‘হ্যামলেট’-এর দ্বিতীয় শো সেরে ফিরে আপ্লুত অভিনেতা কৌশিক সেন গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
মঞ্চে গিয়ে থিয়েটার দেখবেন, না অনলাইন— বর্তমানের অন্যতম বড় বিতর্ক সম্ভবত এটাই। এই বিতর্ক নিয়ে কী ভাবছে শহরের দুই প্রজন্ম? শনিবার সন্ধে। অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহ। উপচে পড়ছিল দর্শকে। তৃতীয় ঘণ্টা পড়ে যাওয়ার আগেই টানটান উত্তেজনা, নৈঃশব্দ্য। এ ছবি করোনা পরবর্তী কলকাতার। কে বলে থিয়েটার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শক? ‘হ্যামলেট’-এর দ্বিতীয় শো সেরে ফিরে রীতিমতো আপ্লুত অভিনেতা কৌশিক সেন।
প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর স্মরণে ‘মুখোমুখি’র নাট্য উৎসব চলছে শহরে। সেখানেই আমন্ত্রিত ছিল কৌশিক সেনের নাট্যদল ‘স্বপ্নসন্ধানী’। ফেরার পর এক রাশ তৃপ্তি নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে কৌশিক বললেন, ‘‘আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি, তাই হয়তো বুড়োদের মতো বলছি। সব কিছুর ডিজিটাল সংস্করণ হয় না। নাটকটা আজও মঞ্চে এসেই দেখতে হয়।’’
কৌশিকের মতে, কলাকুশলীদের সঙ্গে দর্শকের প্রত্যেক মুহূর্তের আদানপ্রদান কেবল প্রসেনিয়াম মঞ্চেই সম্ভব। নাটক দেখতে দেখতে কোনও বিশেষ মুহূর্তে এক সঙ্গে হেসে ওঠেন সবাই। কিংবা ফুঁপিয়ে কাঁদেন। সে তো মঞ্চের কলাকুশলীদেরও অনুভব করার মতো বিষয়। একদল বাড়ি থেকে নাটক করে ডিজিটাল আর্কাইভে তুলে দিল, আর এক দল বাড়ি বসে তা দেখল, সেটা কৌশিকের মতে আর যা-ই হোক ‘নাটক’ থাকে না।
লকডাউনে শহর জুড়ে প্রেক্ষাগৃহের ঝাঁপ বন্ধ ছিল। সিনেমা দেখার জন্য একের পর এক ওটিটি অ্যাপ ডাউনলোড করে রিচার্জ করে গিয়েছেন ঘরবন্দি মানুষ। পছন্দ মতো ছবি, সিরিজ খুঁজে নিয়েছেন। কিন্তু নাটক? সে তো আর ঘরে বসে চাক্ষুষ করার উপায় ছিল না।
সে কারণেই ‘ফোর্থ বেল থিয়েটার্স’, ‘কলকাতা রমরমা’র মতো জনপ্রিয় কয়েকটি ছোট নাট্যগোষ্ঠী বিভিন্ন নাটকের অডিয়ো ক্লিপ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কলাকুশলীরা যে যাঁর বাড়ি বসে নিজেদের অংশটুকু রেকর্ড করে পাঠাতেন। পরিচালক সেগুলো মন দিয়ে শুনে বাছাই অংশটুকু সম্পাদনা করে সঙ্গীত পরিচালককে দিতেন। তিনি আবার যেখানে যে বাজনা ভাল লাগে, তা জুড়ে একটা নাটকীয় অডিয়ো দাঁড় করাতেন।
পদ্ধতি যতই জটিল হোক, করোনার অনন্ত প্রহরে সে টুকুই ছিল নাটকের স্বাদ পাওয়ার উপায়। যাকে বলা যায়, নাটকের ডিজিটাল ভিডিয়ো সংস্করণ। এ ছাড়াও রয়েছে পডকাস্ট। দর্শকদের রাতারাতি শ্রোতায় পরিণত করেছিল নাটকের এই অনলাইন সংস্করণ। হু হু করে অনলাইন নাট্য-শ্রোতার সংখ্যা বাড়তে লাগল। তাতে সামগ্রিক ভাবে থিয়েটারের লাভ হয়েছিল না ক্ষতি? করোনার বিধিনিষেধ লাঘব হওয়ার সেই ডিজিটাল সংস্করণগুলোরই কী হল?
‘ফোর্থ বেল থিয়েটার্স’-এর সদস্য রোমিত গঙ্গোপাধ্যায় জানান, প্রচুর দর্শক সে সময় তাঁদের দলের প্রযোজনা ‘বিরিঞ্চিবাবা’ দেখেছেন অনলাইনে। দেখেছেন বলতে? শুধু শোনা নয়, দেখার মতো কিছু থাকে নাকি ভার্চুয়াল থিয়েটারে? রোমিত জানান, গ্রাফিক জুড়ে দিতেন শ্রুতি নাটকের পিছনে। ছবি দেখতে দেখতে নাটকের মেজাজ বদল ধরতে সুবিধে হত শ্রোতাদের। সেখানেই তাঁরা দর্শক হয়ে উঠতেন। প্রচুর মানুষ দেখতেন ফোর্থ বেলের অনলাইন নাটকের সিরিজ। অপেক্ষা করে থাকতেন পরের দিন, পরের অংশের জন্য। লকডাউনে অনুসরণকারীর সংখ্য়াও বৃদ্ধি পেয়েছিল এতে।
অন্য দিকে, কলকাতা রমরমা নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য কন্যকা ভট্টাচার্যর দাবি, অনলাইনে নাটকের অডিয়ো তৈরি করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। গ্রাফিক তৈরির খরচ বহন করতে পারেননি, তাই খুব একটা চকচকে করে প্রযোজনা ঘরে বসে সম্ভব হয়নি। দর্শক কিছুটা বাড়লেও দলের উপার্জন বাড়েনি। তাঁর কথায়, ‘‘যত লোক কলকাতা রমরমা-র নাম জানেন, পেজ ফলো করেন, তত লোক তো নাটকের শো দেখতে আসেন না! অনলাইনে শ্রুতিনাটক বা সিরিজ আমরা করেছি, কিন্তু খরচ এবং পরিশ্রম যা পড়ছে, তার থেকে স্টেজই ভাল।’’ লকডাউনে দলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে যা করেছিলেন, স্বাভাবিক সময়ে আর করতে চাইবেন না বলেই জানালেন তাঁরা।
ভিন্ন ছবিও রয়েছে। করোনা আবহে শহরের বিভিন্ন ছোট-বড় নাট্যগোষ্ঠী যখন ভার্চুয়াল অস্তিত্ব হাতড়ে চলেছিল, ‘স্বপ্নসন্ধানী’ তখনও কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমের কোনও সংস্করণ কিংবা পডকাস্ট তৈরির পথে হাঁটেনি। বরং কাজহারা নাট্যশিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা।
আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্ন ছিল কৌশিক সেনের কাছে, ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির ব্যাপারে কিছু কি ভেবেছেন?
কৌশিকের উত্তর, ‘‘ঋদ্ধি করছে করুক। ফেস্টিভ্যালগুলোতে পাঠানোর সময় ডিজিটাল রেকর্ড করা ছাড়া উপায়ও নেই। সে ভাবেই তো পুরস্কার আসে আজকাল। কিন্তু আমি একটু প্রাচীনপন্থী। তরুণ প্রজন্মের কাছে আগামীতে থিয়েটার হয়তো এ ভাবে আরও বেশি করে পৌঁছবে, তাতে হয়তো থিয়েটারেরও ভাল। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দ নয় এই পদ্ধতি। একটা মঞ্চের অভিজ্ঞতাই থিয়েটার। দর্শক এবং অভিনেতা একসঙ্গে যেখানে অংশ নিচ্ছেন না, সেখানে নাটকের নান্দনিক গুণ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলেই আমার মনে হয়।’’
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তরুণ প্রজন্ম যদি নাটকের অনলাইন সংস্করণ আনতে চায়, তার বিরোধিতা করবেন না কৌশিক। ইদানীং প্রেক্ষাগৃহের চেহারা দেখে তিনি আশাবাদী। নাটক দেখার ঝোঁক বাড়ছে বলেই মনে হয়েছে তাঁর।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটাও তো ছোট দলগুলোর উপার্জনে সহায়ক হতে পারে। প্রচার পাক গ্রাম, শহরের ছোট গোষ্ঠীগুলোও, এমনটাই চান কৌশিক। বললেন, ‘‘প্রচার পেলে বাংলার থিয়েটার আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সেই সময় এসেছে।’’
তা হলে হাতে রইল কী? থিয়েটারের মঞ্চ ‘প্রবীণ’ কৌশিকের মতো ‘নবীন’ কন্যকার পছন্দ হলেও নাটকের অনলাইন সংস্করণও তার পাশাপাশি থাকছে। এটাই সম্ভবত অতিমারিকালের দান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy