Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Muslim Biyer Geet

International Women’s Day 2022: মঞ্চে উঠে গাওয়ার ‘অপরাধ’, পাঁচ বছর জলপান বন্ধ, আজ রাসিনা মুসলিম বিয়ের গীতের দলনেত্রী

ঘর ঝাঁট দিতে দিতে, উঠোন নিকোতে নিকোতে, গায়ে তেল মাখতে মাখতে, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে যে গান তাঁরা বাঁধতেন, যে গান তাঁদের মা, দাদি, নানিরা গুনগুন করতেন, সেই গানকেই মঞ্চে নিয়ে আসা, সে গান জোর গলায় গাওয়া। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই কাজটিকে সহজ মনে হলেও রাসিনার গল্পে জানা যাবে, ’৮০-র দশকে গ্রাম বাংলায় ইসলামধর্মী মেয়েদের জন্য তা ছিল দূরের স্বপ্ন।

আজও মেলায় ঘুরে ঘুরে বিয়ের গীতের অনুষ্ঠান করে চলেছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রাসিনা বেওয়া।

আজও মেলায় ঘুরে ঘুরে বিয়ের গীতের অনুষ্ঠান করে চলেছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রাসিনা বেওয়া। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ

তিস্তা রায় বর্মণ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ১৫:০২
Share: Save:

রাসিনা বেওয়া। গ্রাম: জীবন্তী দুর্গাপুর। পোস্ট অফিস: দুর্গাপুর। থানা: কান্দি। জেলা: মুর্শিদাবাদ। জন্ম সাল মনে নেই। তবে ১৯৬০ সালের বন্যার কথা অল্প অল্প মনে পড়ে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, তার আগেই জন্ম। সেই হিসেবে এগোলে, এখন তিনি ষাটোর্ধ্ব। মুসলিম বিয়ের গীতের দলনেত্রী। এই দল গড়তে এক দীর্ঘ সময় ধরে জলের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। রান্না চাপাতে রেশনের জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। আজ তিনি সেই রাসিনা, যিনি গ্রামের সকল মেয়ের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন।

ঘর ঝাঁট দিতে দিতে, উঠোন নিকোতে নিকোতে, ভাত রাঁধতে রাঁধতে, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে যে গান তাঁরা বাঁধতেন, যে গান তাঁদের মা, দাদি, নানিরা গুনগুন করতেন, সেই গানকেই মঞ্চে নিয়ে আসা, সে গান জোর গলায় গাওয়া। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই কাজটিকে সহজ মনে হলেও রাসিনার গল্পে জানা যাবে, ’৮০-র দশকে গ্রাম বাংলায় ইসলামধর্মী মেয়েদের জন্য তা ছিল দূরের স্বপ্ন।

কিন্তু তাঁরা গান বেঁধেছেন। আর তাই গানের কথার পরতে পরতে সেই প্রতিবাদী সত্তা প্রকাশ পেত।একটি গানের এক ঝলক, ‘রমকে ঝমকে নাচিব/ মশালে মশাল জ্বালিয়ে দে/ বাপের দুয়ারে নাচিব/ মশালে মশাল জ্বালিয়ে দে/ শ্বশুর-ভাসুর না মানিব/ মশালে মশাল জ্বালিয়ে দে।’

স্কুলের এক মাস্টারমশাই টিফিনের সময়ে নাচ, গান শেখাতেন, শুনতেন। আনন্দ মাস্টার। রাসিনাদের গলায় বিয়ের গীত শুনে উৎসাহ দিতেন তিনি। কয়েক বছর পরে সেই আনন্দ মাস্টার জানান, তথ্য সংস্কৃতি দফতর থেকে মুসলিম গানের অনুষ্ঠান করার জন্য প্রস্তাব এসেছে। রাসিনার তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিনি তখন রাসিনা বেগম। বড় ছেলে তাঁর কোলে। প্রস্তাব পেয়েই এক পায়ে খাঁড়া রাসিনা।

কান্দির মাঠেই মঞ্চ পাতা হয়েছে। মেয়েদের দল নিয়ে রাসিনা হাজির মাঠে। কিন্তু সমাজ থেকে আপত্তি— মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েরা মঞ্চের উপর উঠে নাচ, গান করতে পারবে না।

মঞ্চে ওঠা হল না। গান গাওয়া হল না। কিন্তু রাসিনার জেদ চেপে গেল। গান তো তিনি করবেনই! কিন্তু সমাজকে বাদ দিয়ে নয়। সমাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়। যে সমাজ তাঁকে বাধা দিয়েছে, তারই সঙ্গে পা মিলিয়ে, তাকে সামনে রেখেই মুসলিম বিয়ের গীত গাইবেন রাসিনা। মঞ্চে উঠেই। দরকারে কলকাতা পাড়ি দেবেন।

আবার চিঠি এল। মুর্শিদাবাদের শহর পর্যন্ত যেতে হবে। সেখানেই এ বারে মঞ্চ পাতা হয়েছে। মুসলিম বিয়ের গান শুনতে আগ্রহী মানুষ। এত দূর নিয়ে যেতে হবে এত মেয়েকে! কিন্তু সমাজের পুরুষরা যদি পথ আটকায়? সাহস হল না রাসিনার। সেই প্রথম, সেই শেষ বার, সমাজকে ভয় পেলেন রাসিনা। পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে কোঁচায় একটি শাড়ি, সায়া আর একটি ব্লাউজ ভরে বগলে লুকিয়ে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে সাত-আট জন মেয়ে এক জায়গায় জড়ো হন। বাসে উঠে শহর পৌঁছলেন তাঁরা। রাসিনা বলেন, ‘‘প্রোগ্রাম করতে যাই। তবে চুরি করে। কিন্তু যেতে হতই। তবে পালিয়ে যাইনি। মঞ্চে উঠে গান গেয়ে আাবার গ্রামে ফিরি। বাড়ি ঢুকলাম। কিন্তু তার পরেই শুরু হল আসল লড়াই।’’ রাসিনাদের ‘চুরি’ ধরা পড়ে গেল। গ্রামে একজোট হলেন সমাজের পুরুষেরা। বলা হল, ‘‘তোমরা ডুবে ডুবে জল খেয়েছ। নিষেধ অমান্য করেছ। তার শাস্তি পেতে হবে।’’

হাতের কাজ শিখিয়ে হস্তশিল্পে কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন রাসিনা।

হাতের কাজ শিখিয়ে হস্তশিল্পে কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন রাসিনা।

একঘরে করে দেওয়া হল। কয়েকটি পরিবারকে। গ্রামে সরকারি কল পোঁতা হয়েছে সকলের জন্য। কিন্তু রাসিনারা সেই কল থেকে জল খেতে পারবেন না। এমনই নির্দেশ গেল গ্রামের নানা প্রান্তে। দোকানে দোকানে বলে দেওয়া হল, মুসলিম গীত গাওয়ার জন্য যে মহিলারা গ্রাম ছেড়ে মঞ্চে উঠেছিলেন, তাঁদের পরিবারের কেউ দোকান থেকে কোনও রেশন যেন না পায়। দোকানদারেরা রাসিনাদের তাঁদের দোকানের ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। চাল, ডাল, নুন, পেঁয়াজ, আলু কিনতে অন্য গ্রামে যেতে হত হেঁটে হেঁটে। সেই গ্রামের কল থেকে জল আনতে হত টেনে টেনে। এ ভাবেই পাঁচ বছর কাটে। গান গাওয়ার ‘অপরাধ’-এ এমন ভাবেই শাস্তি দেওয়া হল সাত-আট জন মহিলা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের। এই পাঁচ বছরে কি তবে বিয়ের গীত গাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? রাসিনা বললেন, ‘‘না! আমরা গান গেয়েছি। দূরে দূরে প্রোগ্রাম করতে গিয়েছি। একঘরে যখন করেই দিয়েছে, তবে আর লুকোছাপা কেন? সকলের চোখের সামনে দিয়ে গিয়ে মৌলবীর ঘরের মেয়েদের ডেকে নিয়ে গিয়ে‌ছি আমি।’’

এরই মাঝে এক শুক্রবার রাসিনাদের স্বামীরা মসজিদে নমাজ পড়তে গিয়ে গ্রামের পুরুষদের হাতে মার খেলেন। তাঁদের ‘অপরাধ’, বাড়ির মেয়েদের পর্দার বাইরে বেরোনোর ‘অনুমতি’ দিয়েছেন। রাসিনা বলেন, ‘‘স্বামীদের গায়ে হাত তোলার পরে আমরা আর চুপ থাকতে পারিনি। স্বামীরা এসে আমাদের দোষারোপ করেছেন। বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য আমরা মার খেলাম। কিছু তো করতেই হবে।’ আমিই বুদ্ধি দিই, থানাপুলিশ করতে হবে এ বার। আর নয়। আইনের সাহায্য নিতেই হবে।’’

সমাজের লড়াই এ বার আইনের দোরগোড়ায়। রাসিনার বাড়িতে ভিড় জমল। থানা থেকে বড়বাবু এলেন তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে। রাসিনা এগিয়ে গেলেন বড়বাবুর কাছে। জানালেন তাঁদের দুর্দশার কথা। রাসিনার আজও সেই বড়বাবুকে মনে আছে। তিনিও মুসলিম। রাসিনার মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, ‘‘মুসলিম সমাজের মেয়েরা আলোয় আসতে চাইছে। তাঁদের আটকে রাখার অধিকার কারও নেই। রাসিনা, তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও। তথ্যসংস্কৃতি দফতরের হয়ে কাজ করো। এই সমাজ তোমাদের গায়ে আঁচড় দিতে পারবে না।’’

আইনের সম্মতি পাওয়ার পরে মেয়েদের আর ধরে রাখতে পারল না সমাজ। আগল ছেড়ে দিতেই হল। কান্দি থেকে কলকাতা, ঘুরে ঘুরে মুসলিম বিয়ের গীতের সুর ভেসে বেড়াতে থাকল। শহরে শহরে পৌঁছল লোকগীতির ছন্দ।

আজ রাসিনাকে সেই সমাজই বলে, ‘‘গ্রামের সমস্ত মেয়ের দায়িত্ব তোমার। তাঁদের কর্মসংস্থান তোমায় করে দিতে হবে।’’ যে ক’জনকে নিয়ে সম্ভব মুসলিম বিয়ের গীতের দল তৈরি করলেন রাসিনা। বাকিদের হাতের কাজ শিখিয়ে হস্তশিল্পে কর্মসংস্থান করে দিলেন তিনি। লোকশিল্পীর দফতরে পরিচয়পত্র তৈরি করতে সাহায্য করেছেন গ্রামের মেয়েদের। তাঁদের জন্য ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন। সরকারের তরফে আজ তাঁরা প্রত্যেকে মাসে এক হাজার টাকার ভাতা পান।

রাসিনা বলেন, ‘‘এখন বাচ্চা মেয়েদের বলি, নিজেরা রোজগার করে তোমার বাপ-ঠাকুর্দাকে দেখাও, তোমার শ্বশুরকে দেখাও! আমাদের পালা শেষ। এ বার তোমরা স্বাধীনতার লড়াই করো।’’

আজ তিনি বিধবা। স্বামীর মৃত্যু পরে ‘রাসিনা বেগম’ থেকে ‘রাসিনা বেওয়া’ হয়েছেন। চার সন্তানের মা। আজও মেলায় ঘুরে ঘুরে বিয়ের গীতের অনুষ্ঠান করে চলেছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy