জিৎ ও প্রিয়াঙ্কা।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মানেই স্টেজ শোয়ের মরসুম। ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মাচা’। তারকাদের ‘ব্যাঙ্ক’। শয়ে-শয়ে দর্শকের ভালবাসা, উন্মাদনার যে কী টান, তা তারকা মাত্রেই জানেন! সেই সঙ্গে মা লক্ষ্মীর দাক্ষিণ্য তো বটেই। তবে টানা এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্টেজে দাঁড়িয়ে শো করাটা সহজ নয়। এই লম্বা সময়ে দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রত্যেক তারকার রয়েছে নিজস্ব ইউএসপি। যার টানেই শোয়ে দর্শকের হাজিরা, উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস...
তারকার ক্যারিশমা
বিগত পাঁচ-ছ’ বছরে এই ধরনের স্টেজ শোয়ের চালচিত্রে বড় একটা বদল এসেছে। টিকিট কেটে শো দেখা প্রায় উঠেই গিয়েছে এবং তার প্রভাব পড়েছে পারফরম্যান্সে। এখনকার অধিকাংশ শো-ই স্পনসর্ড। আর তাতে মুখ্য ভূমিকা গানের। নাচের এখন গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স। নায়কদের মধ্যে শোয়ের চাহিদার নিরিখে এগিয়ে জিৎ এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। দুই তারকাই বেছে বেছে শো করেন। মেদিনীপুর বা বাঁকুড়া, আসানসোল কিংবা দুর্গাপুর শহরেই মূলত তাঁদের শো সীমাবদ্ধ। প্রসেনজিতের শোয়ের মূল আকর্ষণ তাঁর গান। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার...’ থেকে শুরু করে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও...’ কয়েক দশক ব্যাপী কেরিয়ারে তাঁর হিট গানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঘণ্টাখানেকের শোয়ে গান গেয়ে অনায়াসে তিনি মাতিয়ে দেন। সঙ্গে অবশ্য থাকে তাঁর নিজস্ব ব্যান্ড। পাশে যদি স্ত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় থাকেন, তা হলে তো কেয়া বাত! টলিউডের ফার্স্ট লেডি রীতিমতো ট্রেনড সিঙ্গার। তাঁদের একসঙ্গে শোয়ের জবাব নেই।
জিতের শোয়ের আকর্ষণও গান। গানে তাঁর সুনাম রয়েছে। সে ভাবে তাঁকেও ইদানীং নাচতে দেখা যায় না। দর্শকের সঙ্গে ইন্টার্যাকশন ছাড়া অ্যাকশন দৃশ্যও কখনও অভিনয় করে দেখান। এবং তাঁর পারিশ্রমিকও সবচেয়ে বেশি। তিনি শো প্রতি দশ-বারো লক্ষ টাকা নেন বলে শোনা যায়। তবে মাচার বাজারে ইদানীং দেবের জনপ্রিয়তা কম বলেই খবর। সাংসদ হওয়ার পর সারা মেদিনীপুর শহর জুড়ে বহু র্যালি এবং প্রচারসভা করেছেন তারকা। এই ধরনের শোয়ের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হচ্ছে মেদিনীপুর। সেখানেই দর্শক তাঁকে কাছ থেকে বহু বার দেখেছেন। এটাই দেবের শোয়ের জনপ্রিয়তা কমার কারণ বলে মনে করছেন অনেক উদ্যোক্তা। তবে দেবের শোয়ের ইউএসপি কিন্তু নাচ। ‘চ্যালেঞ্জ নিবি না’ থেকে ‘পাগলু থোরা সা করলে রোম্যান্স’... ডান্স ফ্লোর মাতাতে এ সব গানের জুড়ি নেই। মাচায় অঙ্কুশেরও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তার কারণও নাচ। যশ দাশগুপ্তও শো করছেন। তবে তিনি যা পারিশ্রমিক হাঁকাচ্ছেন, তাতে উদ্যোক্তারা তাঁর কাছে ঘেঁষতেই নাকি রাজি হচ্ছেন না! যিশু সেনগুপ্ত একটা সময়ে অনেক যাত্রা এবং শো করলেও ইদানীং অবশ্য তাঁকে মাচার ময়দানে দেখা যায় না।
গাইতে জানলে
নায়িকাদেরও শোয়ের ইউএসপি এখন গানই। শ্রাবন্তী, শুভশ্রী, সায়ন্তিকা হয়ে মিমি, নুসরত... গানেই তাঁরা মঞ্চ মাতান। শ্রাবন্তীর শোয়ে দর্শকের সঙ্গে কথা, গান, সংলাপের পাশাপাশি মিমিক্রিরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এই কারণে গ্রামে-গঞ্জে নায়িকার জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। সায়ন্তিকাও সারা বছর প্রচুর শো করেন। গানের জন্য তাঁর নিজস্ব ব্যান্ডও রয়েছে। তবে দর্শকের সঙ্গে আলাপচারিতার একটা নিজস্ব কায়দা রয়েছে সায়ন্তিকার। মাচায় শুভশ্রীর জনপ্রিয়তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। গান তো বটেই, সেই সঙ্গে তিনি অল্প সময় হলেও নাচেন। ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’-এর কারণে মাচায় রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচণ্ড জনপ্রিয়। গান গেয়ে, সংলাপ বলে শো জমাতেও পারেন। সাংসদ হওয়ার পর থেকে মিমি এবং নুসরতের শোয়ের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। তাঁদেরও শোয়ের মূল আকর্ষণ গান। তবে শো বিশেষ না করলেও, কোয়েল মল্লিকের শোয়ের বিরাট চাহিদা। এবং তাঁর পারিশ্রমিকও সবচেয়ে বেশি। শো প্রতি তিনি নাকি তিন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা নেন। তাঁর পরেই শ্রাবন্তী ও শুভশ্রী। তাঁদের পারিশ্রমিক দেড় থেকে আড়াইয়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তবে এ বছর ছবির কারণে শুভশ্রী শো করেননি।
ছোট পর্দার বড় মুখ
মাচায় ছোটপর্দার অভিনেতাদের জনপ্রিয়তা দাঁড়িপাল্লায় মাপতে গেলে ধন্দে পড়তে হতে পারে! শ্যামা (তিয়াশা রায়), রাসমণি (দিতিপ্রিয়া রায়), জবার (পল্লবী শর্মা) শো দেখলে বোঝা মুশকিল, তাঁরা বড় পর্দার নায়িকা নন! ছোট পর্দার বহু অভিনেতারই বিপুল চাহিদা রয়েছে মাচায়। জেনে অবাক হবেন, বেশ কয়েক বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া ধারাবাহিক ‘ভালবাসা ডট কম’-এর প্রধান চরিত্র ওম (রাজা গোস্বামী) এবং তোড়া (মধুবনী ঘোষ) আজও নিয়মিত শো করে থাকেন! বাহাও (রণিতা দাস) মাচায় বেশ জনপ্রিয়। তবে এই অভিনেতারা কেউই ট্রেনড সিঙ্গার বা ডান্সার নন। তাই গানের গুঁতোও আছে। গত বছর এ রকমই এক শোয়ে বেসুরো গান গাওয়ায় দিতিপ্রিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলড হয়েছিলেন। শোয়ের উদ্যোক্তা রাজ সরকারের কথায়, ‘‘শো করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট সময় স্টেজে থাকতে হয়। দর্শকের সঙ্গে কথা, সংবর্ধনা দেওয়া... এ সবের পরেও বাকি চল্লিশ মিনিট তো দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাই যেমনই হোক গান গাইতে হয়, কারণ সেটা অনেক সহজ।’’ ছোট পর্দার জনপ্রিয় সিরিয়ালের মুখ ঊষসী রায় (বকুল কথা), মনামি ঘোষ (ইরাবতীর চুপকথা), ঐন্দ্রিলা সেনের (ফাগুন বউ) শো-ও মফস্সলে খুবই জনপ্রিয়।
তবে টেলিভিশনের মুখ হলেও অভিনেতাদের বায়নাক্কা নেহাত কম নয়। ছোটপর্দা মানেই অভিনেতারা শোয়ের ঘণ্টা তিন-চারেক পরে পৌঁছবেন, এটা যেন অলিখিত নিয়ম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, গত বছর পুজোর সময় অনেক শো করেছিলেন তিয়াশা রায়কে (শ্যামা) নিয়ে। কিন্তু তার জন্য তাঁকে যা হ্যারাসড হতে হয়েছিল, তা জীবনে কখনও হতে হয়নি। উদ্যোক্তা বাবুয়া ভৌমিকের কথায়, ‘‘সিরিয়ালের আর্টিস্টদের সঙ্গে যখন চুক্তি হয়, তখনই সেখানে সময় লেখা থাকে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক আর্টিস্টই অন্তত তিন-চার ঘণ্টা লেটে পৌঁছন। দর্শক প্রচণ্ড বিরক্ত হন। এবং তাঁদের রাগ গিয়ে পড়ে অর্গানাইজ়ারদের উপরে। তাঁরা তখন মার পর্যন্ত খান।’’
রাজনীতির রং
গত কয়েক বছর ধরে বহু তারকাই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে পলিটিক্যাল র্যালি করেন বা মিটিং-মিছিলে যান। ‘‘তাই আগে তারকাদের দেখার যে উন্মাদনা ছিল তা মেদিনীপুর হোক, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদা, সেটা এখন অনেকটা কমে এসেছে। যাঁকে বিভিন্ন সময়ে দেখা যাচ্ছে, তাঁকে আবার শোয়ে দেখার জন্য আলাদা করে টাকা খরচ করব কেন? বেশ কয়েক বছর ধরে টিকিট সেল একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন বরং বিভিন্ন পুজোপার্বণে, মেলা, মন্দির নির্মাণ উপলক্ষে শো হচ্ছে। তারকারা আসেন মেলায় গানবাজনা করতে,’’ বললেন উদ্যোক্তা তোচন ঘোষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন মাচা শো স্পনসর করে বিভিন্ন ক্লাব। এবং তার পিছনে থাকে রাজনৈতিক রং, যা ছাড়া শো প্রায় ভাবাই যায় না। আগে মাচায় নাচ বাধ্যতামূলক ছিল। ইদানীং তা প্রায় উঠেই গিয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বললেন, ‘‘আগে পাবলিক টিকিট কেটে আসত, ডান্স পারফরম্যান্স দেখার জন্য। তাই তখন স্টার নাচ-গান দুটোই করতেন। শো হিট করানোর দায়বদ্ধতা উদ্যোক্তা, শিল্পী দু’তরফেরই থাকত। তার জন্য শিল্পীরাও পরিশ্রম করতেন। এখন সেই ব্যাপারটাই বদলে গিয়েছে।’’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় সব কিছুই। সে ভাবেই বদলেছে মাচার ধরন। আবার মাচা আগে শীতকালেই হত, এখন কিন্তু তা বছরভরই চলতে থাকে, তারকাদের ইউএসপি-তে ভর করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy