‘গুলাবো সিতাবো’ ছবির দৃশ্যে আয়ুষ্মান খুরানা ও অমিতাভ বচ্চন।
অভিনয়ে: অমিতাভ বচ্চন, আয়ুষ্মান খুরানা প্রমুখ।
পরিচালনা: সুজিত সরকার
সবুরে মেওয়া ফলে। ঢিমে তালে চলতে শুরু করা ফ্রেমগুলো সে কথা মনে করাবে। তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে সময় দিতে হবেই। সে দাবি জানিয়ে দেওয়ার মতো জোর তাদের রয়েছে। তবে পাল্টা দাবিতে গতি বাড়ানোর ইচ্ছে, ভাবনা, দায়— কোনওটাই দেখানোর তাড়া যে নেই, সেটুকু প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দেয় ‘গুলাবো সিতাবো’।
পর পর এক সার ফ্রেম। একে একে সাজালে একটু একটু করে তৈরি হতে থাকা গল্প। কাহিনি নয়। কথা। অনেক কথা মিলে কখনও আখ্যান হবে। সে আশ্বাস আছে। সেই সব কথা একে একে ঘিরে ধরে শহরটাকে। কেন্দ্রের কাছ থেকে নয়, সীমান্তের ধার-কাছ থেকে।
এই ভাবের সঙ্গে শহরটার ছন্দের মিল আছে। ফ্রেমের পর ফ্রেম সেই ছন্দে পতন না হতে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে ব্যস্ততা। ইয়ে হ্যায় লখনউ নগরী। এখানে একটি বাক্যও যে হুড়োহুড়িতে নষ্ট হওয়ার নয়। এটাই যে তার পরিচয়। এখানে ব্যঞ্জনার যত্ন না নিলে চলে কি? পরিচালক সাহেব তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে কসুর করেন না।
লখনউ শহরের নাম নিলে ঠিক কী কী মনে পড়ে বলুন তো? বোল, চাল, রহন-সহন, কবাব, বিরিয়ানি, নবাব। তাই তো?
আর? সাত মহলা?
আয়ুষ্মান খুরানা এবং অমিতাভ বচ্চন।
কারও কারও মনে আসতেও পারে গতি-প্রসঙ্গ। যার আলতো ছোঁয়ায় তৈরি হয় লখনউভি মেজাজ। সেই মেজাজের আদরেই তো লখনউ শহর আরও বহু পরিচিত ফ্রেমের থেকে অন্য রকম। সেই মেজাজটাই ফিরে ফিরে আসে কৌতুকের ছলে। আলতো চালে। ইঙ্গিতে-ব্যঞ্জনায়। ফ্রেমের ঘা়ড়ে ফ্রেম চাপে। গল্প গতি পায়।
অখ্যানটি লোভের। আবার নির্লোভেরও। অপারগতার। বেঁচে থাকার ইচ্ছার। প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকার চেষ্টার। সুজিত সরকার শুধু পরিচিত অভীপ্সার সে সব কথা বসিয়েছেন লখনউয়ের ছাঁচে। যত্নে কোনও কমতি নেই কোথাও। ফাতিমা মহলের বিশালাকার শূন্যতার মধ্যে গল্পরা বাসা বেঁধেছে। খাঁ খা করা লজঝড়ে হাভেলিটির মধ্যে কখনও দারিদ্র কথা বলে, কখনও লোভ, কখনও হতাশা, কখনও ভয়, কখনও আবার শুধুই মধ্যবিত্ততা। এ সবের মধ্যেই রোজ লড়াই-ঝগড়া, টানাটানিতে মাতেন মির্জা রূপে অমিতাভ বচ্চন আর বাঁকে চরিত্রে আয়ুষ্মান খুরানা। সকলকে নিয়ে শুকনো, মাপা কৌতুক করে চলে লখনউ নগরী।
ভাল মানের বিরিয়ানি রান্নার জন্য যেমন সবচেয়ে প্রয়োজন দরদ, ভাল ছবিও তেমন। মাপা দরদের ছোঁয়ায় এক-একটা পরতে এক-এক রকম স্বাদ-গন্ধের জন্ম হয় বিরিয়ানির হাঁড়িতে। কিছু মশলায় ঝাঁঝ বেশি, তো কিছুতে মিষ্টত্ব। মাংসের কাঠিন্যকে পরিমাণ মতো স্নিগ্ধতা দেবে গায়ে লেগে লেগে থাকা সুসিদ্ধ চাল। সবে মিলে হবে রাজকীয় অথচ কোমল এক শিল্পকর্মের সৃষ্টি। সুজিত সরকার ঠিক সে রকমই এক পাত্র সযত্নে তৈরি বিরিয়ানি তুলে ধরেছেন দর্শকের উদ্দেশে। ঘটমান বর্তমান কথা বলতে বলতে অবশেষে থামে। আহ্লাদের সেই স্বাদ শেষ ফ্রেমে গিয়ে বলে দেয় লোভীর হাতে রইল শুধু মাংসের হাড়। মির্জার হাতে যেমন শুধুই প্রাক্তন স্ত্রীর ৯৫তম জন্মদিন উপলক্ষে ফাতিমা মহল সাজানোর বেলুন!
আরও পড়ুন: অরূপ বিশ্বাস সে দিন এঁদের বলেন, দু’টো দিন সবুর কর না, দেখ কী হয়...
আরও পড়ুন: মোনালিকে বিয়ে করতে এসে ঘাড়ধাক্কা খেয়েছিলেন হবু স্বামী মাইক?
জুহি চতুর্বেদীর লেখার মেজাজ প্রথম বার চোখে পড়ার নয়। কৌতুক তাঁর লেখনির স্বভাবেই রয়েছে। সুজিতবাবুর ক্ষেত্রে বরং এই চেষ্টা কিছুটা নতুন। পিকু, পিঙ্ক, অক্টোবর কিংবা ভিকি ডোনারের থেকে গুলাবো সিতাবো অনেক অর্থেই আলাদা। পরিণত। প্রাপ্তমনস্ক। প্রতিটি চরিত্রের অভিনেতা নির্বাচনও সে কথা বলে। মহলের বেগম থেকে শুরু করে উকিল-সরকারি অফিসার, সকলেই চোখে পড়ার মতো। আর মুখ্য চরিত্রেরা? এটিকে বচ্চন সাহেবের শ্রেষ্ঠ কাজ বলা না গেলেও, শ্রেষ্ঠ চরিত্রের তালিকায় অবশ্যই তোলা যায়। আয়ুষ্মানও যে পরিণত হয়েছেন, তার ছাপ যথেষ্টই রয়েছে তাঁর অভিনয়ে।
তবু এই ছবির প্রধান চরিত্র লখনউ শহরটিই। গুলাবো সিতাবো সেই শহরের প্রতি পরিচালকের প্রেম নিবেদনই যেন। ভাবনার সেই সূক্ষ্মতা যেমন ফুটিয়ে তোলে গুলাবো আর সিতাবোর বাঁদর নাচে, তেমনই আসে মার্জিত সঙ্গীতের ব্যবহারে। সবে মিলে দেখায়, যে কোনও সমাজেরই সীমান্ত থাকে। আর সেই সীমান্তবর্তী মানুষেরা শহরের মানচিত্রের অন্যতম নির্ধারক। তাঁদের উত্থান-পতন, ফাতিমা মহলকে নিয়ে স্বপ্ন, সেটি আঁকড়ে ধরে রাখার লোভ এবং হাতছাড়া হওয়ায় হতবাক জীবন— সবটা বাঁধা হয়েছে সঙ্গীতে। সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মধ্যে অবশ্যই থেকে গেল এই ছবি।
ফিরে আসা যাক শুরুর বৃত্তান্তে। এ ছবির চলন সত্যিই বড় ঢিমে। সবুর করার অভ্যাস এ সময়ের দর্শকের নেই বললেই চলে। তাই এই ছবির গতিও সমালোচনার বিষয় হওয়ার ছিল। শুধু হল না, লকডাউনের ফলে। গুলাবো-সিতাবো ভাগ্যিস মাল্টিপ্লেক্সে রিলিজ না করে, ওটিটি হল। না হলে ধৈর্যের এমন পরিচয় কি দিতেন সিনেমা হলে যাওয়া দর্শকেরা? প্রশ্নটা থেকেই যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy