কারও কাছে এটা নতুন জগতে পাড়ি দেওয়ার শুভ সূচনা। কেউ জীবনের সমস্ত ভুলভ্রান্তি চুকিয়ে অপার শান্তিতে ডুবে যাওয়াতেই খুঁজে পান অন্য সুখের হদিস। কারও কাছে চলতে চলতে হঠাৎ করে থেমে যাওয়া। কারও কাছে জীবনের অভ্যেস এক লহমায় বদলে যাওয়া। মৃত্যু। রুপোলি পর্দায় মৃত্যুকে উপজীব্য করেই পরিচালকরা বুনেছেন ধূসর সব রূপকথা। তা কি দর্শককে ঠেলে দেয় গভীর বিষাদে? না কি দর্শক সেই যন্ত্রণা থেকে উত্তরণে খুঁজে পান জীবনের নতুন মানে? এর জবাবই খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম সেলুলয়েডের কথকদের কাছে।
কারও কাছে হঠাৎ এসে পৌঁছয় মৃত্যুর পরোয়ানা। তখন ফেলে রাখা হাতে গোনা জীবনটাকে চেটেপুটে বেঁচে নেওয়া ছাড়া বোধহয় উপায় থাকে না কোনও। তাই মৃত্যুর অমোঘ অথচ অকাল আহ্বানকে তুচ্ছ করে বড় পর্দায় রাজেশ খন্না বলে ওঠেন, ‘‘বাবুমশায়, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নহি।’’ হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, গুলজারের লেখা ‘আনন্দ’-এর সংলাপে যেন নতুন ভাষা ফিরে পায় ভারতের চলচ্চিত্রজগৎ।
সেই ভাষাতেই বছরের পর বছর গল্প বুনে চলেছেন পরিচালকরা। যেমন সম্প্রতি এমনই এক প্রাণবন্ত জীবনের গল্প শোনায় ‘অক্টোবর’। সেখানে মৃত্যু এসেও আসে না। ধীর পায়ে হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করে বেড়ায় সে। কারও অনির্বাণ ভালবাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ ছু়ড়ে দেয়। এক লহমায় মরে যাওয়ার চেয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে চাক্ষুষ করার যন্ত্রণা ঢের বেশি। তাই ‘অক্টোবর’-এর যন্ত্রণা ভয়ঙ্কর। দর্শক ঠান্ডা ঘরে সিনেমা দেখতে দেখতে পৌঁছে যান আইসিইউ-এর দম বন্ধ পরিবেশে। মৃত্যুকে উপজীব্য করে ছবি বানাতে গিয়ে পরিচালক কি তার উদ্যাপন করেছেন? সুজিত সরকার বলছেন, ‘‘আপনি নিজে এক জন মানুষ হিসেবে মৃত্যুকে কী ভাবে উপলব্ধি করেন, সেটাই আসল। মৃত্যু মানে তো শুধুই শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বরং নতুন শুভ কিছুর সূচনা...’’ তাই বলে কি মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা সার্থক?
‘আনন্দ’
দিন গুনেছিল সোহাগও (শ্রাবন্তী)। ‘বুনো হাঁস’-এ ক্যানসার আক্রান্ত সোহাগের মুখে নেমে এসেছিল মৃত্যুর উপত্যকা। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। হাজারো মিথ্যের ভিড়ে সেটাই সত্যি। বাস্তবে মানুষ কত চিন্তা করেন। ভাল চাকরি, বাড়ি, ভাল থাকা— চাহিদাও অনেক। কিন্তু কেউই মৃত্যু চান না। তাই দর্শককে মৃত্যু ঝটকা তো দেয়ই।’’ মানছেন সুজিতও। ‘‘জীবনের শেষ প্রান্তে কি কখনও আমরা আইসিইউ-মুখী হব না? মায়ের অসুস্থতার জন্য সাড়ে তিন-চার মাস ছিলাম হাসপাতাল চত্বরে। কী ভাবে বিষয়গুলো আত্তীকরণ করছি, সেটাই সত্যি।’’
‘গুজ়ারিশ’
তবে সত্যি বলতে, বেঁচে থাকার দিন গোনা বড় দুঃসহ। তাই ‘কল হো না হো’তে প্রেমিকা নয়নাকে নিরাপদ কারও হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর হয় আমন (শাহরুখ খান)। ভেদাভেদ ভুলে নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ‘উই আর ফ্যামিলি’তে মায়া (কাজল) মেনে নেয় প্রাক্তন স্বামীর প্রেমিকাকে। ‘পা’তে জিনগত অসুস্থতায় মরতে বসা অরো (অমিতাভ বচ্চন) মিলিয়ে দিয়ে যায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একা একা থাকা মা আর বাবাকে। ছবি বা চরিত্রগুলো আলাদা আলাদা হলেও আসলে তা বাস্তবেরই কথা বলে। অনিরুদ্ধ বলছেন, ‘‘কোনও চরিত্রের মৃত্যু ছবির প্লট অনুযায়ী অর্গ্যানিক ভাবেই আসে। ছবির চরিত্র উঠে আসে বাস্তব থেকেই।’’
আর ভাগ্যের পরিহাসকে মেনে না নিয়ে কেউ আবার দুঃসহ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করে। মঞ্চ কাঁপানো জাদুকর ইথান (হৃতিক রোশন) পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে যেতে থাকে। তার যন্ত্রণার শরিক দর্শকও অবচেতনে ইচ্ছেমৃত্যু চেয়ে বসে। ফুরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত জেনে জীবনকে পুরোপুরি বেঁচে নেওয়াই কি একমাত্র প্রাপ্তি? সেই ভাঁড়ারে থাকতে পারে অনেক কিছুই। সুজিত বললেন, ‘‘ছবিতে শিউলি (বনিতা সান্ধু) কোমাটোজে ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটা এমন পরিসর, যেখানে প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তরের ভাঁড়ার শূন্য। এই নিরুত্তর অঞ্চলে মস্তিষ্ক কাজ করে মাত্র। কিন্তু সে কী ভাবছে, কিছুই জানা নেই। ফলে শিউলির চরিত্রের বিপরীতে ড্যান (বরুণ ধওয়ন) যখন দাঁড়িয়ে, তখন শিউলি শুধুমাত্র রোগী নয়। ড্যানের চরিত্র তাকে খোঁজার চেষ্টা করে, পড়ার, বোঝার চেষ্টা করে। আর এক জন মানুষের ক্ষেত্রে অন্য আর এক জনকে প়়ড়তে চাওয়ার মতো সুন্দর কিছু হতে পারে না। তাই ‘অক্টোবর’-এ কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু আসলে অনেক কিছু হচ্ছে।’’
‘বুনো হাঁস’
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রিয়্যালিজ়মকে মানতে গেলে কোথাও গিয়ে মৃত্যু তো অবধারিত। আর এই বোধও একটা সময়ের পর কাজ করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে গিয়েছেন ‘‘... মেলেনি উত্তর’’... আমরা কেউ অস্বীকারও তো করতে পারি না। তাই না?’’
জীবন অবসানের পর আত্মার অবস্থান যতটা রহস্যময়, ততটা জটিল মৃত্যুকালীন অবস্থাও। কেউ কী ভাবে সেই করিডোর দিয়ে এগিয়ে যান, তা স্পষ্ট নয় কারও। নির্মাতারা ছবিতে চরিত্রের অকালপতনের মধ্য দিয়ে আবহ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন মাত্র।
তবে মৃত্যু একক নয়। বাস্তবে যেমন সেই মানুষটির ফেলে যাওয়া পরিপার্শ্বে ছড়িয়ে থাকে শূন্যতা, তেমনই পর্দার মৃত্যুও নীল, ব্যথাতুর। সেই বিষাদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে। জমতে থাকে দর্শকের মনের নিকষ অন্তরালে। তবে সবই কি হারায়? বরং কিছু তো ফিরে ফিরেও আসে। যেমন জীবনানন্দ বলে গিয়েছিলেন, ‘‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়...’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy