শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়।
১৩ বছর বাবা ‘নেই’। শুরুতে বাবার এই না-থাকা, অভাববোধ প্রচণ্ড অনুভব করতাম। কিন্তু ঘর ভর্তি ছবি, বাবার স্মৃতি, টুকরো টুকরো কথা মনে পড়লেই মনে হত, এই তো বাবা আছেন। কোথাও যাননি!
যেহেতু ঘটনাচক্রে বাবা আর আমি এক পেশায়, তাই অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে আর এক অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কতখানি মিস করেন? এখনকার প্রজন্মের অনেকে এটাও জানতে চান। এখানেও আমার একই উত্তর, মিস করি না।
করি না দুটো কারণে। এক, খুব মনখারাপ করলে ডিভিডি-তে বাবার সিনেমা দেখি। নিমেষে জীবন্ত হয়ে ওঠেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। দুই, আগের ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এখনকার ইন্ডাস্ট্রির আকাশপাতাল তফাত। তখন বাংলা ছবি সাহিত্যনির্ভর ছিল। চরিত্রগুলোও ছিল ভীষণ বাঙালি। এখন বিশ্বায়নের প্রভাবে সেই বাঙালিয়ানা আর নেই। ফলে, আগের সেই স্বাদ এখন চাওয়া এবং পাওয়া দুটোই মুশকিল।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির শুটিং চলাকালীন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
আরও পড়ুন: ক্ষমা চাইতে বলেন সরোজ, উল্টে তাঁকে নিয়ে ফিল্মে ব্যঙ্গ করেন ফারহা!
বাবাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন। এই যেমন, ডাক্তারি পাশ করেও কেন অভিনয় দুনিয়ায় এলেন? মহানায়ক উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাদের পাশেও কী করে নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছিলেন? মহানায়কের সঙ্গে তাঁর সখ্য... ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথমেই বলি, বাবা ডাক্তারি পড়েছিলেন দাদু চেয়েছিলেন বলে। পড়ার পাশাপাশি কিন্তু সমান ভাবে আইপিটিএ-তে অভিনয় করে গিয়েছেন। ফলে, বাবা আচমকা অভিনয়ে এসেছেন এটা বোধহয় বলা যায় না। বরং, তিনি দাদুর কথাও রেখেছিলেন, আবার নিজের স্বপ্নও পূরণ করেছিলেন, এটা বলা যেতে পারে।
বাবার এই স্বপ্নপূরণ করেছিলেন মৃণাল সেন। নাটক দেখে বাবাকে তাঁর ‘আকাশ কুসুম’ ছবির জন্য বেছেছিলেন। ফলে, মৃণাল জ্যেঠুর হাত ধরে চিকিৎসক হওয়ার বদলে বাবা হয়ে গেলেন টালিগঞ্জ পাড়ার ‘এক জন’। শুধুই এক জন নন, ‘বিশেষ এক জন’। সে সময়ে টলিপাড়ায় মহানায়ক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কী দাপট! তারই মধ্যে নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু বাবা সেটা পেরেছিলেন। অভিনয় দক্ষতা, পরিশ্রম এবং আবারও বাঙালিয়ানার জোরে। কারণ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের চেহারায় এই উপাদান ভীষণ মাত্রায় ছিল।
আগেই বলেছি, তখন টলিপাড়া একদম অন্য রকম ছিল। সেখানে আড্ডা হত, ঝগড়া হত, মনোমালিন্যও হত। আবার সেগুলো কাটিয়ে ভীষণ বন্ধুত্বও হত। বড়রা ছোটদের স্নেহ করতেন। ফলে, ত্রুটি দেখে বকুনি দিলে সেটা শিরোধার্য করতেন সবাই।
আমার বাবার ক্ষেত্রেই যেমন, এক বার গাড়ির পেট্রোল নিতে গিয়ে পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়েছিলেন বাবা। সেটা দেখেছিলেন উত্তম জেঠু। পরের দিন কষে বকুনি বাবাকে, ‘‘স্টারডম নষ্ট করতে চাও! ও ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পর্দায় কেউ দেখতে যাবে?’’ বাবা আর কোনও দিন ও ভাবে দাঁড়াননি। তখন মহানায়ক লাঞ্চে সবার সঙ্গে বসে খেতেন। আমিও ছোটবেলায় দেখেছি।
উত্তম কুমার এবং তরুণ কুমারের সঙ্গে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
আরও পড়ুন: নয়া রহস্য! সুশান্ত সিংহের বাবার নামে কে খুলল ভুয়ো টুইটার অ্যাকাউন্ট?
এখন কারও হাতে সময় নেই। ফলে, আড্ডা নেই। কারও দিকে কারও চেয়ে দেখার সময়ই নেই। কে, কাকে এমন স্নেহমিশ্রিত শাসন করবে?
আরও একটা উদাহরণ দিলে বাবার সঙ্গে উত্তম জেঠুর সঙ্গে এই সম্পর্ক জলের মতো স্বচ্ছ হবে। মহানায়কের মৃত্যুর পর সবার মতো ভেঙে পড়েছিলেন বাবাও। আর তার থেকেই একটা অদ্ভুত রেওয়াজ চালু করেছিলেন বাড়িতে। প্রতি বছর ২৪ জুলাই বাবা মহানায়কের ছবিতে মোটা মালা পরাতেন। সামনে রাখতেন এক পেগ ওয়াইন। কাকতালীয় ভাবে বাবার চলে যাওয়াও জুলাই মাসেই, আজকের দিনে, ৫ জুলাই।
বাবার সেই রীতি আজও চলছে আমাদের বাড়িতে। আজও উত্তম জেঠুর মতো বাবার জন্ম এবং মৃত্যুদিনেও ছবিতে মালা আর এক পেগ ওয়াইন মাস্ট।
আরও একটি জিনিস অবাক করত সবাইকে। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থাকতেও বাবার এত মহিলা ভক্ত কী করে হয়েছিল? সেটাও বাবার ক্যারিশমা। লম্বা টানটান চেহারা আর অভিনয় দিয়ে যেমন দর্শকদের মন জয় করেছিলেন, তেমনই ওই চেহারার জন্যই বাবার অনুরাগিণী ছিল অনেক। তবে বাড়ির ভেতরে তাঁদের কোনও দিন ছায়াটুকুও পড়তে দেননি বাবা। বাইরের কাজ, অনুভূতি বাইরে রেখে আসতেন।
বাবার স্মৃতি সামনে এলেই মনে পড়ে আমার অভিনয় জীবনের শুরুটাও। বাবা না হয় মঞ্চে অভিনয়ের প্যাশনেই অভিনেতা হয়েছিলেন। কিন্তু আমি কেন এসেছি? বাবা অভিনেতা সেই কারণে? মোটেই না। বরং আমার অভিনয়ে আসার কারণ ভীষণ মজার। সম্ভবত গ্র্যাজুয়েশন পড়ছি বা পড়া শেষের দিকে, বাবা হঠাৎ এক দিন জানতে চাইলেন, ‘‘ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছ?’’ দুম করে বলেছিলাম, অভিনেতা হব। বাবা ফিরিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘কেন?’’ উত্তর দিয়েছিলাম, কাজের সৌজন্যে কত সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যাওয়া যায়!
মান্না দে-র সঙ্গে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং শাশ্বত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
বাবা আর কিছু না বলে জোছন দস্তিদারের ‘চার্বাক নাট্যগোষ্ঠী’-তে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে পুরোদস্তুর তৈরি হওয়ার পরে বাবার সঙ্গে আমার প্রথম মঞ্চে অভিনয়, ‘বৈশাখী ঝড়’।
এখনও মনে আছে, মঞ্চে রীতিমতো ডুয়েল হত আমাদের। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তাম না। যে দিন দুর্দান্ত অভিনয় হত, সে দিন হলে পিন পড়লেও শোনা যেত। যে দিন একটু গড়বড় হত, দর্শক পর্দা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিতেন। নইলে অনেক ক্ষণ নিস্তব্ধতার পরে ধীরে ধীরে হাততালি পড়ত। একসময় কান পাতা দায় হত সেই শব্দে।
একান্তে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
এই প্রসঙ্গে অতি সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। এবং ভাবতে গিয়ে হেসেও ফেলেছি। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুতে কাঠগড়ায় ‘স্বজনপোষণ’। তাই নিয়ে বলিউড ছেড়ে আমাদের বাংলাও তোলপাড়। সাধারণত, স্টারের ছেলে স্টার হলে নাকি এই সুবিধে ইন্ডাস্ট্রিতে মেলে। আফসোস, আমার বেলায় কেন তা ঘটল না?
অভিনেতার ছেলের অভিনেতা হওয়ার যন্ত্রণা যে কী, হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি ইন্ডাস্ট্রিতে এসে। সারা ক্ষণ, সব ব্যাপারে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের তুলনা। আমি কি আমার বাবা? বাবা বাবার মতো, আমি আমি-ই। এটা বুঝতেই বহু বছর লেগেছে সবার।
নেপোটিজম তাই উচ্চারণ করা সহজ। তাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করা যায়। কিন্তু বয়ে বেড়ানো ততটাই ভয়াবহ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy