সরস্বতী পুজোর দিন বাঙালি পুজোয় ব্যস্ত। রাস্তায় হলুদ পাঞ্জাবি এবং শাড়িতে দল বেঁধে বেরিয়েছে ছোটরা। কিন্তু কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ সংলগ্ন একটি তিনতলা বাড়িতে, সকাল সকাল বিয়ের তোড়জোড়! বাড়ির বাইরে জেনারেটর। প্রবেশপথে প্যান্ডেল করা হয়েছে। সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। রবিবার কোনও বিয়ের তারিখ ছিল না। তাই বসন্তপঞ্চমীতে ‘বিয়েবাড়ি’র অন্দরে প্রবেশ করতেই একের পর এক চমক।
আরও পড়ুন:
এই বাড়িতেই চলছে অরিন্দম শীলের নতুন ছবি ‘উৎসব এর রাত্রি’র শুটিং। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় একটি ঘরে পাওয়া গেল তাঁকে। মনিটরে চোখ আটকে। অপেক্ষা করছেন প্রথম টেকের। ছবির মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা গায়ক বাবুল সুপ্রিয় এবং অরুণিমা ঘোষ। সরস্বতী পুজোর দিন শুটিং করতে হচ্ছে বলে তাঁর খুব একটা সমস্যা নেই। হেসে বললেন, ‘‘আমি সকালেই আবাসনের পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে এসেছি। আর এ বার তো দু’দিন পুজো।’’
অরিন্দমের কাছ থেকে দর্শক একাধিক থ্রিলার উপহার পেয়েছেন। কিন্তু এই ছবির প্রেক্ষাপট পরিণত প্রেম। পরিচালকের কথায়, ‘‘ভুলে গেলে চলবে না, আমার প্রথম ছবি ছিল ‘আবর্ত’। বলতে পারি, এই ছবিতে অনেকে ‘দুর্গা সহায়’-এর ছাপ খুঁজে পেতে পারেন। সম্পর্কের ছবি আমার খুব পছন্দের।’’

বাবুল এবং অরুণিমাকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন অরিন্দম। ছবি: সংগৃহীত।
উৎসব (ছবিতে বাবুলের চরিত্র) প্রবাসী বাঙালি। তার সঙ্গে স্বামীহারা রাত্রির (ছবিতে অরুণিমার চরিত্র) এক দিনের সাক্ষাৎ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও ভাগ্যের ফেরে আবার দু’জনের দেখা হয়। তারই প্রেক্ষাপটে রয়েছে একটি যৌথ পরিবারের বিভিন্ন গল্প। সেখানে বিয়ে উপলক্ষেই সেজে উঠেছে বাড়ি। বাবুল কেন? অরিন্দমের উত্তর, ‘‘দীর্ঘ দিন আগেই বাবুল আমার সঙ্গে কাজের ইচ্ছাপ্রকাশ করে। আর উৎসব চরিত্রটা সিঙ্গাপুরে থাকে। আমি স্মার্ট এবং সুদর্শন কাউকে চাইছিলাম।’’
এই মুহূর্তে টলিপাড়ায় বেশ কিছু ছবির শুটিং নিয়ে ফেডারেশনের সঙ্গে পরিচালকদের মতানৈক্য প্রকাশ্যে এসেছে। গত বছর অরিন্দমকে তাঁদের সদস্যপদ থেকে বরখাস্ত করে পরিচালকদের সংগঠন ‘ডিএইআই’ (ডিরেক্টর অ্যাসোসিয়েশন অফ ইর্স্টার্ন ইন্ডিয়া)। সেখানে অরিন্দম কী ভাবে শুটিং করছেন? পরিচালক বললেন, ‘‘আমার কাজের উপরে তো কোনও রকম বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি! তা ছাড়া ফেডারেশনের সঙ্গেও আমার কোনও দিন কোনও রকম মতানৈক্য হয়নি।’’
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশের একটি ঘর পোশাক পরিকল্পনা এবং রূপটানের জন্য বরাদ্দ। তত ক্ষণে সেখানে রূপটানে ব্যস্ত বাবুল। ছাইরঙা ব্লেজ়ার এবং ট্রাউজ়ার তাঁর পরনে। কিন্তু পাশে যেতেই দেখা গেল ডান হাতে প্লাস্টিকের শক্ত স্লিং। জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, ফুটবল খেলতে গিয়ে সপ্তাহ তিনেক আগে হাতের কব্জির হাড় ভেঙেছে। কী ভাবে শুটিং করছেন তিনি? মুচকি হেসে বাবুল বললেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। শটের সময় গার্ডটা খুলে রাখছি। তার পর আবার পরে নিচ্ছি।’’ বেশ কয়েক বছর পর আবার অভিনয়ে ফিরলেন বাবুল। অভিনয়ের প্রতি তাঁর শুরু থেকেই ঝোঁক। তাই কোনও রকম ফাঁক রাখতে চাইছেন না তিনি। কথা শেষ করেই চিত্রনাট্য পড়তে শুরু করলেন বাবুল।
দোতলার বারান্দায় লাইট করা হয়েছে। দুটো ক্যামেরায় শট নেওয়া হবে। উৎসব এবং রাত্রির একটি দৃশ্যের শট নেবেন অরিন্দম। অরুণিমা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিছু ক্ষণ পর বাবুল আসতেই সেখানে চলে এলেন পরিচালক। দৃশ্যটি বুঝিয়ে দিলেন। শট নেওয়ার আগে অরিন্দম বললেন, ‘‘বাবুলের হাতে প্লাস্টার ছিল। বাড়িতে কাঠমিস্ত্রিরা কাজ করছিলেন। কোনও ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ও নিজে মিস্ত্রিদের দিয়ে হাতের প্লাস্টার কাটিয়েছে! কাজের প্রতি এই একনিষ্ঠতা আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছে।’’ বাবুল হেসে অরুণিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আরও তিন সপ্তাহ পর প্লাস্টার কাটার কথা ছিল। কিন্তু শুটিং তো করতেই হবে। ওষুধের জন্য দেখলাম, ব্যথা কম। প্লাস্টারের মধ্যে একটা স্কেল ঢুকিয়ে মিস্ত্রিকে বললাম কাটার মেশিনটা চালিয়ে দিতে।’’
শুরু হল শুটিং। বারান্দায় রাত্রির পিঠে এসে হাত রাখবে উৎসব। বেশ কয়েকটি টেক নিলেন পরিচালক। খুশি হলেন না। ইউনিটের এক সহকারী বাবুলের জন্য ফ্লোর মার্কের পরামর্শ দিতেই অরিন্দম বললেন, ‘‘আমি বাবুলকে এতটা খুঁটিনাটির মধ্যে যেতেই দিতে চাই না। ন্যাচারালি খুবই ভাল করছে।’’ জ়োনে গিয়ে দু’জনকেই আরও এক বার ফ্রেম বুঝিয়ে দিলেন পরিচালক। একটি টেক নেওয়া হয়েছে। বাবুল মনিটরে এসে পরিচালককে বললেন, ‘‘সেরিন্ডিপিটি শব্দটা ব্যবহার করি? সকালে গাড়িতে আসতে আসতে ভাবছিলাম।’’ তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিলেন অরিন্দম। পরের টেকে রাত্রির দিকে তাকিয়ে উৎসবের সংলাপ ভেসে এল, ‘‘ডেস্টিনির জন্য আমাদের দেখা হয়েছিল। আমি তোমাকে এখনও ভুলতে পারিনি রাত্রি।’’ অরিন্দম বললেন, ‘‘কাট! খুব ভাল হয়েছে।’’ শুরু হল পরবর্তী দৃশ্যের প্রস্তুতি।

শটের ফাঁকে আড্ডায় (বাঁ দিকে) অসীম রায়চৌধুরী এবং বাবুল সুপ্রিয়। ছবি: সংগৃহীত।
পরের দৃশ্যে বাবুল নেই। তাঁকে সরস্বতী পুজোর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কয়েকটি জায়গায় যেতে হবে। দু’ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন। তার পর হলুদ পাঞ্জাবিতে শট দেবেন তিনি। এ দিকে দোতলার ঘরে পাওয়া গেল অরুণিমাকে। ঘরের দেওয়ালে তাঁর সঙ্গে শিশুশিল্পী নিকিকেতা ঘোড়ুইয়ের বাঁধানো ছবি চোখে পড়ল। পরবর্তী শটের জন্য অভিনেত্রীর পরনে হলুদ শাড়ি। সরস্বতী পুজোর আমেজের সঙ্গে তাঁর সাজ মানিয়ে গিয়েছে বলে উচ্ছ্বসিত অরুণিমা। বললেন, ‘‘সরস্বতী পুজোর দিন আগেও শুটিং করেছি। তবে চেষ্টা করি, এই দিনটায় হাতে কাজ না রাখার। আমার মামার বাড়িতে খুব বড় করে পুজো হয়। এই বছর আর যেতে পারব না, তাই একটু মনখারাপ।’’
বাবুলের সঙ্গে এই প্রথম অভিনয় করছেন অরুণিমা। বাবুল নিয়মিত অভিনয় করেন না। তাই প্রয়োজনে অরুণিমাও তাঁকে সাহায্য করছেন। অভিনেত্রী বললেন, ‘‘বাবুলদা খুব ভাল মানুষ। এই প্রথম আমাদের আলাপ হল। বাচ্চাদের মতো খুবই ছটফটে। কিন্তু ভাঙা হাত নিয়েও ওঁর মুখে কোনও রকম ‘না’ শুনিনি।’’ শটের ডাক এল। বারান্দায় সোফায় গিয়ে বসলেন অরুণিমা। এই দৃশ্যে তাঁর সঙ্গে থাকবেন অসীম রায়চৌধুরী এবং নিকিকেতা। দুটো টেকেই উতরে গেল দৃশ্যটি।
ছবির অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন বিডি মুখোপাধ্যায়, রত্না ঘোষাল, কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এসিপি অলোক সান্যাল, তপস্যা দাশগুপ্ত প্রমুখ। সিনিয়র অভিনেতাদের সঙ্গে কাজের মধ্যে দিয়ে পুরনো দিনের শুটিংয়ের স্মৃতিও ফ্লোরে ফিরে আসছে বলে খুশি অরিন্দম। পরিচালক জানালেন, ছবিতে রাতের কলকাতার প্রচুর দৃশ্য থাকবে। কথা শেষ করেই ইউনিটের উদ্দেশে মাইকে বলে উঠলেন, ‘‘হাতে সময় কম, লাঞ্চের আগে আমি দুটো সিন শেষ করবই।’’ সেটাই স্বাভাবিক। কারণ ছবিটি আগামী প্রেমদিবসে ‘ফ্রাইডে’ ওটিটিতে রিলিজ়ের পরিকল্পনা রয়েছে পরিচালকের। সেই মতো শুটিংয়ের সমান্তরালেই চলছে ছবির সম্পাদনার কাজও। উৎসব ও রাত্রির কি বিয়ে হবে? মুখে কুলুপ আঁটলেন অরিন্দম। হেসে বললেন, ‘‘এই উত্তর ছবিমুক্তি পর্যন্ত তোলা থাক।’’