অনির্বাণ এবং মিমি দু'জনেই চান একসঙ্গে আরও কাজ করতে
গুণ গুণ করে গান গাইছেন অনির্বাণ। পাশেই লুজ ফিটেড বেলবটস আর সবুজ টপে উজ্জ্বল মিমি। অনির্বাণ ধীর, সিনেমা হল চালু হলে মানুষ কী আসবেন ছবি দেখতে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মাথায়। পাশাপাশি মিমি একনাগাড়ে কথা বলে চলেছেন... কলকাতার রাস্তায় গাড়ি না-চালানোর কারণ থেকে অনির্বাণের অনায়াস গান গাওয়া, তাঁর আলোচ্য বিষয়।
অনির্বাণ: (বিস্ময়) এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পরেও মিমির মধ্যে ইনোসেন্স কিন্তু থেকে গিয়েছে!
মিমি এ বার থামলেন!
মিমি: (বিস্ময় নিয়ে) মানে?
প্রশ্ন: একটু খোলাখুলি বলুন না!
অনির্বাণ: মিমি আর আমি খুব কম কাজ করেছি। সেই কবে ‘ধনঞ্জয়’। তাও আমাদের একসঙ্গে ছবিতে দেখা যায়নি। ‘ড্রাকুলা স্যর’-এ আমরা পাশাপাশি কাজ করলাম। প্রচুর দৃশ্য আমাদের একসঙ্গে। ও এত বছর কাজ করছে। স্বভাবত, অনেক অভিনেতার মধ্যেই যেটা দেখি, ফ্লোরে এসে বলতে থাকে, ‘ওহ ৫২ লেন্স!’ বা লাইট নিয়ে অভিনয়ের আগেই নানা কথা। এটা যে ভুল সেটা বলছি না। অনেক দিন ধরে ক্যামেরা, আলো এ সবের মধ্যে থেকে এটা হয়। কিন্তু মিমি এত সময় কাজ করার পরেও এ সব নিয়ে ভাবেই না। মিমি লেন্স নিয়ে কথাই বলে না। আমি খেয়াল করেছি, ফ্লোরে এল এক বার লেন্স দেখল। ওকে ডিওপি যা বলল সেই মতো ও কাজ শুরু করল। ফলে ওর এই ইনোসেন্সটা অভিনয়ের ক্ষেত্রেও আলাদা ছাপ রেখে যাবে।
(মিমি অবাক হয়ে অনির্বাণের কথা শুনছিলেন)
মিমি: তুমি এ ভাবে খেয়াল করেছ!
অনির্বাণ: মানুষকে খেয়াল করাই আমার কাজ।
মিমি: আমিও খেয়াল করেছি তোমায়! দেখুন, লেন্স নিয়ে ভেবে বা আলো নিয়ে শুটিং ফ্লোরে মন্তব্য করে আমি কী করব? ওটা আমার কাজ নয়। আমার কাজ শুধু অভিনয় করা।
অনির্বাণ: (অল্প হেসে) সেই কারণে ‘ড্রাকুলা স্যার’-এর শুটে আমরা কেবল মিমির ওই সংলাপের খাতাটা দেখতাম কত রকম রং পেন্সিল দিয়ে সংলাপ লেখা। সারা ক্ষণ ওটা নিয়ে আছে।
প্রশ্ন: দেবালয় বলছিলেন, ‘ড্রাকুলা স্যার’-এ অনেক শক্ত সংলাপ ছিল। আপনি ওঁকে বার বার সেই নিয়ে জানতে চাইতেন?
মিমি: আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছি। হিন্দি সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল। বাংলা আমার মাতৃভাষা। এই ছবিতে বেশ শক্ত সংলাপ ছিল। সেগুলোর উচ্চারণ নিয়ে সারা ক্ষণ দেবালয়কে জ্বালিয়েছি। আমি কোনও দিন চাইব না আমি বাংলা ভাষার উচ্চারণের জন্য কারও কাছ থেকে কোনও কথা শুনব! আর এই যে অনির্বাণ বলল আমি লাইট নিয়ে কথা বলি না। একটা সময় ছিল যখন প্রথম কাজ করতে এলাম, তখন এমনও হয়েছে ফ্লোরে কেউ বলল লাইট নিয়ে সংলাপ বলুন, আমি ভাবছি সূর্যের আলো তো বাইরে, কী লাইট নেব? শুরুর দিন ভুলি না আমি। আমি মনিটর অবধি কম দেখি। একমাত্র কমার্শিয়াল গান থাকলে দেখি। সব কিছুর জন্যই তো লোক আছে। তাই না?
প্রশ্ন: ‘ড্রাকুলা স্যার’ ছবিতেই কি এই জুটি থেমে যাবে?
অনির্বাণ: আমি মিমির সঙ্গে আরও কাজ করতে চাই। আশা করি পরিচালক-প্রযোজকদের কাছেও এই কথা পৌঁছবে। আর এই ছবির ইউনিটটা এক্কেবারে পরিবারের মতো ছিল। এই যেমন কাকিমা, জ্যাঠা। কেউ তোয়ালে বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ স্টু করে খাওয়াচ্ছে। মিমিও এই পরিবারের লোক হয়ে উঠেছিল। আর একটু কাজ করুক এই জুটি...
মিমি: একদম তাই। আমি জানি, অনির্বাণ আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অ্যাসেট। ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে চাপ হবে। সে সব কিছুই হয়নি। আমি দূর থেকে অভিনয় দেখতে ভালবাসি। সৌমিত্র জেঠুর অভিনয় দেখতাম যেমন, কী ভাবে কী করছেন! তেমনই আমার শট না থাকলে এই ছবির ফ্লোরে অনির্বাণের অভিনয় দেখেছি। আর ও খুব ভাল অবজার্ভার। দেবালয়কে যে ভাবে অবজার্ভ করেছে!
ছবির একটি দৃশ্যে অনির্বাণ
প্রশ্ন: একটু বলুন না কেমন দেখেছেন দেবালয়কে?
অনির্বাণ: দেবালয় এক জন ড্রিমার। এই ছবিতে একটা বরফ পরার দৃশ্য আছে। সেই সময় দেখি ও পরিচালকের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাঁ করে ওই দৃশ্যটা দেখছে। হয় না, এক জন পরিচালক একটা স্বপ্নকে ঘটাতে পেরে আবিষ্ট হয়ে পড়েছে। এই ইন্ডাস্ট্রি ছোট ছোট রিসোর্স নিয়ে কাজ করে। তার মাঝে কোনও পরিচালক যদি স্বপ্নকে দৃশ্যে এনে ফেলতে পারে তার মধ্যে যে শান্তি! মনে হয় না, সে বাড়িতে গিয়ে বলবে, ‘মা এ বার ভাত দাও, খাবো’, মনের শান্তি!
প্রশ্ন: অনির্বাণ, খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আপনার ‘ড্রাকুলা স্যার’ করতে গিয়ে...
অনির্বাণ: হ্যাঁ। আনন্দবাজার ডিজিটাল যখন শুট কভার করতে এসেছিল সে দিন আমার অ্যাসাইলামের দৃশ্য ছিল। আমি প্রায় কিছুই বলতে পারিনি!
প্রশ্ন: কেন?
অনির্বাণ: ফিজিক্যাল স্ট্রেস তো ছিলই, তবে সেটা একটানা অভিনয়ে হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এই ছবি করতে সবচেয়ে বেশি মানসিক স্ট্রেসের সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের তো বাইরে থেকে নেওয়ার কিছু নেই। নিজেদের মধ্যে থেকেই খুঁড়ে বের করতে হয়। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, ‘‘ইয়ে ক্যারেক্টারস যিতনা দেতা হ্যায় উসসে যাদা লেতা হ্যায় আপ সে!’’ ড্রাকুলা স্যারের চরিত্র তেমন। এই চরিত্র এমন যা আমার থেকে অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছে। ‘ড্রাকুলা স্যার’ করার আগে আমি যে মনুষটা ছিলাম, সেই মানুষটা আর কোনও দিন হতে পারব না। কী বলব আর! (চুপ করে গেলেন অনির্বাণ)
প্রশ্ন: স্যার কী করে ড্রাকুলা হলেন?
অনির্বাণ: মানুষের মধ্যে অ্যাবনর্মালিটি থাকলেই আমরা সেটা নিয়ে আগে কথা বলি। কালো, বেঁটে, মোটা, কানা, কালা ইত্যাদি। এখানে এক জন শিক্ষক, তাঁর সামনে দুটো দাঁত। সেই নিয়ে গল্প। ছাত্ররা সামনে না হলেও পেছনে তাকে নিয়ে বলছে।
মঞ্জরীর চরিত্রে মিমি চক্রবর্তী
প্রশ্ন: এটা কি ভয়ের ছবি?
অনির্বাণ: নাহ, এটা ভালবাসার ছবি!
প্রশ্ন: দর্শক হলে যাবেন এই ছবি দেখতে?
মিমি: বাংলা ছবি পুজোর মধ্যে আসবে এটা ঐতিহ্যের মতো হয়ে গিয়েছে। এই অতিমারির সময়ে সিনেমা হলে বাংলা ছবি এল কিন্তু! সব সময় হিন্দি-বাংলা ছবি একসঙ্গে রিলিজ করলে বাংলা ছবিকে একটু কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই ভাগাভাগি নিশ্চয় বদলাবে। কুড়ি মাস বাদে কাজে ফিরছি। কেউ বলেছিল, মিমি আর কাজ করবে না। কেউ বলেছিল, মিমি কাজ পাচ্ছে না। অনেক শুনেছি। সব কিছুর উত্তর নিয়ে এ বার পুজোয় আমার ‘এস ও এস কলকাতা’ আর ‘ড্রাকুলা স্যার’ আসছে। ৫০ শতাংশ কম দর্শক সংখ্যা নিয়েও আমাদের প্রযোজক এই ছবি হলে নিয়ে এলেন। চাইলে ওটিটি বা স্যাটেলাইটে বিক্রি করে দিতে পারতেন। মানুষও নিশ্চয় সামাজিক দূরত্ব মেনে হলের নতুন নিয়মে এসেই ছবি দেখবেন। পুজো মানেই পজিটিভিটি!
অনির্বাণ: আমি মানুষের দীর্ঘ দিনের লিভিং-এর উপর ভরসা করতে পারি। অতিমারি মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা করেছিল। অথচ আমাদের ইন্ডাস্ট্রি চলে মানুষের পারস্পরিক ভরসায়। অতিমারি চলবে। কিন্তু মানুষের এই পারস্পরিক নির্ভরতার ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি। তাই এই অভ্যাস মুছবে না। থাকবে। আমি জুন মাস থেকে কাজ করছি। নিয়ম মেনে কাজ করছি। আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি এই ভাইরাস বিষয়বস্তু খুব জটিল ব্যাপার। এ নিয়ে ভেবে আমরা কিছু করতে পারব না। বুঝেছি, এই অতিমারিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন ভাল রাখা। ভয় পেতে পেতে আমরা এমন একটা জায়গায় চলে না যাই যেখানে অতিমারি চলে গেল, কিন্তু আমি ভয় পেয়ে যাচ্ছি। সেই কারণেই সিনেমা আর থিয়েটারের হল খোলাকে পজিটিভ বলে মনে করছি। মানুষ নিজের ইচ্ছায় নিরাপত্তা মেনেই যাবেন।আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এটা মেন্টাল ইমিউনিটি বাড়াবে। সিনেমাকে এন্টারটেনমেন্ট মেডিসিন হিসেবে দেখার সময় এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy