মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘কাবুলিওয়ালা’র পরিচালক সুমন ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনার ছবিগুলো দেশ-বিদেশের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে আপনাকে দেখা যায় না কেন?
সুমন: আমায় তো কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ডাকা হয় না। আমি এখানে থাকি না বলে বোধহয়। তবে আমি গিয়েছি কয়েক বার। ছোটবেলায় বেশি যেতাম। আমার ছবি ‘সার্চিং ফর হ্যাপিনেস’ দু’বছর আগে দেখানো হয়েছে।
প্রশ্ন: মুঠোফোন আসায় গোষ্ঠীগত ভাবে সিনেমা দেখার চল এখন প্রায় উঠেই যাচ্ছে। বর্তমান সময় বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব কতটা প্রাসঙ্গিক বলে আপনার মনে হয়?
সুমন: একটি চলচ্চিত্র উৎসবে গেলে অনেক রকমের ছবির দেখার সুযোগ হয়। তার চেয়েও বড় কথা, অনেক দেশের পরিচালক বা কলাকুশলীর সঙ্গে আলাপ হয়। সেটার একটা অন্য রকম উন্মাদনা তৈরি হয়। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে এখন আর সে অর্থে আন্তর্জাতিক স্তরের চলচ্চিত্র উৎসব ধরা হয় না। তবে বিশ্বের বাকি বড় উৎসবগুলো অবশ্যই এখনও প্রাসঙ্গিক।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সারা ক্ষণ থাকলে অনেক জায়গায় যাওয়ার নানা রকম বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। দূরে থাকেন বলে কি সেই দিক থেকে সুবিধা হয়েছে?
সুমন: ঠিকই। এখানে থাকলে নানা রকম রাজনীতি, এই ক্যাম্প-সেই ক্যাম্পের মধ্যে জড়িয়ে যেতে হয়। আমি অবশ্য এখানকার সংস্কৃতির সমালোচনা করতে চাই না। শুধু এখানে এসে ছবি করে আবার ফিরে যেতে চাই। বাইরে তো আমার প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেল।
প্রশ্ন: বার বার বাইরে থেকে এসে কাজ করতে অসুবিধা হয় না?
সুমন: প্রথম দু’-তিনটে ছবিতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। এখন নিজের একটা টিম তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওরা জানে আমি কখন আসব, তার আগে কী কী কাজ করে রাখতে হবে। তাই এখন আর খুব একটা সমস্যা হয় না
প্রশ্ন: আপনি সময় নিয়ে ছবি করায় বিশ্বাসী। এখানে এখন ১০-১২ দিনে একটা ছবির শুটিং শেষ করতে হয়। তেমন কড়া নিয়ম আপনার উপর চাপালে মেনে নেবেন?
সুমন: আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, ছবি করা আমার জীবিকা নয়। তাই কখনও যদি মনে হয় খুব কড়া নিয়মের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে, তা হলে সেই ছবির কাজটা করব না। বা সেই প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করব না।
প্রশ্ন: এক জন পরিচালক যখন অন্য দেশে গিয়ে কাজ করেন, তখন দুই দেশের সংস্কৃতির একটা মেলবন্ধন অনেকেই ছবিতে আশা করেন। আপনার চিত্রনাট্য লেখার সময় সেটা কখনও মনে হয়?
সুমন: আমি বিদেশে থাকলেও আমার সব ছবির গল্প এখানকার। তাই মনে হয়, একটা অন্য রকম দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। বাইরে থাকার একটা সুবিধা হল, ওখানে আমার বন্ধুরা বিশ্বের নানা দেশের। তাঁদের সাহিত্য, ছবি, শিল্প নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হই। হয়তো সেই কারণেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি একটু অন্য রকম। সেটা বোধ হয় এখানে থাকলে হত না। আমি কিন্তু চিত্রনাট্য ওখানে বসে লিখে ফেলি। তার পর এসে শুধু শুট করি। পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করে চলে যাই।
প্রশ্ন: এখানে যখন আসেন, অন্য পরিচালকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেও কি একই রকম সমৃদ্ধ হন?
সুমন: সকলের সঙ্গে না হলেও কারও কারও সঙ্গে হয়। অতনুদাই (ঘোষ, পরিচালক) একমাত্র যাঁকে আমি আমার সব ছবির চিত্রনাট্য আগে বা পরে পাঠিয়ে মন্তব্য জানতে চাই। আগে অতনুদা আমায় মানা করতেন গল্প অন্যদের দেখাতে। এখানে শুনেছি গল্প নাকি চুরি হয়ে যায়! কিন্তু আমি সে সব পাত্তা দিই না। আমি অতনুদা’র সঙ্গে মায়ামিতে বসেও যোগাযোগ রাখি। সৃজিতের (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে অনেক সময় হয়তো কোনও ছবি দেখে আলোচনা হল। আদিত্য বিক্রমের (সেনগুপ্ত) সঙ্গে মাঝেমাঝে যোগাযোগ হয়।
প্রশ্ন: আপনার কাজে রবীন্দ্রনাথ বার বার ফিরে আসেন।
সুমন: এটা ঠিক সুপরিকল্পিত নয়। কিন্তু এখন দেখলাম, ‘কাদম্বরী’, ‘নোবেল চোর’-এর পর ‘কাবুলিওয়ালা’ আমার তৃতীয় ছবি যেখানে রবীন্দ্র-যোগ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শুধু আমার কাছে নয়, সকলের কাছেই এই সময় বেশি করে প্রাসঙ্গিক। কারণ, পৃথিবী এখন একটা উথালপাথালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেটা ইজ়রায়েল-গাজা হোক, রাশিয়ার যুদ্ধ হোক বা ভারতে এত বেশি ধর্ম-জাতিবিদ্বেষ হোক— সব জায়গায়ই অস্থির পরিস্থিতি। তাই আরও বেশি করে ‘কাবুলিওয়ালা’ করার ভাবনা। ১৮৯২ সালে বসে লেখা একটা গল্প এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক, তা ছবিটা দেখলে বোঝা যাবে। আমি অবশ্য সময়টা ১৯৬৫ দেখিয়েছি। সেটার পিছনে একটা বিশেষ কারণ রয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার ভাবনায় কি বরাবরই মিঠুন চক্রবর্তী কাবুলিওয়ালা ছিলেন?
সুমন: অবশ্যই। উনি প্রথমে নিশ্চিত ছিলেন না ছবিটা করবেন কি না। কারণ, যে চরিত্র বলরা়জ সাহনি এবং ছবি বিশ্বাস করেছেন, তাকে আবার পর্দায় তুলে ধরা যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ। তাই হয়তো ওঁর মনে একটু দ্বিধা ছিল। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম উনি করবেন। মিঠুনদা না করলে আমি ছবিটা করতাম না।
প্রশ্ন: আপনার ক্ষেত্রেও তো এমন একটা ছবি করা যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ?
সুমন: আমি যখন ‘কাদম্বরী’ করেছিলাম তখনও তো সকলে বলেছিলেন, আগে কখনও কোনও ছবিতে রবীন্দ্রনাথকে দেখানো হয়নি। সে সময়ই আমার ভয় লাগেনি। প্রথম নিজেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কোনও বৈগ্রহিক গল্প নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। সেই দায়িত্ব শুধু আমার নয়, গোটা টিমের। সাহসের চেয়ে বেশি জরুরি, আমি নিজে সৎ ভাবে ছবিটা বানাচ্ছি কি না। চার-পাঁচ বছর আগে যখন প্রথম ভাবি ‘কাবুলিওয়ালা’ করব, তখন আমার দুই মেয়ে মিনির বয়সিই ছিল। বাবার হওয়া অনুভূতি একজনকে অনেক বদলে দেয়। আমার মেয়েরা হওয়ার পর এই গল্প আমায় অনেক বেশি প্রভাবিত করে।
প্রশ্ন: কাবুলিওয়ালা এবং মিনির বন্ধুত্বের সারল্য কি এখন পাওয়া সম্ভব?
সুমন: একদম! সময়-কাল-স্থান ছাপিয়ে যায় অনুভূতি। হয়তো রহমত আর মিনি এখন থাকলে হোয়াট্সঅ্যাপে কথা বলত। কিন্তু টানটা চিরন্তন।
প্রশ্ন: ‘নোবেল চোর’-এর পর মিঠুনের সঙ্গে এটা আপনার দ্বিতীয় কাজ। পারস্পরিক আদান-প্রদানের জায়গায় কোনও বদল হয়েছে?
সুমন: ‘নোবেল চোর’-এর সময় আমি একদম নতুন। সবে তিনটে ছবি করেছিলাম। আমি মিঠুনদা সে অর্থে প্রথম আন্তর্জাতিক তারকা (রাজ কপূরের পর)। ‘প্যান ইন্ডিয়া’ কথাটা এখন খুব উঠেছে। কিন্তু মিঠুনদার যা সর্বভারতীয় আবেদন ছিল, তা অতুলনীয়। ‘নোবেল চোর’-এর সময় মিঠুনদাকে নিয়ে আমার একটা মুগ্ধতা ছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ’। কিন্তু সেই ছবির পর থেকে আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা ব্যক্তিগত হয়ে যায়। ‘কাবুলিওয়ালা’র সময় সেটা খুব কাজে লেগেছিল। এখন আমি বলার আগেই মিঠুনদা বুঝে যান, আমার কোথায় অস্বস্তি হচ্ছে। আমিও অনেক সময় বুঝতে পারতাম ওঁর কোথায় অসুবিধা হচ্ছে। তিন বার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এক জন অভিনেতার একটি চরিত্রের প্রতি নিষ্ঠা কতটা যে, আট মাস ধরে তার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাই এ বারে মিঠুনদা’র সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা একদম অন্য রকম।
প্রশ্ন: মিনির চরিত্রে অভিনয় করেছে শিশুশিল্পী অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাচ্চাদের পরিচালনা করা তো বেশ কঠিন?
সুমন: আমার প্রথম ছবি ‘পদক্ষেপ’-এও একটি পাঁচ বছরের বাচ্চা ছিল। ‘সার্চিং ফর হ্যাপিনেস’-এ সুদীপ্তা চক্রবর্তীর মেয়ে শাহিদা যখন অভিনয় করে, ওর বয়স ছিল চার। বাচ্চাদের পরিচালনা করা অন্য রকম হতে পারে। কিন্তু ওদের একটু ছেড়ে দিতে হয় নিজের মতো। সংলাপ মুখস্থ করিয়ে লাভ নেই। ছে়ড়ে দিলে ওরা কিন্তু চমৎকার অভিনেতা। আমি অনুমেঘার মাকে বলেছিলাম, একদম লাইন মুখস্থ করাবেন না। ওয়ার্কশপে আমি শুধু ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলাম।
প্রশ্ন: মিনিকে খুঁজে পাওয়া কতটা কঠিন ছিল?
সুমন: আমি অনেক অডিশন নিয়েছিলাম। তবে আমার মা ‘মিঠাই’ দেখতেন। মা বলেছিলেন, এই বাচ্চাটা ইন্টারেস্টিং। অডিশনে দেখেই বুঝেছিলাম ও কত স্মার্ট।
প্রশ্ন: আপনিও কি মায়ের মতো সিরিয়াল দেখেন?
সুমন: আমার মা অনেক কিছু দেখেন। আমি এখন আর দেখি না। তবে ১২ বছর আগে সিরিয়াল দেখেই কিন্তু অনন্যা চট্টোপাধ্যায়কে ‘দ্বন্দ্ব’ ছবিতে নিয়েছিলাম। সে সময় ও জাতীয় পুরস্কারও পায়নি। সিরিয়ালই কিন্তু আমায় অনন্যার মতো চমৎকার অভিনেত্রী দিয়েছে। জাত অভিনেতারা যে কোনও মাধ্যমে নিজেদের ছাপ ফেলতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy