Have a look at the colourful life of dance choreographer Terence Lewis dgtl
Terence Lewis
সময়ের অভাবে ভেঙে যায় ১০ বছরের প্রেম, টলি নায়িকার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল এই বলি কোরিওগ্রাফারের
ভারতে কন্টেম্পোরারি ডান্স ফর্মের জনক তিনি। এক বাক্যে সবাই চেনে তাঁকে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের পাঠানচলের ঘিঞ্জি পরিবেশে জন্ম নেওয়া ডান্স মাস্টার টেরেন্স লুইসের জার্নি ছিল কণ্টকময়। দারিদ্র, একের পর এক ব্যর্থতা, প্রেম ভাঙার নিদারুণ যন্ত্রণা... ফিল্মের থেকে কোনও অংশে কম নয় সে অধ্যায়।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ১৪:৪৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৯
ভারতে কন্টেম্পোরারি ডান্স ফর্মের জনক তিনি। এক বাক্যে সবাই চেনে তাঁকে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের পাঠানচলের ঘিঞ্জি পরিবেশে জন্ম নেওয়া ডান্স মাস্টার টেরেন্স লুইসের জার্নি ছিল কণ্টকময়। দারিদ্র, একের পর এক ব্যর্থতা, প্রেম ভাঙার নিদারুণ যন্ত্রণা... ফিল্মের থেকে কোনও অংশে কম নয় সে অধ্যায়।
০২২৯
লুইস পরিবার মূলত ছিলেন মেঙ্গালুরুর বাসিনা। কিন্তু টেরেন্সের জন্ম মহারাষ্ট্রে। আট ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ঘিঞ্জি পরিবেশ, একটি মাত্র ঘরে বেড়ে ওঠা টেরেন্স পরিবারের সবচেয়ে খুদে সদস্য হওয়ায় বড় পরিবারে সে ভাবে পাত্তা পাননি কোনও দিন।
০৩২৯
বাবা ছিলেন কারখানার কর্মী, মা বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করতেন। যা রোজগার হত তাতে ১০ জনের পেট চালানো বেশ কষ্টকর ছিল।
০৪২৯
তবে ছেলের পড়াশোনা নিয়ে আপস করতে চাননি বাবা-মা। বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াশোনার যাবতীয় খরচ তিনি বহন করবেন। কিন্তু যদি টেরেন্স উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে চান, সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ খরচ তাঁর।
০৫২৯
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অসম্ভব আগ্রহী ছিলেন টেরেন্স। পড়তেন বান্দ্রার সেন্ট টেরেসা হাইস্কুলে। এমনিতে উচ্চবিত্তদের জন্য সেই স্কুলে দুঃস্থ ছেলেমেয়দের জন্য ছিল ‘গরিবি কোটা’। বিনামূল্যে স্কুল থেকে খাবারও দেওয়া হত তাঁদের।
০৬২৯
কিন্তু টেরেন্স কখনওই সেই খাবার খেতে চাইতেন না। পরে টেরেন্স এক বার বলেছিলেন, “আমি গরিব, সবাই সেটা জেনে আমায় দয়া করুক, তা কোনও দিনই চাইনি আমি।”
০৭২৯
টিফিন ব্রেক শেষ হয়ে গেলে সেই খাবার নিতে যেতেন তিনি। বন্ধুদের লুকিয়ে খাবার খেয়েই আবার ক্লাস করতে চলে যেতেন।
০৮২৯
কোনও দিনও ভাবেননি ডান্সার হবেন। নাচ ছিল তাঁর সহজাত। মিউজিক শুনলে শরীর নেচে উঠত তাঁর। ইচ্ছা ছিল অভিনেতা হওয়ার। ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া টেরেন্স বাড়িতে নিয়ে আসতেন বহু পুরস্কার।
০৯২৯
সব কিছু ভালই চলছিল। এমন সময়ে তাঁর জীবনে ঘটে এমন একটি ঘটনা, যা ছোট্ট টেরেন্সকে ওই ছোট বয়সেই দারিদ্রের আসল ছবিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল।
১০২৯
তাঁর দাদার বিয়ে উপলক্ষে তাঁদের ওই এক কামরার ঘিঞ্জি ঘরের উপর একটি ঘর বানানো হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের ঠিক কয়েক দিন আগেই বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন থেকে সে ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। কারণ ওই ভাবে ঘরের উপর ঘর তোলা ছিল আইনত অপরাধ।
১১২৯
চোখের সামনে নিজেদের বাড়ি ভেঙে যাচ্ছে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি টেরেন্স। খুব কেঁদেছিলেন। সে দিনই ঠিক করে নেন, কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কী করবেন? কী-ই বা ক্ষমতা রয়েছে তাঁর? এত বড় শহরে কার কাছেই বা যাবেন তিনি?
১২২৯
তখন তাঁর মাত্র ১৩ বছর বয়স। ঠিক এই সময়েই স্কুলে এক আন্তঃ কলেজ নাচের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল বিচারক ছিলেন ডান্স কোরিওগ্রাফার পরভেজ শেট্টি। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হন টেরেন্স। কিন্তু সেখানেও বাধা।
১৩২৯
পুরস্কার বিতরণ শেষে পরভেজ তাঁকে বলেন, ‘ইউ আর বেস্ট ফ্রম দ্য ওরস্ট’। ছোট্ট টেরেন্স প্রথমে বুঝতেই পারেননি পরভেজ তাঁকে প্রশংসা করলেন নাকি নিন্দা।
১৪২৯
পরে তিনি জানতে পারেন পরভেজ যা বললেন তাঁর মানে হল। “সবাই খারাপ। সেই খারাপের মধ্যে তুমি ভাল।” মানে হিসেব করলে দেখা যায় তিনিও খারাপ! মন খারাপ হয়ে যায় টেরেন্সের। নাচ, ওই একটি জিনিসই তো করতে পারতেন তিনি।
১৫২৯
সময় নষ্ট না করে চলে যান মুম্বইয়ে পরভেজের ডান্স অ্যাকাডেমিতে। এ দিকে হাতে পয়সা নেই। বাড়ি থেকেও চাইতে পারবেন না। জানতেন, চাইলেও পাবেন না। এই অবস্থায় তাঁকে একটি শর্ত দেন পারভেজ।
১৬২৯
তিনি বলেন, প্রতি দিন যদি নাচের ক্লাস পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব টেরেন্স নেন, তবে তাঁকে বিনামূল্যে নাচের শিক্ষা দিতে পারেন তিনি। এককথায় রাজি হয়ে যান টেরেন্স। শুরু হয় তাঁর নৃত্য প্রশিক্ষণ। এই প্রথম গুরু পান তিনি।
১৭২৯
পরভেজের কাছে ক্লাস করে তিনি তো অবাক। অচিরেই বুঝতে পারলেন নাচতে হয়তো তিনি জানতেন কিন্তু তাতে ‘টেকনিক’ সঠিক ছিল না। শিখতে লাগলেন টেরেন্স।
১৮২৯
এ দিকে স্কুলের পাঠ প্রায় শেষ। কলেজে উঠলে নিজের দায়িত্ব যে নিজেকেই নিতে হবে তা অনেক দিন আগেই বলে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন তিনি। পকেটমানিও উঠে আসতে থাকে। ভর্তি হন মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে।
১৯২৯
বেশ কিছু দিন এ ভাবে চলার পর টেরেন্স ঠিক করেন, মুম্বইতেই একটি ডান্স অ্যাকাডেমি খোলার। তাই করেন। কিন্তু যে সব শহরের বাইরে যে সব ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে নাচ শেখাতেন, তাঁরা কেউ মুম্বইয়ে এসে নাচ শিখতে রাজি হলেন না। সে আর এক লড়াই।
২০২৯
কী করবেন এই নিয়ে টেরেন্স যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই তিনি লক্ষ্য করেন সে সময় বলিউডে অ্যারোবিক্সের চাহিদা খুব বাড়ছে। অভিনেত্রীদের মধ্যেও এর চাহিদা বাড়ছে খুবই। টেরেন্স ঠিক করেন অ্যারোবিক্স শেখাবেন তিনি।
২১২৯
অন্য কারও শিষ্য হয়ে কাজ করতে প্রথম থেকেই নারাজ ছিলেন তিনি। শুরু করেন অ্যারোবিক্স ক্লাস। কিছু কন্ট্যাক্ট ইতিমধ্যেই তৈরি করেছিলেন। তা থেকেই তাঁর সেই ক্লাসে আসতে থাকেন মাধুরী দীক্ষিত, বিপাশা বসু, গৌরি খানের মতো সেলেবরা।
২২২৯
সেলেবরা জানতেন তিনি ফিটনেস ট্রেনার। তিনি যে আদপে কোরিওগ্রাফার তা ছিল অনেকেরই অজানা। ঠিক এমন সময়েই ভাগ্য সদয় হয় তাঁর। আমির খানের তৎকালীন স্ত্রী রিনা দত্তকেও অ্যারোবিক্স শেখাতেন তিনি।
২৩২৯
সে সময় ‘লগন’ ছবির একটি বল ডান্সের দৃশ্যে কোরিওগ্রাফার খুঁজছিলেন আমির-রিনা। রিনা, টেরেন্সের কাছে ওই বিশেষ দৃশ্য কোরিওগ্রাফ করার প্রস্তাব নিয়ে যান। টেরেন্সও রাজি হয়ে যান।
২৪২৯
বলাই বাহুল্য, সেই বিখ্যাত বলরুম ডান্সের দৃশ্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ব্যাস, ভাগ্যের চাকা ঘোরে টেরেন্সের। একে একে আসতে থাকে ছবির অফার, ‘নাচ’, ‘ঝঙ্কার বিটস’ ছবিতে কোরিওগ্রাফ করার সুযোগ পান তিনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন অ্যাড ফ্লিমেও কাজ করতে থাকেন। টেরেন্সের নাচের অ্যাকাডেমিও ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
২৫২৯
এরই মধ্যে বিদেশে গিয়ে নাচের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সব কিছু ভাল চললেও ছবিতে খুব একটা অফার যে তিনি পাচ্ছিলেন এমনটা নয়। প্রথম সারির কোরিওগ্রাফারদের লিস্টে তখনও জায়গা পাননি তিনি। ঠিক এ সময়েই তাঁর জীবনে আসে ‘ডান্স ইণ্ডিয়া ডান্স’।
২৬২৯
সেই শো-তে বিচারকের আসন তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। পেয়ে যান প্রচারের আলো। যে আলোর ছটা আজও সমানভাবেই উদ্ভাসিত। ‘রাম লীলা’ এবং ‘গোল্ড’ ছবির কোরিওগ্রাফার কিন্তু তিনিই।
২৭২৯
ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় হারিয়েছেন ভালবাসাকেও। টেরেন্সই এক বার বলেছিলেন, ১০ বছর যার সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলেন তিনি, তাঁরই সঙ্গে নিজের দোষে ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল। এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কেরিয়ার গড়তে যে সময় দিতে ভুলে গিয়েছিলেন একেবারেই।
২৮২৯
বাঙালি অভিনেত্রী সায়ন্তনী ঘোষের সঙ্গেও সম্পর্কে ছিলেন তিনি। তবে তা যে সিরিয়াস ছিল না, পরে তা নিজেই জানান টেরেন্স।
২৯২৯
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আজ তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে এক নামে চেনে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও প্রচুর। আজ আর মিউনিসিপালিটির গাড়ি তাঁর বাড়ি ভেঙে দিয়ে যায় না, ‘গরিবি কোটা’য় খাবারের জন্য লাইনও দিতে হয় না তাঁকে। তাঁর নামই আজ যথেষ্ট। তিনি টেরেন্স লুইস।