Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
যৌথ প্রযোজনার ছবি

ফিতের ফাঁস থেকে মুক্তি চায় দুই বাংলাই

বছরখানেক আগের কথা। ও পার বাংলায় তত দিনে জোর কদমে শুরু হয়ে গিয়েছে দু’দেশের যৌথ প্রযোজনা গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’-এর শ্যুটিং। ঢাকার তথ্য মন্ত্রকের কাছ থেকে ছবিটি করার ছাড়পত্র হাতে এলেও তখনও সবুজ-সঙ্কেত মেলেনি দিল্লির।

ঋজু বসু ও অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৪
Share: Save:

বছরখানেক আগের কথা। ও পার বাংলায় তত দিনে জোর কদমে শুরু হয়ে গিয়েছে দু’দেশের যৌথ প্রযোজনা গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’-এর শ্যুটিং। ঢাকার তথ্য মন্ত্রকের কাছ থেকে ছবিটি করার ছাড়পত্র হাতে এলেও তখনও সবুজ-সঙ্কেত মেলেনি দিল্লির।

সে সময়ই ভাষা-দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকা সফরকারী দলে গৌতম-প্রসেনজিতরাও মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী। ‘‘কাকতালীয় ভাবে আমরা ঠিক ঢাকা পৌঁছনোর পরেই ছাড়পত্র এল দিল্লি থেকে!’’ বললেন অভিনেতা প্রসেনজিৎ। তিনি এ ছবির প্রযোজনারও শরিক।

দু’দেশে যৌথ প্রযোজনায় অভিজ্ঞ টালিগঞ্জের এক প্রযোজকের মতে, ‘‘এ এক বিশ্রী টেনশন! কখনও ঢাকা, কখনও বা দিল্লি আমাদের ঝুলিয়ে রাখে। তিন হপ্তা না পাঁচ হপ্তা, কদ্দিন ছাড়পত্রের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকতে হবে, কেউ জানে না!’’ তিনি বলছেন, শ্যুটিংয়ের লোকেশন ঠিক করা, কলাকুশলী-শিল্পীদের সঙ্গে তারিখ পাকা করা, এ সব তো আর ফেলে রাখা যায় না। সরকারি আমলাতন্ত্রের ফাঁসে কাজ চালিয়ে যাওয়াটাই সমস্যার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ সরকার অবশ্য ছাড়পত্র নিয়ে এই টালবাহানার অভিযোগ সে-ভাবে মানতে রাজি নয়। দু’দেশের যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে পথের কাঁটা দূর করতে ঢাকার তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর যে বিশেষ সদর্থক ভূমিকা রয়েছে, তা গঙ্গা বা পদ্মাপারে কেউই অস্বীকার করেন না। সেই ইনুভাই জানাচ্ছেন, শ্যুটিংয়ের আগে ঢাকার চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (এফডিসি) মাধ্যমে ছবির স্ক্রিপ্ট খতিয়ে দেখা হয়। দু’দেশে শিল্পী-কলাকুশলীর সংখ্যায় ভারসাম্য আছে কি না, তা-ও দেখা হয়। এর পরেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রকের কাছ থেকেও আলাদা ছাড়পত্র লাগে প্রযোজকদের। তবে সোমবার ইনুভাই বলেন, ‘‘তথ্য মন্ত্রকের কাছ থেকে অনুমতি-পর্বটুকু নিছকই আনুষ্ঠানিকতা। ২৪ ঘণ্টার বেশি লাগে না।’’

দিল্লির তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের এক কর্তা অবশ্য মেনে নিচ্ছেন, যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দিতে খানিকটা সময় লেগেই যায়। তাঁর বক্তব্য, কী বিষয় নিয়ে ছবি, স্পর্শকাতর কোনও দিক আছে কি না, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়। সরকারি এই কর্তার যুক্তি— তড়িঘড়ি অনুমতি দেওয়ার থেকে দেখেশুনে ছাড়পত্র দেওয়াটাই ভাল।

তবে টালিগঞ্জ বা ঢাকার ইন্ডাস্ট্রির একাংশের প্রশ্ন, পরে তো ছবিকে সেন্সরের ছাঁকনি পার হতেই হয়। সুতরাং তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছ থেকে একই ব্যাপারে আরও একপ্রস্ত বাড়তি অনুমতির ঝকমারি কেন পোয়াতে হবে?

এই ‘ঝকমারি’তেই কিন্তু দু’দেশের প্রযোজকদের মধ্যে তিক্ততার নজির তৈরি হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন স্রিংলা-ই বলছেন, ‘‘যৌথ প্রযোজনায় নামলেও ভারতে কোনও কোনও প্রযোজক দিল্লি থেকে দরকারি ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে যান বলে অভিযোগ শুনেছি। এর ফলে, বাংলাদেশে তাদের সমস্যা পোয়াতে হয়েছে।’’

বাংলাদেশের কোনও কোনও প্রযোজক-প্রদর্শকের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই কলকাতার প্রযোজকেরা ছবিটা যৌথ প্রযোজনা বলে দেখাতে চান না। কারণ, দিল্লি ছোটাছুটি করতে হয়। টাকাও বেশি লাগে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘ব্ল্যাক’ ছবিটিও এ বাংলায় যৌথ প্রযোজনা বলে দেখানো হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। শেষমেশ কলকাতার সহ-প্রযোজকের নামে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা ঠোকেন ঢাকার প্রযোজক। এ পারের সহ-প্রযোজক রানা সরকার কিন্তু এর পিছনেও নিয়মের গেরোকেই দায়ী করছেন। তাঁর দাবি, ঢাকার প্রযোজকের নাম পোস্টারে ছিল। কিন্তু নিয়মের কিছু জটিলতার কারণেই ছবিটিকে যৌথ প্রযোজনার তকমা দেওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের ছবি প্রদর্শক সমিতির প্রবীণ কর্তা সুদীপ্তকুমার দাসের কথায়, ‘‘টালিগঞ্জ যৌথ প্রযোজনার নিয়ম ঠিকঠাক না-মানলে বাংলাদেশে সেই ছবির মুক্তি নিয়ে প্রশাসনের অন্দরে জটিলতা তৈরি হয়। ছবির মুক্তি পেতে সময় লেগে যায়।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার জন্য অপেক্ষা না-করে কলকাতার প্রযোজক আগে ছবি রিলিজ করে দেন। পাইরেসির দরুণ ঢাকায় ব্যবসা মার খায়।’’

এই ধরনের অভিযোগ যে মিথ্যে নয়, তা মেনে নিচ্ছেন দু’দেশে অজস্র যৌথ প্রযোজনার রূপকার, কলকাতার এস কে মুভিজ-এর কর্তা হিমাংশু ধানুকাও। যদিও তাঁরা নিজেরা যাবতীয় নিয়ম মেনেই যৌথ প্রযোজনায় হাত দেন বলে দাবি করছেন হিমাংশু। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির অনেকে মনে করছেন, নিয়মের গেরো সামলাতে গিয়েই কিছু অনভিপ্রেত সমস্যা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। দু’দেশে এক সঙ্গে ছবি রিলিজ করা এখনও কিছুটা দুর্লভ। এমনতর অভিজ্ঞতায় ইদানীং যৌথ প্রযোজনা নিয়ে খানিকটা বীতশ্রদ্ধ মহম্মদ গোলাম কিবরিয়া বা নাসিরুদ্দিন দিলুর মতো বাংলাদেশি প্রযোজকেরা।

এ পারে গৌতম ঘোষ-প্রসেনজিতরা কিন্তু ধৈর্য ধরারই পক্ষপাতী। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা দুই সরকারের সঙ্গেই নিয়মিত কথা বলছি। আশা করছি, জটিলতা কেটে যাবে। ইনুসাহেব বিষয়টি নিয়ে খুবই সদর্থক ভূমিকা নিচ্ছেন।’’

এক সঙ্গে দু’দেশে ছবি মুক্তি নিয়ে জটিলতা ঠেকাতে ইনুসাহেব কিছু পদক্ষেপও করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সেন্সরের সময়ে যৌথ প্রযোজনার ছবিকে আমি অগ্রাধিকার দিতে বলে রেখেছি। এ ক্ষেত্রে দেরির ফলে, কোনও একটি দেশে ছবি আগে মুক্তি পেয়ে যাওয়াটা কাম্য নয়।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘মুক্তির দিন সাতেক আগে সেন্সরের জন্য পাঠানো হলেও সোজা রাস্তায় দ্রুত ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হবে না।’’

বাংলাদেশের এই প্রবীণ মন্ত্রীর মতে, ছবি মুক্তির নিয়মে কিছু জটিলতা থাকলেও, কিছু জানলাও খোলা আছে। দু’দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরই তা কাজে লাগানো উচিত। গৌতম-প্রসেনজিতদের মতো ইনুও মনে করেন, দু’দেশে ছবির বাণিজ্যের অবাধ পরিসর গড়ে তোলাটাই টালিগঞ্জ ও ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ। শিল্পের মন্দার জমানায়, দু’টো দেশকে জুড়ে বাজার বাড়ানো ছাড়া গতি নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

redtape crossborder movies
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy