পরিচালক সুজিত সরকার। ছবি: সংগৃহীত।
বিগত কয়েক দিনে বাংলা সিনেমার মান নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া চলেছে। পরিচালক সুজিত সরকার জন্মসূত্রে বাঙালি, ছবি তৈরি করেন হিন্দিতে। তবু মুম্বইয়ে নাকি তাঁকে লোকে চেনেন বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে। তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে রয়েছে নানা ধরনের গল্প। কখনও রাজনীতি, কখনও ইতিহাস। কখনও আবার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনই হয়ে উঠেছে ছবির বিষয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে এবং বিগত কয়েক দিন বাংলা ছবিকে নিয়ে যে নিন্দেমন্দ চলছে তাতে কি তিনি আহত? সতীর্থ অনুরাগ কাশ্যপের ‘ঘটিয়া’ মন্তব্যের সঙ্গে কি আদৌ সহমত? পরবর্তী ছবির পরিকল্পনা থেকে কলকাতার ভোটের উত্তাপ, আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি পরিচালক সুজিত সরকার।
প্রশ্ন: এক দিকে শহরে বসন্ত, অন্য দিকে ভোটযুদ্ধের ঘোষণা, কোনটা বেশি উপভোগ করেন?
সুজিত: আমি ভোটের সময়ে ভোটটা দিয়ে পালিয়ে যেতে চাই। চারদিকে এত মাতামাতি এ সব নিয়ে। এত কিছু চলছে দেখি। আমি একটু শান্ত থাকতে পছন্দ করি। আমার কাছে বসন্তের আগমনটাই অনেক বেশি উপভোগ্য।
প্রশ্ন: ভোট এলেই তো ঝাঁকে ঝাঁকে অভিনেতা নেতা হয়ে যান, এই প্রবণতাটা দেখে কী মনে হয়?
সুজিত: আসলে আমার এই বিষয়ে তেমন বক্তব্য নেই। যাঁর যেটা ইচ্ছে করেন। রাজনীতিতে যে যা খুশি করুন। আমার রাজনীতি আমার ছবি।
প্রশ্ন: সুজিত সরকারের ছবিতে বিভিন্ন সময়ে কলকাতার একটা বড় ক্যানভাস উঠে এসেছে। এই শহরে আপনার প্রিয় জায়গা কোনটা?
সুজিত: বাগবাজার ঘাট আমার সবথেকে প্রিয় জায়গা। আসলে একটা সময়ে কলকাতায় ছিলাম। তার পর দিল্লি চলে যাই। আবার যখন ফিরে এলাম, তখন নতুন করে কলকাতার সঙ্গে পরিচয় হল। সেটা তা-ও বছর ১৫ আগেকার কথা। তখন থেকে বার বার বাগবাজার ঘাট আমাকে টেনেছে। মনখারাপ হলে চুপচাপ ওখানে গিয়ে বসে থাকতাম। প্রচুর চিত্রনাট্য নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ওখানে বসেই করেছি।
প্রশ্ন: তালিকায় কোন কোন ছবি রয়েছে?
সুজিত: ‘ভিকি ডোনার’, ‘পিকু’, ‘মাদ্রাস ক্যাফে’, ‘অক্টোবর’ ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরুটা ওখান থেকেই। ওখানে একটা বিশাল বট গাছ আছে। তার নীচে বসে চুপচাপ চা খাই। কেউ গঙ্গায় স্নান করছেন, কেউ পুজো করছেন। মনটা একটা অন্য জগতে চলে যায়। আসলে আমার ওখানকার মানুষের রোজনামচা দেখতে ভাল লাগে।
প্রশ্ন: আপনি নিজে ব্যারাকপুরের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, জায়গাটার একটা ইতিহাস রয়েছে। ছবি করার ইচ্ছে হয়নি কখনও?
সুজিত: হ্যাঁ, বহু বার ভেবেছি। আমি আমার প্রতিটা ছবি শুরুর আগে ব্যারাকপুরে গিয়ে রেইকি করে আসি। বেশ কিছু জায়গাও দেখে এসেছি। ‘সর্দার উধম’-এর সময়ও ভেবেছিলাম ব্যারাকপুরে শুটিং করব। শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি। ইছাপুর, পলতা, নবাবগঞ্জ, রাইফেল ফ্যাক্টরির জায়গাগুলো মনে বসে আছে আমার। ওই জায়গা নিয়ে ছবি করলে অবশ্যই ‘পিরিয়ড ফিল্ম’ করব। ওখানকার আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলো এখনও আগের মতোই আছে।
প্রশ্ন: বাংলা সিনেমার বাজার যে খুব ছোট তেমন নয়। তবু প্রতিনিয়ত বাংলা সিনেমা ও তার মান নিয়ে সমালোচনা, নিন্দে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পরিচালকদের আশু কতর্ব্য কী?
সুজিত: ঋতুদা (পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ) বেঁচে থাকতে এই বিষয়ে আমরা অনেক আলোচনা করতাম। ঋতুদার সময় আমরা বাংলা ছবি জাতীয় স্তরে মুক্তি পেতে দেখেছি। সেই ছবিগুলো নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হত। কিন্তু ঋতুদা চলে যাওয়ার পর হঠাৎই বাংলা ছবি নিয়ে জাতীয় স্তরে চর্চা কমে যায়। আমি কিন্তু কখনই রিমেক ছবিকে এর মধ্যে ধরছি না। কারণ আমি অরিজিনাল গল্প দেখতে ভালবাসি। আসলে ঋতুদা চলে যাওয়ার পর বাংলা ছবি এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে গিয়েছে। জাতীয় স্তরে পরিচালক হিসেবে ঋতুদার যে দাপট ছিল আমি বাঙালি হয়ে সেটা মিস্ করি।
প্রশ্ন: তা হলে বলছেন বাংলা ছবির পরিচালক নির্মাতাদের দাপট কমেছে?
সুজিত: ছবি তৈরি হচ্ছে না এমন নয়। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি অন্য ধারার ছবিও তৈরি হচ্ছে। যার মধ্যে কিছু ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যাচ্ছে, কিছু ছবি জাতীয় পুরস্কারও পাচ্ছে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এর ব্যাপ্তি। একটা মালয়লম ছবি কিংবা কন্নড় ছবি বেশি দেখা হচ্ছে। কিন্তু তুলনায় বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা কম হচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন: ‘ওপেন টি বায়োস্কপ’-এর পর আর কোনও বাংলা ছবির সঙ্গে যুক্ত হলেন না কেন?
সুজিত: আসলে ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’-এর পর আমি বেশ কিছু ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে বসেছিলাম। তার পর আর হয়নি। তবে আমি করব আবার। প্রযোজনা তো নিশ্চই করব।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনার সতীর্থ কলকাতায় এসে দাবি করেছেন, বাংলা সিনেমার পতন হয়েছে, একটি বিশেষণও ব্যবহার করেছিলেন। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কতটা সহমত?
সুজিত: আসলে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের সময়টা শুধু বাংলা সিনেমা নয়, ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগ ছিল। ৫০ এর দশক থেকে শুরু করে ৮০ এর দশকের সময়টা। সেই সময় শুধু পরিচালক বা সঙ্গীতশিল্পী নন, সিনেমার প্রতিটা ক্ষেত্রে বাঙালিরা দাপট দেখিয়েছে। সেটা কমতে শুরু করল। কিন্তু তার মানে এটা বলছি না যে এখন যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের প্রতিভা কম। আমি জানি অনুরাগ (পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ) যেটা বলেছে। আসলে অনুরাগ অনেক সময় ‘এক্সট্রিম’ বলে ফেলে। কলকাতায় আসার আগে ওকে ফোনও করেছিলাম। যে হেতু আমি দেশে ছিলাম না, তাই এখানে আসার আগে কথা হল। জিজ্ঞেস করলাম যে এ রকম কথা কেন বলেছিস। ও তখন বলল, যেমন ছবি ও দেখতে চায় তেমন ছবি দেখতে পাচ্ছে না। আর সেই আক্ষেপ থেকেই ওর এ হেন মন্তব্য।
প্রশ্ন: বাঙালি হিসেবে বাংলা ছবির বর্তমান অবস্থা দেখে চিন্তা হয়?
সুজিত: হ্যাঁ, চিন্তা তো হয়। আমি মধুজা মুখোপাধ্যায়ের ‘ডিপ সিক্স’ ছবিটা প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটা দেখানো হয়। কিন্তু ছবিটার মুক্তি নিয়ে চিন্তায় আছি। কতগুলো হল পাবে। কত জন দর্শকই বা দেখবেন। এই চিন্তাগুলো ঘুরতে থাকে মাথায়। যখনই চিন্তা আসে তখন মনে হয়, ঋতুদা বাংলা সিনেমার শেষ ‘ফ্ল্যাগশিপ’। তাঁর রাস্তায় হাঁটতে পারলে মনে হয় সেই গৌরব ফিরে পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন: জুরি বোর্ডে দু’জন বাঙালি থাকা সত্ত্বেও আপনার ছবি ‘সর্দার উধম’ অল্পের জন্য অস্কারে মনোয়ন পায়নি। কী অনুভূতি হয়েছিল?
সুজিত: এই ঘটনাটা আমার কাছে খুব বেদনাদায়ক। আমি ভেবেছিলাম এই ছবিটাকে বেছে নেওয়া হবে। কারণ ছবির বিষয়টাই সে রকম ছিল। জুরিরা যা ভাল বুঝেছেন, সেটাই করেছেন। তবে পরে জুরি বোর্ডের সভাপতি নিজে আমায় ফোন করেছিলেন। আমি ওঁকে আশ্বস্ত করি যে আমার কারও উপর কোনও ক্ষোভ নেই। এই ছবিটার একটা উচ্চতায় পৌঁছনোর যোগ্যতা ছিল। পরে ওটিটিতে মুক্তি পাওয়ার পর অনেকে বিদেশি সমালোচকরা রিভিউ করেছেন। প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ওই, যা হয়ে গিয়েছে তা তো বদলে ফেলা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: আপনার ছবিতে বাঙালি নারী চরিত্র দেখা গিয়েছে বার বার। কখনও টলিউডের কোনও নায়িকাকে নির্বাচন করেননি কেন?
সুজিত: (বেশ কিছুক্ষণ ভেবে) আসলে মনে হয়নি। ‘পিকু’র জন্য দীপিকা ছাড়া কাউকে ভাবাই যেত না। তবে কথা দিচ্ছি আমি আমার ছবিতে বাংলার নায়িকাদের সুযোগ দেব।
প্রশ্ন: সুজিত সরকারের ছবির নায়িকা হওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও মাপকাঠি আছে?
সুজিত: আমার কাস্টিং করার পদ্ধতিটা খুব সোজা। আমি এমন অভিনেতাকে খুঁজি, যিনি আমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে পারবেন। খুব বেশি প্রশ্ন করবেন না। আমি নিশ্চয়ই তাঁর জন্য ভাল কিছু ভেবেছি। সুজিতের নদীতে একসঙ্গে বয়ে যাই, দেখা যাক কত দূর যাওয়া যায়। ছবিটা বক্স অফিসে ভাল করল না কি খারাপ ফলাফল করল তাঁর চিন্তা নয়। আমরা ওই প্রসেসটার মধ্যে বয়ে যাব। জীবনে নতুন কিছু একটা শিখব।
প্রশ্ন: সম্প্রতি ‘জোরম’ ছবির পরিচালক দেবাশিস মাখিজা জানিয়েছেন ছবিটা তৈরি করতে গিয়ে তিনি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন। সিনেমা কি শিল্প, না কি অর্থ উপার্জনটাই মূল লক্ষ্য?
সুজিত: সিনেমা শিল্প। সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ কী ভাবে বানিয়েছিলেন, সেই গল্প সকলের জানা। আমি আমার শিল্পীসত্তাকে এগিয়ে রাখি, তার পর অর্থ। তবে সৌভাগ্যবশত আমি এই দুইয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমার ছবিগুলো বক্স অফিস কালেকশনের মুখ দেখেছে। প্রযোজকদের আর্থিক ক্ষতি হতে দেয়নি। এই দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধেই রাখি। পরিচালক হিসেবে আমার মনে হয়, যিনি ভরসা করে আমার চিন্তা, পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করছেন, তাঁর অর্থ ফিরিয়ে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। সেই বিশ্বাসের জায়গাটা পরিচালকেই অর্জন করতে হয়। আমার মনে হয় উনি (দেবাশিস মাখিজা) যে ছবিটা বানাতে পেরেছেন এবং আমরা যে ছবিটা নিয়ে কথা বলছি সেটাও তো একটা প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: আপনি বচ্চন পরিবারের ঘনিষ্ঠ। এতগুলো বছরে মিষ্টার বচ্চনের থেকে জীবনের কোন পাঠটা শিখলেন?
সুজিত: উনি আসলে ১৪ বছরের কিশোর। একটা ১৪ বছরের ছেলের যেমন আগ্রহ ও কৌতূহল থাকে, মিস্টার বচ্চনের মধ্যে সেটাই দেখতে পাই। ওঁর কাছ থেকে নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ের সদ্ব্যবহার শেখার মতন। নিজেকে বিন্দুমাত্র অবসর যাপনের সময় দেন না। প্রতিনিয়ত কাজে ডুবে আছেন। উনি কারও কথা শোনেন না। পরিবারের সদস্যেরাও নিষেধ করেন। কিন্তু উনি নিজের মর্জি মতোই কাজ করে থাকেন।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির সংখ্যা বেড়েছে। অন্য ধারার ছবির পরিচালকদের জন্য কি পরিস্থিতি ক্রমশ কঠিন হচ্ছে?
সুজিত: আমি শেষ ‘সর্দার উধম’ পরিচালনা করেছি। এক জন বিপ্লবীর গল্প, যেখানে ঔপনিবেশিকতার দিকটা তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। আমি তো করতে পারছি, আগামী দিনেও করব। আসলে পুরো বিষয়টাই নির্ভর করে পরিচালকের মননের উপর। আমি মনে করি যে কোনও গল্প বলার ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্যের প্রয়োজন। আর সেটা নির্ভর করে পরিচালকের বুদ্ধিমত্তার উপর।
প্রশ্ন: আপনার পরবর্তী ছবিতে অভিষেক বচ্চন রয়েছেন।
সুজিত: হ্যাঁ, অভিষেককে নিয়ে ছবি করছি। খুব সাধারণ ছবি। সাধারণ মানুষের সাধারণ গল্প। বলতে পারেন ‘স্লাইস অফ লাইফ’। একটা আবেগপ্রবণ সফর হতে চলেছে। এর বেশি এখনই কিছু খোলসা করতে চাইছি না।
প্রশ্ন: প্রত্যেক বার কলকাতা থেকে ফেরার সময়ে সঙ্গে কী নিয়ে ফেরেন?
সুজিত: (হেসে) কলকাতায় এলে লোকে তো মিষ্টি খোঁজে। আমি খুঁজি কলমি শাক। মুম্বইয়ে খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই কলকাতা থেকে ফেরার সময় কলমি শাক নিয়ে যাই।
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy