শর্বরী
ঠিকানাটা ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। আধুনিক কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সে-বাড়ির গল্প চিরকালীন। তা-বলে সে বাড়ি ঘিরে থাকা জ্যোতিষ্কদের ভিড়ে আপাত অকিঞ্চিৎকর এক শ্যামলবরণী কন্যাকে নিয়ে এত চর্চা হবে কে-ই বা ভেবেছিলেন!
রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের কবিতাভবনে বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্তদের যুগ্ম পরিবারের কচিকাঁচাদের ঝাঁকে ঝুমার কথা উঠে এসেছে নানা স্মৃতিগাথায়। ঝুমা (অজিত দত্তর মেয়ে), পরবর্তীকালের শর্বরী দত্তর সঙ্গে তিন দিন আগেই অনেক হাসিগল্প হয়েছিল তাঁর ‘মিমিদি’র। মিমি মানে বুদ্ধদেব-প্রতিভা বসুর বড় মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত। আবার মীনাক্ষীর স্বামী জ্যোতির্ময়ের ভাই আলোকময় ছিলেন শর্বরীর স্বামী। মিমি, জ্যোতিদের কাছ থেকে ঝুমার চলে যাওয়ার খবরটা প্রাণপণে চেপে রেখেছেন তাঁদের কন্যা কঙ্কাবতী ওরফে তিতির।
ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সে তিতিরদের বাড়িতেই সে-দিন মিমিদির সঙ্গে বসু-দত্তদের বাড়ির নানা গল্প শর্বরীর। পরিবারে যুগ্ম নাট্যপ্রযোজনার আসরে কত নামীদামি লোকের ভিড়। মিমি বা তাঁর বোন রুমিও (দময়ন্তী) তখন একটু মর্যাদার অধিকারিণী। তাঁরা নাটকে পার্ট পাচ্ছেন। ঝুমা, পাপ্পারা (বুদ্ধদেব-প্রতিভাপুত্র শুদ্ধশীল) ক্ষোভে জোট বাঁধলেন।
রিহার্সাল দিতে লোকজন চটি খুলে ঘরে ঢুকলেই ঝুমা আর পাপ্পার চোখে চোখে কথা হয়ে যেত। এর পরেই চটি হাতে নিয়ে পাশের ছাদে নিক্ষেপ। পরে সেই চটির খোঁজে রীতিমতো হাহাকার। কবিতাভবনের দোতলায় থাকতেন মিমিরা। ঝুমারা তিনতলায়। প্রতিভা বসু লিখে গিয়েছেন, এই শিশু-ব্রিগেডের দুষ্টুমির গল্প। বাড়িতে রান্নার লোক না-থাকলে রুমি, ঝুমা, পাপ্পা, কুশরাই (অজিত দত্তের ছোট ছেলে) সাহায্যকারীর ভূমিকায়। তখন কে কোন কাজ করবে তাই নিয়েই কুরুক্ষেত্র! এক টাকা হেড-টেল করে মিটমাট হত!
ব্রড স্ট্রিটের বাড়িটি শর্বরীর ভবিষ্যৎ জীবনের ঠিকানা হয়ে ওঠার নেপথ্যের গল্পটাও মজাদার সমাপতন। মিমি-জ্যোতির বিয়ের ঠিক আগে দক্ষিণ কলকাতায় হন্যে হয়ে ঠাঁই খুঁজছিলেন প্রতিভা। কবিতাভবন থেকে টানা রিকশার দূরত্বে ব্রড স্ট্রিটের বাড়িটা খুঁজে পাওয়ার সময়ে তাঁর সঙ্গী ছিলেন বালিকা শর্বরী।
আলোকময় ওরফে আলো দত্তের সঙ্গে বিয়ের পরে দু’জনে নানা শিল্পকর্ম, পোড়ামাটির কাজ, ছাপাশাড়ি নিয়ে মশগুল। ধুতির নিজস্ব কেতায় আলোকময়ও বিশিষ্ট উপস্থিতি। অক্সিডাইজ়ড গয়নার সাজে তরুণী শর্বরীও চোখে পড়ছেন। ১৯৬৯-এ ময়দানে জ্যোতির্ময়ের খেয়ালে শনিবাসরীয় ‘মুক্তমেলা’র আসর। ঝুমা-আলোরাও তাতে দোকান দিয়েছিলেন।
কবিতাভবনের ঝুমাকে চিনতেন পাশের পাড়ার মেধাবিনী ‘দিদি’ নবনীতা দেবসেনও। ১৯৯১-এ ব্র্যান্ড শর্বরীর জন্মের পরে ক্রমশ গোটা দেশে বিখ্যাত তিনি। টলিউড, বলিউড জুড়ে তাঁর ব্যাপ্তি। স্নেহের ঝুমার বিখ্যাত হয়ে ওঠায় নবনীতার গর্বের কথা জানতেন তাঁর মেয়ে অন্তরা। নবনীতার উদ্যোগে মেয়েদের সাহিত্যচর্চার মঞ্চ ‘সই’এ অতিথি হয়ে এসেছেন শর্বরী।
ষাট পেরিয়েও তিনি অদম্য। ২০১৭-য় নতুন ব্র্যান্ড শূন্য শুরু করেন শর্বরী। ‘‘এই জেদকে কুর্নিশ না করে উপায় নেই’’, বলছিলেন শিল্পীর কাছের মানুষ চৈতালী দাশগুপ্ত। ‘‘ইচ্ছেমতো কাজ করতে না পেরেই শূন্যর ভাবনা শর্বরীদির,’’ বলছিলেন শর্বরীর সহযোগী রেশমী বাগচী। ‘‘অবাক হয়ে দেখতাম নিজেকে ভাঙছেন। ছেলেদের ধ্রুপদী সাজের সঙ্গে মেয়েদের পোশাক করছেন, গরদকে ফেরাচ্ছেন।’’ শর্বরীর সুহৃদ কঙ্কাবতী বা অনন্যা চক্রবর্তীরা ব্যথিত, শেষ জীবনে শর্বরীর নিঃসঙ্গতায়। বৌমা কনকলতার সঙ্গে সখীসুলভ সম্পর্ক পাল্টে যায়। ছেলে-বৌমার সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে নিজের ব্র্যান্ড ছাড়তে হয় শর্বরীকে। তবু এক বাড়িতে থাকতেন। শেষ দিন বাড়িতে বিশ্বকর্মা পুজো হচ্ছিল। সন্ধে পর্যন্ত শর্বরী কী করছিলেন ‘জানেন না’ কেউই। শুধু ফোন বেজে যাচ্ছিল।
কবিতাভবনে ঝুমার শৈশবে স্নেহের বলয়ের সঙ্গে এই ‘অবহেলার জগতের’ মিল নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy