তরুণ মজুমদারকে নিয়ে লিখলেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়
ছবির দুনিয়া থেকে অনেক দিন দূরে তরুণ মজুমদার। শুনেছি, ওঁর মনে তাই নিয়ে যন্ত্রণাও ছিল। আমি বলব, ছবির দুনিয়া থেকে দূরে থেকে বেশ করেছেন। আজকের প্রযোজকেরা সুকুমার রায়ের নাম জানেন না! তাঁরা চিনবেন তরুণ মজুমদারকে? অথচ দেখুন, তরুণ মজুমদার চলে যাওয়ার পরে চারিদিকে কত 'আফসোস', 'মহীরুহের পতন'। বাংলা বিনোদন দুনিয়া নাকি অনাথ হয়ে গেল! কত রকম লেখা।
কিন্তু মানুষ এক দিন না এক দিন তো চলে যাবেই। লোকে মনে করবেন, আরও কিছু দিন থাকলে আমরা হয়তো তাঁর থেকে আরও ভাল কিছু কাজ পেতাম।
এ বার প্রশ্ন, যে পরিচালক নাকি শেষ দিকে ছবি তৈরি করছিলেন না, তিনি থাকলেও কি আর কিছু দিতে পারতেন?
গঠনমূলক সমালোচনা করলে বলব, এটাই নিয়তি। পরিচালক, প্রযোজককে সমসাময়িক থাকতে হয়। না হলে একটা সময়ের পরে সমস্যা তৈরি হয়। তনুবাবু ‘ছবি’ বানাতেন। তাতে নিটোল গল্প থাকত। হয়তো একটু ধীর গতির। কিন্তু আজকের দিনে যে ছবি তৈরি হচ্ছে তাতে 'তনুবাবু' এই ধারার ছবি বানাতে পারতেনই না। আজকের প্রজন্ম তাঁর তৈরি ছবি কতটা দেখতে চাইত? তাই নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
ইন্ডাস্ট্রি থেকে ছিটকে যাওয়ার পিছনে এই একটি নয়, আরও কারণ আছে। আমাদের সময়ে রামকৃষ্ণ সাধুখাঁ সহ বাকি প্রযোজকেরা গল্পের বই পড়তেন। নানা সাহিত্যিকের নাম, তাঁদের লেখা সম্পর্কে সবারই কমবেশি সম্যক ধারণা ছিল। ফলে, তাঁরা সেই ধরনের ছবির উপরে জোর দিতেন। এখন সাহিত্যনির্ভর ছবির সংখ্যা হাতেগোনা।
তনুবাবু প্রচুর অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্ম দিয়েছেন। তাঁরা তনুবাবুকে ‘গুরু’ মেনে তাঁর নির্দেশমতো চলতেন। পরিচালক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করাতেন সবাইকে। অভিনেতারা মুখ বুজে মেনে নিতেন। এখনকার অভিনেতাদের দিয়ে সেই খাটনি কেউ খাটাতে পারবেন? পরিবেশ বদলে গিয়েছে। প্রজন্ম বদলে গিয়েছে। এই সময়ের সঙ্গে তনুবাবুর মতো পরিচালকদের নিজেদের মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে।
আগে একটি ছবি ৫০ দিনে তৈরি হত। এখন মেরেকেটে ১৬ দিন লাগে! ‘পলাতক’-এর পরিচালক সবার আগে এই কারণে ছবি বানাতে নারাজ হতেন। কারণ, তিনি বা তাঁর সমসাময়িকেরা ডিটেলিংয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। এখন এত সময় কই? ১০ মাসের জায়গায় পাঁচ মাসেই সন্তানের জন্ম হয়ে যাচ্ছে!
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারণ, ইন্ডাস্ট্রি এখন রাজনীতির আখড়া। সেখানে শুধুই প্রভাবশালীদের প্রতিপত্তি। তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকেরা কিন্তু কাজের সময় পছন্দ-অপছন্দ বিচার করতেন না। যিনি ভাল অভিনয় করবেন তাঁকেই ডাকতেন। তাঁকে অপছন্দ করলেও সুযোগ দিতেন। এখন তো সেটি হবে না! পছন্দের অভিনেতা অভিনয় না জানুন, ক্ষতি নেই। ভাল অভিনেতা অপছন্দের হলেই তাঁর ঘাড়ে কোপ। এই মানসিকতাও মেনে নিতে পারতেন না তিনি।
এত কথার পরেও বলব, তনুবাবু কিন্তু এই প্রজন্মের ছবি দেখতেন। ভাল লাগলে যেচে প্রশংসা করতেন। যেমন, অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’ তিনি নিজে দেখতে গিয়েছিলেন। এবং ছবি দেখার পরে নিজেই পরিচালককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যে পরিচালক সাদা-কালোয় এমন একটি ছবি বানাতে পারেন তাঁর কাছে তিনি আজীবন কৃতজ্ঞ। আমাদের খামতি, আজকের ছবির দুনিয়ার সঙ্গে তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালককে আমরা মানিয়ে নিতে পারলাম না। এটাই হয়তো আসল আফসোস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy