Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বক্স অফিসের কথা ভাবলে ‘গুলাবো সীতাবো’ বানাতামই না, লিখলেন সুজিত সরকার

‘গুলাবো সিতাবো’-তে কি ধার কমে গেল? ‘ভিকি ডোনার’ বা ‘পিকু’র থেকে তফাৎ কোথায়? আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য কলম ধরলেন সুজিত সরকার ‘গুলাবো সিতাবো’-তে কি ধার কমে গেল? ‘ভিকি ডোনার’ বা ‘পিকু’র থেকে তফাৎ কোথায়? আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য কলম ধরলেন সুজিত সরকার

ছবির একটি দৃশ্যে বিগ-বিকে শট বোঝাচ্ছেন পরিচালক সুজিত সরকার। নিজস্ব চিত্র।

ছবির একটি দৃশ্যে বিগ-বিকে শট বোঝাচ্ছেন পরিচালক সুজিত সরকার। নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২০ ১৭:৫৯
Share: Save:

একটু আগের একটা ফোন এসেছিল। ‘‘আরে সুজিত, আমার ফ্যানেরা বলছে ‘গুলাবো সীতাবো’ ছবিতে আমি তো নেই! তুমি তো জানো আমার কত ফ্যান। মীর্জাকে অমিতাভ বচ্চন বলে কেউ চিনতে পারছে না! এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম। এটাই আমাদের জয়।’’ খুব হাসলাম আমরা। আমার স্যরের ফোন ছিল— অমিতাভ বচ্চন। আমার বন্ধুবান্ধব কি পরিবার, সকলেই জানে রাতে আমার ফোন এনগেজড থাকা মানে ‘স্যর’-এর সঙ্গে কথা চলছে। কোন সিনটা কেমন হল, কোন সিনটা আর একটু বেটার করা যায় বা ছবি মুক্তির পর ছবি নিয়ে কথা।

অনেকে বলছেন ‘গুলাবো সীতাবো’ স্লো ছবি

এ বার দেখছি ‘গুলাবো সীতাবো’নিয়ে খুব আলোচনা, সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগে অনেক মানুষ নিজেই ছবি নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, ‘ভিকি ডোনার’আর ‘পিকু’-র সুজিত সরকারের গতি এই ছবিতে নেই।না, নেই।এই ছবি ‘পিকু’-র সুজিত সরকার তৈরি করেনি। ‘পিকু’প্রচুর মানুষ দেখেছেন। বাজারেও ভাল রেজাল্ট করেছে। ওই ছবিতে ‘ভাল’ছবির গন্ধ রয়েছে। তাতে কী? পরিচালক সুজিত সরকার তো জানে ‘পিকু’-তে সে কত ভুল করেছে! না, এই ছবি ‘ভিকি ডোনার’-এর পরিচালক সুজিতও বানায়নি। সে ছিল তখন বড় চঞ্চল। থামতে চাইত না। তার সেই অস্থিরতা ধরা আছে ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ছবিতে। কিন্তু বক্স অফিসে সাফল্য পাওয়া এই ছবি থেকেও অনেক দিন ধরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে পরিণত সুজিত।

লোকে ভুলে গেল ‘ভিকি ডোনার’-এর সুজিত ‘অক্টোবর’বানিয়েছিল?

আজ লোকে বলছে, সুজিতের বয়স হয়েছে তাই তার ধার কমেছে।সিনেমা গতির ধার ধারে না।আর বয়স সুজিতের ভাবনায়, পরিণত মনে। ‘গুলাবো সীতাবো’সুজিতের স্থিতির ছবি।যাঁরা এত ‘পিকু’আর ‘ভিকি ডোনার’-এর সুজিতের কথা বলছেন, তাঁরা কি‘অক্টোবর’-এর সুজিতকে ভুলে গেলেন? লোকে ভাবে বরুণ ধবন মানেই নাচবে, লাফাবে। ‘অক্টোবর’-এ যে বরুণ ধবন তাঁকে অনেকে তো দেখতে যেতে চায়নি। তবুও তো দেখলাম বক্স অফিসের নিরিখে ‘অক্টোবর’ভাল ব্যবসা করেছিল। তবে ওই ছবি থেকেই আমার ছবির গতিকে আমার মতো করে সাজাতে থাকি আমি। শুনেছি অনেকেই বলেছেন‘অক্টোবর’স্লো ছবি। আবার আশ্চর্যজনক ভাবে এই লকডাউনে প্রচুর মানুষের ফোন পেয়েছি। টেকস্ট মেসেজ এসেছে ‘অক্টোবর’নিয়ে। তাঁরা লিখেছেন, ‘ইশ! আগে কেন হলে গিয়ে ‘অক্টোবর’ দেখিনি?’মানুষ এখন ‘অক্টোবর’দেখছেন।

‘গুলাবো সীতাবো’-র ট্রেলর দেখে ভেবেছিলেন এ বুঝি ‘পিকু’বা ‘ভিকি ডোনার’পার্ট-২...

তাই এ বার চেয়েছিলাম আর একটু চ্যালেঞ্জ বাড়াতে। ‘ভিকি ডোনার’-এর চেয়ে ‘অক্টোবর’-এ ভুল কমেছে। আর ‘গুলাবো সীতাবো’-তে সুজিত সবচেয়ে কম ভুল করেছে। ন্যারেটিভের সঙ্গে লেগে থাকা এক গল্প বলেছে ধীরে। তার বাইরে বেরিয়ে আর কিচ্ছু নয়। এটাই ছিল আমার চ্যালেঞ্জ। সুজিতের কাছে যা দেখে দর্শক অভ্যস্ত, সুজিত তার বাইরে নিয়ে যেতে চায় তার দর্শককে। অনেকেই ‘গুলাবো সীতাবো’-র ট্রেলর দেখে ভেবেছিলেন, এ বুঝি ‘পিকু’বা ‘ভিকি ডোনার’পার্ট-২। এরকম অনেকেই বলেছেন আমায়। সেখান থেকে ছবি দেখলে ‘গুলাবো সীতাবো’বুঝতে অসুবিধে হবে।তবেএই ছবি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে চারদিকে। এ ছবি বিপুল ভাবে সাড়া ফেলেছে। ভাল লাগছে। যেমন ভাল লেগেছে এই প্রথম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মতো সংবাদপত্রে আমার ছবির কথা লেখা হয়েছে।

বক্স অফিসকে পাত্তা দিলে সুজিত ‘গুলাবো সীতাবো’কোনও দিন বানাতে পারত না!

আমি জানি, হিন্দি ছবিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাজারের নিরিখে দেখা হয়। আমায় একজন সাংবাদিক অনুরোধ করছিলেন, আমি নিজে যদি ‘ভিকি ডোনার’, ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’, ‘পিকু’, ‘অক্টোবর’আর ‘গুলাবো সীতাবো’-র একটা রিপোর্ট কার্ড তৈরি করি। এ কি সম্ভব? যে-আমি আজ পর্যন্ত বক্স অফিসকে পাত্তাই দিইনি সে এ সব কী করে ভাববে? বক্স অফিসকে পাত্তা দিলে সুজিত সরকার ‘গুলাবো সীতাবো’বানাতেই পারতো না। এই ছবি বক্স অফিস আমাকে বানাতেই দিত না। আসলে ছবির ‘পেস’নিয়ে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং একেবারেই আলাদা। বক্স অফিস নয়, ক্রাফ্টের দিক থেকে আমার ছবিকে দেখি আমি। ‘পিকু’জনপ্রিয়। যেমন ‘ভিকি ডোনার’। আমি তো বলছি না, ওই ছবিগুলো আমি বানাইনি। তবে শিল্পের দিক থেকে সুজিত সরকার কিছু ভুল করেছে ওই ছবি দুটোয়। আমার কাছে বাজার নয়, শিল্প আগে। আমি শিল্প নিয়ে না ভাবলে পরের ছবির কথা ভাবব কী করে? এই যে বললাম, এখন লোকে ‘অক্টোবর’দেখছে। তা হলে? দর্শক তো শুধু শনিবার-রোববারের নয়। দর্শক আজীবনের। কখন ছবি দেখে নেবে, সেটা পছন্দ করবে, তা কিছু সময় ধরে বলা যায় না। তবে সবচেয়ে পরিণত সুজিতকে খুঁজতে হলে ‘গুলাবো সীতাবো’-র মধ্যেই পাওয়া যাবে।

প্রথমবার ‘পথের পাঁচালী’দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম

আমি সত্যজিৎ রায়ের‘পথের পাঁচালী’দেখি বাবার সঙ্গে।ঘুমিয়ে পড়ি। আবার স্কুল থেকে দেখতে যাই। সে দিন কেউ হলে ছিল না। আর থিয়েটার করার সময় যখন দেখি তখন জীবনটাই বদলে যায়। তা হলে ছবির রিপোর্ট কার্ড নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি করব কী করে? এই ছবির ক্রেডিট কার্ড লেখার সময় ভেবেছিলাম সত্যজিৎ রায়কে ট্রিবিউট দেব। কি মনে হল দিলাম না।তবে আমার প্রোডাকশনকে বলেছিলাম উনি ‘শতরঞ্জ খিলাড়ি’-র সময় যে হোটেলে উঠেছিলেন আমিও সেই হোটেলে থাকব। তাই থেকেছি। রোজ সকালে শুটে যাওয়ার সময় অভীকদাকে (অভীক মুখোপাধ্যায়)বলতাম, ‘‘দেখ এ ভাবেই এই পথ দিয়ে সত্যজিৎ রায় ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র শুটে যেতেন।’’ অমিতাভ বচ্চন, আমার স্যর তো ওই ছবিতে ভয়েস ওভার দিয়েছিলেন।

এই লুকে অমিতাভকে চেনাই দায়!

আমি কোনও অভিনেতাকে ডিরেক্টরের সামনে এই রকম সারেন্ডার করতে দেখিনি।

আমি আর আমার স্যর।১৭ বছর ধরে এই মানুষটাকে দেখছি। বিজ্ঞাপনের শুটিং দিয়ে শুরু। তার পর ‘শ্যুবাইট’, এখন ‘পিকু’— একটা ব্যাপার ওঁকে দেখলেই মনে হয় আজকাল—যত বয়স বাড়ছে, উনি যেন তত ভাল অভিনেতা হয়ে উঠছেন!

আমাকে হয়তো উনি খুব বেশি স্নেহ করেন তাই আমার কাছে উনি ওপেন আপও করেন অনেকটা। কিন্তু জীবনের সূক্ষ্ম আবেগ কী ভাবে অভিনয়ে ইনকরপোরেট করা যায় সেটা ওঁর থেকে ভাল বোধহয় কেউ জানেন না! বলে বোঝাতে পারব না।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ‘পিকিং দ্য ব্রেন’,আমি কিন্তু স্যরের সঙ্গে এগজ্যাক্টলি তা-ই করি।

‘শক্তি’র ক্লাইম্যাক্সের শুটিংয়ের আগে ওঁর মনের অবস্থা কী ছিল, ‘দিওয়ার’-এর ওই সব হাই ইনটেনসিটি সিনগুলোর আগে ওঁর পড়াশোনা কী ছিল— ওঁর কাছে প্রশ্নের কোনও সীমা নেই আমার।বহু দিন জানতে চেয়েছি, বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির অন্যতম সেরা পরিচালক মনমোহন দেশাই মানুষটা কেমন ছিলেন। এবং আমি ধন্য, আমার প্রত্যেকটা প্রশ্নের উনি ধীর-স্থির ভাবে জবাব দিয়েছেন। এগুলো আমার জীবনের সেরা উপলব্ধি তো বটেই। তবে এত আলোচনার পর এটাও বুঝেছি, অমিতাভ বচ্চন ইজ আ কমপ্লিটলি ডিরেক্টর’স অ্যাক্টর। আমি কোনও অভিনেতাকে ডিরেক্টরের সামনে এই রকম সারেন্ডার করতে দেখিনি।

ভিকি ডোনারএবং ম্যাড্রাস ক্যাফেদেখে স্যর আমাকে হাতে লেখা কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন!

‘গুলাবো সীতাবো’-র সময় মির্জার চরিত্রে যখন অমিতাভ বচ্চনকে ভাবছি তখন কিন্তু ভাবিনি যে আমি বলব আর উনি রাজি হয়ে যাবেন। বরং ওঁকে চিত্রনাট্য শুনিয়ে বলেছিলাম, ‘‘স্যর, সুইডেন থেকে যে মেক আপ ডিজাইনার আসবে তাঁর মির্জার মেক আপ করতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। লখনউয়ে শুট। জুনের গরমে। আপনি কি করতে চাইবেন?’’ স্যর তো লাফিয়ে উঠলেন। যতবার বলি শুটটা বরং ডিসেম্বরে করি, গরমে কষ্ট হবে। সে শুনবে না! বললেন, ‘‘তোর যদি অসুবিধে না থাকে আমি জুনেই শুট করব।’’ বলে নিয়েছিলাম ওঁকে, নিচু হয়ে ঝুঁকে হাঁটতে হবে। উনি রাজি। গরমে শুট চলছে। ওঁর শট নেই। বলছি মেকআপ রুমে যান। উনি ঠায় অমন ঝুঁকে, ওই মেকআপ করে দাঁড়িয়ে আছেন!

আমার আগের ছবিগুলো, ‘ভিকি ডোনার’ এবং ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ দেখে উনি আমাকে হাতে লেখা কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো আমি আমার অফিসে টাঙিয়ে রেখেছি। আমার কাছে ওর থেকে বড় সার্টিফিকেট আর কিছু হতে পারে না জীবনে।এবং এত দিন ওঁর সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি, কাজ ছেড়ে উনি থাকতে পারবেন না। আমার তো মনে হয়, কাজ না করলেই ওঁর শরীর খারাপ হয়।

ওঁকে জীবনীশক্তি জোগায় স্টুডিয়োর ফ্লোরগুলো... ওই হইহট্টগোল... ওই ধুলো... ওই চেয়ার... ওই চায়ের কাপগুলো। আর ওঁকে অক্সিজেন জোগায় ক্যামেরাটা।

আর আমি ছবি বানিয়ে চলি...

অন্য বিষয়গুলি:

Shoojit Sircar Amitabh Bacchan Gulabo Sitabo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy