কী ভুল করেছেন, জানেন না ছোট পর্দার প্রযোজক-পরিচালক শ্রীজিৎ রায়। ঠিক যেমন জানেন না পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা প্রযোজক-পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। খবর, নতুন বছরে এই দু'জন যথাক্রমে নতুন ছবি আর সিরিজ় পরিচালনা শুরু করতে চেয়েছিলেন। আচমকা ফেডারেশনের তরফ থেকে প্রযুক্তিগত সমস্যার কথা জানিয়ে শুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। শ্রীজিৎকে সেটুকুও জানানো হয়নি। তাঁর নতুন ধারাবাহিকের সেট তৈরির কাজ বিনা নোটিসে বন্ধ করে দিয়েছে আর্টস সেটিং গিল্ড। জয়দীপকে রবিবার সন্ধ্যায় ফেডারেশনের তরফ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পরিচালকের তরফ থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা সংগঠনের অফিসে গেলেও তাঁদের সঙ্গে কেউ কথা বলেননি! ফের তাঁকে মঙ্রগলবার দুপুরে ফোন করতে বলা হয়। পরিচালক জানান, মঙ্গলবার দুপুরে যথা সময়ে ফোন করা হয়। এ বারেও কোনও সদুত্তর মেলেনি। ফেডারেশনের তরফে জানানো হয়, আলোচনা চলছে।

ফাঁকা পড়ে সেট, আসেননি কলাকুশলীরা। নিজস্ব চিত্র।
পর পর তিন জন পরিচালকের উপর কোপ পড়ায় স্বাভাবিক ভাবেই শঙ্কিত পরিচালকেরা। এর পর কার পালা? আতঙ্কে প্রত্যেকে। সমাধান খুঁজতে শ্রীজিতের ডাকে সাড়া দিয়ে সোমবার সকালে ডিরেক্টর্স গিল্ডের সভাপতি সুব্রত সেন, সম্পাদক সুদেষ্ণা রায়, সংগঠনের কার্যকরী কমিটির সদস্য রাজ চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচাৰ্য-সহ উপস্থিত গিল্ড-এর পরিচালক সদস্য। প্রত্যেকের প্রশ্ন, ‘‘আমাদের দোষ কোথায়? কেন আমাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা হচ্ছে না? আমরা তো একটাই পরিবার। ঠোকাঠুকি লাগতেই পারে।’’ বিস্মিত রাজের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্ট্রাইকের ঘোর বিরোধী। তাঁকে অমান্য করার সাহস দেখাচ্ছেন কারা?’’
এ দিন ক্ষোভ ঝরেছে গিল্ড-এর সভাপতি সুব্রতর কথাতে। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “টেকনিশিয়ান ভাইদের কে বা কারা বোঝাচ্ছেন, আমরা নাকি আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ভীষণ ভুল বার্তা ছড়ানো হয়েছে।” তাঁর মতে, পরিচালক সংগঠন যদি প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে তা হলে সেটা পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে প্রথম যখন ফেডারেশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন। যাঁরা আরজি কর- কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁরা মানবিকতার খাতিরে পথে নেমেছিলেন। একই কথা বলেছেন পরিচালক রঞ্জন ঘোষ। তাঁর কথায়, “টেকনিশিয়ানদের এও বোঝানো হচ্ছে, আমরা হয় বামপন্থী নয় পদ্ম শিবিরের। অর্থাৎ, আমরা শাসকদলবিরোধী। যা একে বারেই নয়। বরং কাজের দুনিয়ায় আমরা রাজনীতি আনতেই চাই না।”
আরও পড়ুন:
উল্লেখ্য, গত জুলাই থেকে পরিচালকদের সঙ্গে ফেডারেশনের দ্বন্দ্ব শুরু। ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সেই সময়ের অভিযোগ, পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায় সংগঠনকে না জানিয়ে বাংলাদেশে কাজ করেছিলেন, যা নিয়মবিরুদ্ধ। কৌশিক, জয়দীপ, শ্রীজিতের মতোই সেই সময় তাঁকেও ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সমস্ত পরিচালক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে সাময়িক স্তিমিত হয়েছিল বিরোধ। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সমাধান খুঁজতে বৈঠক করেছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ-অভিনেতা দেব। বিরোধ মেটাতে এঁদের তিন জনের একটি কমিটি গড়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এই কমিটিতে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেনও ছিলেন। কথা ছিল, কমিটি গড়ার তিন মাসের মধ্যে সমাধান খুঁজতে হবে। সোমবার গিল্ড-এর পক্ষ থেকে রীতিমতো অভিযোগ জানানো হয়েছে, সে সব বিশ বাঁও জলে। কমিটির কাছে মেল পাঠিয়েও কোনও উত্তর মেলেনি। সেই পর্ব চলাকালীনই নতুন বিরোধ। আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে টলিউডে চলতে থাকা যৌন হেনস্থার প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আসে। ফেডারেশন সভাপতি সেই সময় দাবি করেন, পরিচালকদের ৬০ শতাংশ নাকি এই ধরনের নিন্দনীয় আচরণ করে থাকেন! স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন সমস্ত পরিচালক। তাঁরা ফেডারেশন সভাপতির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।
নতুন বছরে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা পরিচালক-ফেডারেশন দ্বন্দ্ব কি এ সবেরই ফলাফল?
গিল্ড-এর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। সংগঠনের পক্ষ থেকে অনির্বাণ বলেন, “যা ঘটছে আমরা শুধু সে টুকুই বলতে পারি। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটছে সেটা নিয়ে আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার জায়গায় নেই আমরা। দিতেও চাই না। আমাদের সঙ্গে যা যা ঘটছে সেটাই জানানো হচ্ছে।” সেই জায়গা থেকে মঙ্গল এবং বুধবার ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ধার্য করেছে পরিচালক সংগঠন। আশা, নিশ্চয়ই ইতিবাচক সমাধান মিলবে।
পরমব্রত বলেন, “শুরু থেকে বলে এসেছি, ফেডারেশনের মতো সংগঠন থাকা অতি অবশ্যক। তা বলে তারা পরিচালক গিল্ড-এর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ঠিক যে ভাবে তারা কাজ কেড়ে নিতে পারে না কোনও পরিচালকের।” তাঁর আরও অভিযোগ, “কাজ বন্ধের আগে অন্তত একটা মেল পাঠানো হোক, আমরা আশা করতেই পারি। সে সব কিছুই হচ্ছে না! দুমদাম কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।” তিনি জানান, ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি ৩৪ বছর ধরে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা হিসেবে আছেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তাঁকে ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। এই টলিপাড়াকে তিনি চেনেন না। সুদেষ্ণার কথায়, “আমরা চাইছি, সমাধান হোক। মুখোমুখি বসে আলোচনায় সমস্যা মিটুক। এও চাইছি, আর এক বার গৌতমদা, প্রসেনজিৎ, দেব এগিয়ে আসুন। দায়িত্ব নিন। আমরা আগের মতো এক পরিবার হয়ে কাজ করতে চাই।”

জয়দীপ, শ্রীজিতের পাশে বাকি পরিচালক। নিজস্ব চিত্র।
কৌশিক এর আগেও গিল্ড বা পরিচালকের মুখোমুখি হননি। এ দিনও তিনি অনুপস্থিত। কী বলছেন জয়দীপ, শ্রীজিৎ? উভয়েই জানিয়েছেন, তাঁদের দোষ প্রমাণিত হলে অবশ্যই বিষয়টি বিবেচিত হবে। তাঁরা ফেডারেশনকেও মেল করে সে কথা জানিয়েছেন। তাঁদের কথায়, “কেউ কোনও দোষ দেখাতে পারেননি। কারণ, আমরা জ্ঞানত কোনও টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি।” তাঁরা আরও যোগ করেন, এ বার টেকনিশিয়ানদেরও বুঝতে হবে, ক্রমাগত কাজ বন্ধ মানে তাঁদেরও উপার্জন বন্ধ। শুধু পরিচালকেরা নন, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
সেই জায়গা থেকেই সাংবাদিকদের সামনে রেখে জয়দীপ, শ্রীজিৎ অনুরোধ জানান, "সবাই কাজে ফিরুন। বাংলা বিনোদন দুনিয়া সমৃদ্ধ হোক। কাজ বন্ধ করে দেওয়া সমাধান নয়। ইন্ডাস্ট্রি এ ভাবে চললে আগামীতে কোনও বিনিয়োগকারী বা প্রযোজক এখানে লগ্নি করতে আসবেন না।"
তাঁকে নিয়ে, ফেডারেশনকে নিয়ে এত বক্তব্য ডিরেক্টর্স গিল্ডের সদস্য পরিচালকদের। কী বলবেন ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ? সংগঠন কি মুখোমুখি আলোচনায় বসে সমাধানের পথ খুঁজতে রাজি? জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁর সঙ্গেও। ফোনে যথারীতি ফোডারেশন সভাপতি অধরা।