আরজি কর-কাণ্ড রাজ্য জুড়ে চলছে প্রতিবাদ। ছবি: সংগৃহীত।
আরজি করে যে ঘৃণ্য অপরাধ ঘটেছে, তা আমাদের সভ্যতার লজ্জা, আমাদের শহরের লজ্জা। এর নেপথ্যে যে শাসকগোষ্ঠী এবং ক্ষমতাবান মানুষদের একটা বড় রকমের যোগসূত্র রয়েছে, সময়ের সঙ্গে সেই সম্ভাবনাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। কোনও বিকারগ্রস্ত মাথা নয়, সেখানে সংগঠিত অপরাধেরও তত্ত্বও উঠে আসছে।
অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সমাজের নিয়ম। কিন্তু ১৪ অগস্ট মহিলাদের আহ্বানে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের সাক্ষী কলকাতা-সহ আমাদের রাজ্য থেকেছে, তা নজিরবিহীন বলেই আমার মনে হয়েছে এবং তা আগামী দিনে আরও বড় কোনও ঘটনার দিকেও যেতে পারে। মনে আছে, নন্দীগ্রামে গুলি চলার সময় আমরা যখন প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, তখন সমাজমাধ্যমের এই রমরমা ছিল না। নিজেরা একে অপরকে মোবাইলে ফোন এবং মেসেজ পাঠিয়েই জমায়েতে অংশ নিতাম। কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা— ওই একটা মিছিলেই যেন বামফ্রন্ট সরকারের পতন ধ্বনিত হয়েছিল। আজকে যে গণ আন্দোলন চলছে, আমার মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে সাধারণ মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ এবং বঞ্চনা। তা না হলে বাঁধভাঙা এই প্রতিবাদের স্রোত কি শহরের বুকে আছড়ে পড়ত? কিন্তু আসল কথা হল, আমাদের সকলে মিলে এই প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। দেখা যাচ্ছে প্রতি দিন বিভিন্ন জমায়েত ঘটছে নানা কোণে। শাসককে জবাব দিতে হবে, সুবিচার চাই। শাসক হয়তো ভাবছে, এই ধরনের আন্দোলন একটা সময় পর্যন্ত গণমাধ্যমে চলতে থাকে। তার পর সময়ের সঙ্গে সেটা থিতিয়ে পড়ে। আবার ব্যতিক্রমও রয়েছে। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনের সময় মানুষ পথে নেমেছিলেন, সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধেও। তার পর শাসককেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হয়েছিল।
একজন মহিলার আহ্বানে এই জমায়েত তো আমাকে ১৯৮৯ সালে বেজিংয়ের তিয়ানানমেন স্কোয়্যারে ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! শহর এবং রাজ্য জুড়ে বিশাল সংখ্যক সমবেত হয়েছেন। আবার সব সময় জমায়েত যে খুব বড় হচ্ছে তা-ও নয়। মানুষ তাঁদের নিজেদের মতো করে পাড়ায় পাড়ায়, নিজেদের অঞ্চলে একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মিছিল করছেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা উদাহরণ দিই। সম্প্রতি রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাইপাস ধরে চলেছি, অ্যাকাডেমির সামনে জমায়েতে শামিল হতে। দেখলাম, রাস্তা দিয়ে জনা পঞ্চাশ মানুষ মিছিল করে হাঁটছেন। মাঝরাতে, নিজেদের জন্য নয়, কোনও বৃহৎ সামাজিক উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই তো তাঁরা হাঁটছিলেন! এটা অবশ্যই একটা বড় ঘটনা। একই ভাবে ডার্বি ম্যাচ বাতিল করার পর, রবিবার মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডান সমর্থকদের জমায়েতেরও একটা সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে বলেই আমি মনে করি। খেলার বাইরে সমর্থকদের এই জমায়েতও তো নজিরবিহীন ঘটনা। এই প্রতিবাদীদের উপর পুলিশ লাঠি চালিয়েছে। অথচ ১৪ই রাত্রে আরজি করে দুষ্কৃতীরা যখন ভাঙচুর চালিয়েছে, পুলিশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। আরজি কর-কাণ্ডে শাসকদলের মধ্যে অদ্ভুত এক অনীহা এবং উদাসীনতা লক্ষ করছি। অন্তত এই পুরো ঘটনায় তারা এখনও পর্যন্ত যে ভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। তাই প্রতিবাদের স্বরও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
আরজি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত আহ্বানের ফলাফল। মানুষের এই প্রতিবাদ অবশ্যই সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি কোন রাজনৈতিক দল নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকার তলায় মানুষের জমায়েত হয়নি। সমাবেশ ঘটিয়েছেন সাধারণ মানুষ, নিজস্ব তাগিদে, স্বন্তন্ত্র চিৎকারে। এই গণ উত্থানের নেপথ্যে যে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নেই, এটা বোঝাতে ‘অরাজনৈতিক’ কথাটা উঠে এসেছে। সেখান থেকে কিছু বিভ্রান্তির অবকাশ ঘটেছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, এই আন্দোলন অরাজনৈতিক। এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, রাজনীতি সচেতন মানুষের আন্দোলন— ক্ষমতার বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলের বাইরে একটা বড় ভূমিকা থাকে স্বাধীন রাজনৈতিক জনগণের। কিন্তু পাশাপাশি গণ আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট দিশা পায় রাজনৈতিক দলের সম্যক ভূমিকায়। যে ভাবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গণ আন্দোলনের পর বদল ঘটেছিল সরকারের।
রাজনৈতিক দল বা পতাকার বাইরে আরজি কর-কাণ্ডে জনগণের এই উত্থান অবশ্যই একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ঘটনা। একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে রাজনীতির পতাকার ছত্রছায়া থেকে যে মানুষ যে সরে আসতে চান, তার ঐতিহাসিক উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। একসময়ে ‘আইপিটিএ’র সঙ্গে নানা মাধ্যমের শিল্পীদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেকেই আবার আইপিটিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল, আইপিটিএ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পতাকার অংশ। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতির প্রতিফলন। শিল্পীরা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারেন বা না পারেন, কিন্তু শিল্পের ভাষ্যের জন্যে, শৈল্পিক প্রকাশের জন্য চাই একটি স্বন্তন্ত্র ভূমি। সেই স্বাতন্ত্র্যের খোঁজ থেকেই শুরু হয় তথাকথিত ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আন্দোলন। উৎপল দত্ত সোচ্চারে ব্যক্ত করেছেন তাঁর মার্ক্সবাদী পার্টির প্রতি সমর্থন। কিন্তু তিনি তা পার্টির পতাকার বাইরে একটি স্বাধীন নাট্যদল থেকে করেছেন। আবার শম্ভু মিত্র নতুন পাঠে পড়ছেন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ বা সোফোক্লিসের ‘ইডিপাস রেক্স’। তিনি কোনও দিনই পার্টির কাছের লোক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর নাট্যচয়নে একটি মতাদর্শগত ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল। নাট্যদলগুলির মধ্যে অনেক দল ভোটের আগে বাম দলের সমর্থনে প্রচার নাটকও করেছে। অনেক দল আবার করেনি। পার্টির সঙ্গে অনেক বড় মাপের শিল্পীর ভয়ানক মতবিরোধ হয়েছে, তাতে হয়তো সেই শিল্পীর সঙ্গে পার্টির দূরত্ব বেড়েছে, কিন্তু এমন নয় যে, তাঁরা তাঁদের মতাদর্শের ভূমি বা রাজনৈতিক বিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছেন। বরঞ্চ তাঁদের রাজনৈতিক ভূমিকা আরও জোরালো হয়েছে, মানুষের কাছে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য যথাযোগ্য সম্মান পেয়েছে। এইখানেই স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কণ্ঠ এবং রাজনৈতিক দলের মঞ্চ থেকে প্রতিবাদের তফাত।
আর একটা অন্য রকম উদাহরণ দিই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রের। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে এক গণ অভ্যুত্থান ঘটে জার্মান কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষ শাসকদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে শামিল হন। ঠিক সেই সময়ে পূর্ব জার্মানির সরকারি নাট্যশালা বার্লিনার এন্সম্বলের প্রধান ছিলেন বিশ্ববরেণ্য নাট্যকার বারটোল্ট ব্রেখ্ট। তিনি তখন শেক্সপিয়ারের কোরিওলেনাস নাটকের মহলা দিচ্ছিলেন। সেই নাটকের মূল বার্তা ছিল রাষ্ট্রশক্তি এবং স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যখন থিয়েটারের বাইরে এত বড় একটি গণ আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছে, তখন ব্রেখ্ট সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। সারা জীবন শ্রেণি রাজনীতির ধ্বজা উড়িয়ে, মার্ক্সবাদের কথা বলে শেষে কিনা শাসকের ধামাধরা হয়ে গেলেন। শিল্পী ক্ষমতার সঙ্গে থাকলে এ রকমই ঘটে। এই নিয়ে পরবর্তী কালে ১৯৬৬ সালে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস একটি নাটক লেখেন — ‘প্লিবিয়ান্স রিহার্স দ্য আপরাইসিং’, ব্রেখ্টের এই উদাসীনতাকে আক্রমণ করে। আমার ‘মেফিস্টো’ নাটকের বয়ানেও একই বার্তা— শিল্পীর সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্ক।
আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তভার নিয়েছে সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট কড়া ভাষায় বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে এই আপৎকালীন মুহূর্তে। পাশাপাশি প্রতিবাদ চলছে। আমিও সকলের মতোই দোষীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এই প্রতিবাদ বজায় রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে আমার প্রশ্ন, একজন অপরাধীর শাস্তিতেই কি এই ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব? আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান অবস্থার কথা বলব। আমি নিজে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। সেখানেও তো দেখলাম, হস্টেলে ছাত্রমৃত্যুর এখনও কোনও সুরাহা হল না। অপরাধীরা নির্বিচারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারি, তা তো আমার কাছে কল্পনার অতীত! খবরাখবর যা পাই তাতে বোঝা যায়, এই ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজকতা চলছে। এই রকম নানা ক্ষেত্রে অরাজকতার অবসান চেয়ে মানুষ আজ গর্জে উঠেছে।
আমাদের দেশে দুর্নীতি কোনও নতুন ব্যাপার নয়। অনাদি, অনন্ত ঘটেই চলেছে। আজ সমাজের বিভিন্ন কোণে দুর্নীতি যেমন এক বিস্তীর্ণ আকার ধারণ করেছে, তেমনি পাশাপাশি গোটা দেশটাকে প্রায় বেচে দেওয়া হচ্ছে পুঁজিপতিদের হাতে। সেখানে সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ যদি সূত্রপাত হয়ে থাকে, তা হলে তার অভিঘাত আরও বড় আকার ধারণ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। ক্ষমতার অপব্যবহার কোনও ভাবেই কাম্য নয়। কারণ, অপব্যবহারের ইতিহাস আমরা দেখেছি। মানুষ যদি এক বার জেগে ওঠে, তা হলে কিন্তু যে কোনও ক্ষমতাকে উল্টে দেয়।
এক দিন প্রতিবাদ করে কী হবে বা সাময়িক প্রতিবাদের স্বর কমে গেলে, তখন নাকি আবার আগের অবস্থাই ফিরে আসবে— এ রকম নানা মতের তিরে বিদ্ধ সমাজমাধ্যম। শুরু হয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক। কিন্তু সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের ফল যে সুদূরপ্রসারী হতে পারে, ইতিহাসে তার উদাহরণ রয়েছে। ২০১১ সালে মিশরের তাহরির স্কোয়্যারে মানুষের জমায়েত আমরা দেখেছি, দেখেছি জনরোষ। উল্টে গেছে মুবারক সরকার। কিন্তু ইতিহাস এটাও দেখিয়েছে, তার পরেও ইজিপ্টে ফিরে এসেছে স্বৈরাচারী সরকার। সম্প্রতি, বাংলাদেশে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনও দেখলাম। সেই আন্দোলনকে মনপ্রাণ উজাড় করে সমর্থন করেছি। সেই আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করতে হল। কিন্তু পাশাপাশি আর এক সাম্প্রদায়িক শক্তি কি নতুন করে মাথাচাড়া দিল? বাংলাদেশের বিদ্রোহী, রাজনীতি সচেতন, গণতন্ত্রকামী জনতা নিশ্চয়ই সেই দিকে কঠোর নজর রাখছে। তাই আরজি কর-কাণ্ডে প্রতিবাদ বা আন্দোলনের অভিমুখ কোন দিকে বাঁক নেবে, তা এখনই বলা মুশকিল। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব, আমি এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকব। আবার এটাও স্মরণে রাখতে হবে যে, এই দেশে ক্ষমতাসীন এক সাম্প্রদায়িক সরকার। বিভেদকামী দাঙ্গাবাজরা ওত পেতে আছে এই অশান্ত সময়কে, ন্যায়বিচারের দাবিতে উত্তাল মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। তাঁদের হাতে বিপুল ক্ষমতা, অর্থবল এবং নানা প্রচারের মাধ্যম— এই জনরোষকে ভুল দিকে চালিত করার। সমাজমাধ্যম না থাকলে ১৪ অগস্ট রাতের দেশব্যাপী জমায়েত সম্ভব হত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তার জন্য সমাজমাধ্যমের প্রতি মানুষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু একই সঙ্গে সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে যে ভাবে অপ্রাসঙ্গিক খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা খুবই আশঙ্কাজনক। এই প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা যেন সরে না যাই, সে দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy