধনী দ্রব্যের সংস্থা তাদের নামও বদলে ফেলল। কিন্তু এ সব কি কেবল বাহ্যিক? মানুষের মনের ভিতরের কালো, থুড়ি অন্ধকার দিকটা কি চিরকালই গায়ের ত্বকের ‘কালো’ রং নিয়ে নাক সিঁটকিয়ে যাবে? আর তারই শিকার হয়ে চলবে ফর্সা ব্যতীত অন্য গায়ের রঙের মানুষ?

বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন বহু ইন্ডাস্ট্রির বহু তারকা। তাঁদেরই মধ্যে এক জন ‘ত্রিনয়নী’, ‘দেশের মাটি’ খ্যাত শ্রুতি দাস। মুখ না খুলে পারলেন না এ বারে। সম্প্রতি ‘দেশের মাটি’ মেগার একটি প্রোমো ভিডিয়োর কমেন্ট বক্সে ভয়াবহ ও কুৎসিত মন্তব্য চোখে পড়েছে। ‘বাকি নায়িকারা কি মরে গিয়েছিল নাকি? জঘন্য নায়িকা’, ‘হাতে গুনে ৪ জন হয়তো দেখে এই সিরিয়াল। কারণ, স্বরূপনগরে এখন কালীর কেরামতি চলছে’, ‘দয়া করে এই মেয়েকে বদলে দিন। এর জন্যেই আমার মতো হাজার হাজার মানুষ এই সিরিয়াল দেখে না’, ‘এই মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় ওর প্রচুর অহংকার, দেখতে তো ওই রকম…’, ‘কেলি নায়িকা’, ‘এই নায়িকাকে দেখলে মনে হয় কোনও কাজের মহিলা’ বর্ণবিদ্বেষ, শ্রেণীবিদ্বেষ, সমস্ত মানসিকতার উদাহরণ এখানে পাওয়া যাবে।

এ সব তো দর্শকের মনোভাব। এ ছাড়া পরিবার, স্কুল, প্রেম, ইন্ডাস্ট্রি— সব ক্ষেত্রেই শ্রুতিকে তাঁর গায়ের রং নিয়ে শুনতে হয়েছে।

আনন্দবাজার ডিজিটালকে শ্রুতি জানালেন, কাটোয়ায় বড় হয়েছেন তিনি। স্কুলও সেখানেই। স্কুলের অভিজ্ঞতা নিয়ে জানতে চাওয়ায় কয়েকটা ছোট ছোট উদাহরণ দিলেন অভিনেত্রী। ‘‘গায়ের রং কালো হলে ছেলেরা মেয়েদের হাত ধরত না। এ ছাড়া এক বার নিজের চোখে দেখেছিলাম, আমারই এক বান্ধবীর ঘটনা। একটা ছোট্ট বাচ্চা কিছুতেই তাঁর কোলে বসতে চাইছে না। বান্ধবীর মা বাচ্চাটির কাছে কারণ জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, বান্ধবীর গায়ের রং কালো বলে সে কাছে যেতে চাইছে না। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বাচ্চাটির মা তাকে কিছু বোঝালেনও না।’’

আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি জানালেন, সহপাঠীদের কাছে তাঁকে শুনতে হত, ‘এই কালুনি, তোর গায়ে জল ঢালুনি’। ‘‘আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এখন’’ হেসে উত্তর দিলেন অভিনেত্রী। এই প্রবণতা বদলানোর নয়। এ রকমই থেকে যাবে। শ্রুতির উপর এ ধরনের নীচ মানসিকতা আর প্রভাব ফেলে না। কিন্তু সম্প্রতি এই পোস্টের তলায় তাঁর স্বামী, বাবা ও মা-কে নিয়ে কথা তোলায় তিনি নিজেকে সামলাতে পারেননি। আর তাই তাঁর পোস্ট, ‘সব হিসেব তোলা থাক, জয়গুরু’।

প্রেমের ক্ষেত্রে কখনও এ সবের সম্মুখীন হতে হয়নি?

আশ্চর্যের বিষয়, শ্রুতিকে ভালবাসে বলে দাবি করেও তাঁর এক প্রেমিক তাঁকে বদলাতে চাইতেন। শ্রুতির প্রতি প্রেমিকের বিশেষ উপদেশ ছিল, ‘রোজ গায়ে কাঁচা হলুদ মাখ। ফর্সা হয়ে যাবি।’

এই জন্যেই ব্রেকআপ হয়েছিল তো? হাসতে হাসতে নায়িকার উত্তর, ‘‘নিশ্চয়ই! তাই এরা আমার ‘প্রেমিক’ ছিল। আর এখন মনের মানুষকে পেয়েছি বলেই তাঁকে বিয়ে করেছি। আমি যে রকম, সে রকম ভাবেই আমাকে ভালবাসে স্বর্ণেন্দু।’’

কিন্তু এখন যত সহজ ভাবে এই মন্তব্যগুলোর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেন, ছোটবেলায় তা পারতেন না। মনে হত, কালো হওয়া বোধহয় অপরাধ। মা-কে গিয়ে শ্রুতি বলতেন, ‘‘মা আমাকে কালো কেন বানালে?’’ মাঝে মাঝে ভাবতেন, মুখে এই ক্রিম মাখলে নি‌শ্চয়ই ফর্সা হয়ে উঠবেন। এমন করে এক দিন কাঁচা অ্যালোভেরা মেখে ফেলেছিলেন শ্রুতি। জানতেন না, তাঁর অ্যালার্জি রয়েছে অ্যালোভেরাতে। মায়ের কাছে খুব বকুনি খেতে হয়েছিল সে দিন। পরিবারেও তুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে গায়ের রঙ নিয়ে তুলনা চলত।

আর ইন্ডাস্ট্রি?

নতুন করে অবাক হননি তিনি। ‘ত্রিনয়নী’-র জন্য কথাবার্তা চলছে। তখন শুনতে পেতেন, ‘এ কী করে নায়িকা হবে? হিরোইন মেটিরিয়াল নয় তো!’’ হজম করে গিয়েছিলেন শ্রুতি। পরে তাঁরাই এসে শ্রুতির অভিনয়ের প্রশংসা করে জানিয়েছিলেন, ‘ভুল ভেবেছিলাম গো’। এ সব পাওনাগুলোকে মনে রেখেই চলতে চান অভিনেত্রী।

‘দেশের মাটি’ সিরিয়ালের ‌শ্যুটিং চলছে আউটডোরে। তিনি বসে রয়েছেন একটি চেয়ারে। একটু দূরে বসে রয়েছেন বাকি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। গ্রামের মানুষ জন শ্যুটিং দেখতে এসেছিলেন। গায়ের রং ফর্সা বলে তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে অন্য অভিনেত্রীই এই সিরিয়ালের নায়িকা। তাঁর সঙ্গে ছবি-টবি তোলার পরে স্টিল ফোটোগ্রাফারকে জিজ্ঞেস করার পর তাঁরা জানতে পারেন, নায়িকা আসলে শ্রুতি। মুখ দে‌খে শ্রুতি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্রুতিকে তাঁদের পছন্দ হল না কেবল মুখ দেখে। তাই ছবিও তুলতে এলেন না। অনেকের মতো তাঁদের মনেও হয়তো চলছিল, ‘ঝাঁ চকচকে না হলে নায়িকা আবার কী!’ এমনকি সেটেও তাঁকে বেশ কয়েক বার ভুরু কুঁচকানো বা নাক সিঁটকানোর সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে শ্রুতি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন। ‘দেশের মাটি’-র লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এক ব্যক্তি ‘নোয়া’ চরিত্রটাকে এঁকেছেন। তাঁর চোখে শ্রুতিই ‘নোয়া’। তাই শ্রুতির চোখেও সেই ‘নোয়া’। তাই মন প্রাণ দিয়ে চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে যাবে শ্রুতি। আশপাশ থেকে যাই মন্তব্য আসুক না কেন। এক তুড়িতে উড়িয়ে দেবেন তিনি।

শেষে অভিনেত্রী জানালেন, নিজের শখ ও পেশার জন্য আরও পরিশ্রম করতে চান। আরও ১০ বছর এই ‌ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে প্রতিভা দিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে চান। আর তার পর প্রশ্ন রাখতে চান ইন্ডাস্ট্রির সামনেও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy