Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengali actress

প্রযোজক বললেন আমার জামার মাপ তিনি নিজেই নেবেন

ওয়ার্কশপে তিনি চুম্বনদৃশ্য অভ্যেস করতে করতে বান্ধবীর খুব কাছে চলে এসে বলেন, ‘‘এ বার তা হলে চুমুটা খাই?’’

দেবলীনা দত্ত।—ফাইল চিত্র।

দেবলীনা দত্ত।—ফাইল চিত্র।

দেবলীনা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২০ ১৮:৫৮
Share: Save:

বাধ্য হলাম কলম ধরতে। ইন্ডাস্ট্রিতে ২২ বছরের অভিজ্ঞতা। আজও মুখ বন্ধ করে থাকলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। ইদানীং শুনতে পাচ্ছি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি ‘ফেভারিটিজম’ আছে, ‘নেপোটিজম’ বা স্বজনপোষণ নেই। এটা মিথ্যে কথা! ডাহা মিথ্যে বলছে লোকজন। শুধু স্বজনপোষণ নয়, এই ইন্ডাস্ট্রিতে মাফিয়ার আধিপত্য কিছু কম দেখলাম না।

প্রযোজক বললেন কম্প্রোমাইজ করতে রাজি কি না

আমার কেরিয়ারের শুরুর দিকে একটু ফিরে যাই। আজ থেকে ২২ বছর আগে আমার দ্বিতীয় ধারাবাহিককে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাকে বলা হল, প্রযোজক দেখা করতে চেয়েছেন। তখন মা আমার সঙ্গে যেত, মা স্ক্রিপ্ট লিখত। কিছু ক্ষণ প্রযোজকের অফিসে অপেক্ষার পরে উনি বলে পাঠালেন, আমার সঙ্গে উনি একা কথা বলবেন। গেলাম। ওমা! গিয়ে দেখি ওঁর টেবিলে ঠিক ওর মুখের সামনে একটা সিসিটিভি রাখা! আজ থেকে ২২ বছর আগে! আমি বুঝলাম, যত ক্ষণ আমরা বসেছিলাম সিসিটিভি দিয়ে উনি আমাকে আর মাকে দেখছিলেন। যাই হোক, এখনকার পরিচালক বা প্রযোজকদের মতো কোনও রাখঢাক না করেই উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে এসেছি আমি, ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে রাজি কি না! চমকাতে দেখি, উনি আমাকে আরও সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, প্রযোজকের সঙ্গে অভিনেত্রীর বোঝাপড়া, সখ্য না থাকলে ভাল কাজ হয় না। প্রযোজককেও আলাদা সময় দিতে হবে, তবেই পারস্পরিক সমঝোতা তৈরি হবে। উনি বললেন, আমার চরিত্র, সংলাপ সব নিয়ে উনি কথা বলবেন। এমনকি, আমার জামাকাপড়ের মাপও উনি নেবেন! এটা শোনার পর আমি এক কথায় না বলে দিই ওঁর মুখের ওপর। তাতে উনি আমায় চ্যালেঞ্জ করেন, আমি নাকি ইন্ডাস্ট্রিতে এই মনোভাব নিয়ে টিকে থাকতে পারব না। শুনেছি, সব নায়িকার সঙ্গেই উনি এই ব্যবহার করতেন। ‘দর্জি প্রডিউসার’ নামে উনি বিখ্যাত ছিলেন। ছিলেন এই কারণে লিখলাম, আজ আর ওঁকে কেউ চেনে না।

নাম করা অভিনেতা আজও পরিচালকের বাজার করে দেয়

আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে যদি বুঝতেই হয় তা হলে তাকে একটা ‘নেক্সাস’ বা ‘'আঁতাঁত’ হিসেবে দেখা উচিত। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ভাল এক জন অভিনেতা, তাঁকে এক জন নামকরা পরিচালক প্রমোট করবেন। শুধু তাঁর ছবি নয়, তাঁর চেয়েও বড় পরিচালকের ছবিতে কাস্ট করাবেন। তো সেই কারণে অভিনেতা সারা ক্ষণ পরিচালকের পেছন পেছন ঘুরছে। তাঁর ব্যাগ বয়ে দিচ্ছে, তাঁর মোবাইল পার্সের দায়িত্ব নিচ্ছে। আমরা পার্সোনাল অ্যাটেন্ড্যান্ট দিয়ে যা করাই সে তাই করছে। বাজার করছে। বেড়াতে যাচ্ছে। পরিচালকের বাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে। সে নিঃসন্দেহে ভাল অভিনেতা, কিন্তু তার মতো আরও দশটা ভাল অভিনেতা আছে। তারা কিন্তু ওই বৃত্তে কোনও দিন ঢুকতে পারবে না। শুধু অভিনেতা নয়, পরিচালকও এক কাজ করছে। প্রযোজকের অফিসে বসেই আছে। আর নায়িকাদের কথা তো বাদ দিলাম। তারা এন্টারটেন না করলে তো কিছুই হবে না। আমাকে যেমন এক প্রযোজক বলেছিলেন সেই রকম আর কি! এই আমিই তো কোনও দিন বড় প্রযোজক, পরিচালকের বৃত্তে ঢুকতে পারিনি। ওরা এত দিনে জেনে গিয়েছে, আমি কী পারব আর পারব না। তাই ওরা আমায় ডাকেও না।

আরও পড়ুন: বলেছিলাম ইন্ডাস্ট্রির প্রেম, স্বস্তিকা বুঝল দেহব্যবসা: শ্রীলেখা

বন্ধু পরিচালক বলল, ‘‘তোকে ছবিতে নিলে আমি কী পাব?’’

হঠাৎ ডেকেছিল এক জন! বন্ধু পরিচালক। ওর বড় একটা ছবিতে ছোট্ট চরিত্র করছি যখন তখন আমার অন্য একটা বাংলা ছবির পোস্টারে লুক প্রকাশিত হয়েছে। সেটা দেখে সেই বিখ্যাত বন্ধু পরিচালক বলল, ‘‘দেবু, ডিসেম্বরে একটা নতুন ছবির কাজ হবে। ফাঁকা থাকিস। ডেট নেব।’’ এর বেশ কিছু দিন পর ওই পরিচালকের যে ছবিতে আগে কাজ করেছিলাম তার প্রেস মিট ছিল। সেখানে দেখলাম ও নতুন ছবির নাম আর চরিত্রদের কথা ঘোষণা করল। কিন্তু আমার নাম নেই। বড় ব্যানারে প্রচুর মহিলা চরিত্র নিয়ে ছবি, যে ছবিতে আমারও অভিনয় করার কথা ছিল। আমি বন্ধু পরিচালকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘‘আমার চরিত্র কোনটা রে?’’ ও বলল, ‘‘তুই তো নেই এই ছবিতে।’’ আমি বললাম, ‘‘ডিসেম্বরে ডেট নিতে বললি, হবে না যে কাজটা জানাবি তো!’’

ও সকলের সামনে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘‘আমি যদি তোকে ওই চরিত্রটায় নিই আমি কী পাব?’’ এই ধরনের ইঙ্গিত সকলের মাঝে দেওয়ার সুবিধে থাকে যাতে পরে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বলা যায় যে সকলের সামনেই তো মজা করেছি। তবে বিষয়টা ঠাট্টা ছিল না, কারণ ঠাট্টা হলে ও চরিত্রে নিত আমায়। বন্ধু পরিচালকের কাছ থেকে এই ইঙ্গিত, চরিত্র না পাওয়া নিয়ে খুব খারাপ লাগা জমেছিল ভেতরে। সে দিন যদি হেসেই বলতাম, ‘‘তুই যা চাইবি তাই দেব’’, তা হলে পরিচালক আমার ইঙ্গিত বুঝে রাতে আমায় ফোন করত। সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যেত। খারাপ লেগেছিল, মনে হয়েছিল, এ আমার সেই বন্ধু যার বহু অনুরোধে বেশ কিছু দিন আগে মুম্বইয়ের আমার এক অভিনেত্রী বন্ধুকে ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। যদিও সেই আলাপ ধোপে টেকেনি। আমার পরিচালক বন্ধু কাজের ছুতোয় বার বার তাকে নানা ভাবে তার বাড়িতে আলাদা করে যেতে বলেছিল। আলাদা সময় কাটাতে চেয়েছিল। সবই চরিত্র দেওয়ার অছিলায়। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

পরিচালক ‘গাছ’ হয়ে বললেন তুমি আমার ওপরে ওঠো!

আর এক জন পরিচালকের প্রসঙ্গ এখানে না আনলেই নয়। আমার খুব কাছের এক জুনিয়র বান্ধবীর মুখে শুনেছি ঘটনা। এক নাম করা পরিচালক কয়েক জন নতুন মুখকে নির্বাচন করে ছবি শুরুর আগে ওয়ার্কশপ করান। তো আমার সেই বান্ধবী তাঁর এক ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার পরে তাঁকে পরিচালক ওয়ার্কশপে ডেকে পাঠান। ওমা! সে সেই ওয়ার্কশপে গিয়ে শোনে, পরিচালক প্রত্যেক নতুন মেয়েকেই বলছেন, ধরে নাও আমি একটা গাছ, এ বার তোমরা আলাদা করে আমায় ক্রিপার হয়ে দেখাও। আমার বান্ধবী আপত্তি জানায়। ফলে পরিচালক যে তাঁর পরের ছবিতে আমার বান্ধবীকে আরও ভাল চরিত্রের প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন তা আর হয় না। অন্য যারা ক্রিপার হতে পারে তারা কাজ পায়।

পরিচালকের সঙ্গে চুমুর দৃশ্য অভ্যেস করলে কাজ পাকা

আমার বান্ধবীর প্রথম ছবি, যে জন্য সে ওই পরিচালকের ওয়ার্কশপ করতে গিয়েছিল, সেখানে একটা চুম্বন দৃশ্য ছিল। এই বিষয়টা আরও শকিং। ওয়ার্কশপে তিনি চুম্বনদৃশ্য অভ্যেস করতে করতে বান্ধবীর খুব কাছে চলে এসে বলেন, ‘‘এ বার তা হলে চুমুটা খাই?’’ ও তখন শক্ড হয়ে দূরে সরে যায়। পরিচালকের চুমু খাওয়া হয়নি। তখন যে মেয়ে বলবে, হ্যাঁ, চুমুটা আমি খেতে পারি সে নেক্সাসে ঢুকে যায়। তার একের পর ছবির কাজ আসে। আসলে সিস্টেমটা এ রকমই। কোনও এক জন পরিচালক বা অভিনেতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি নিজে দেখেছি, এই চুমু খাওয়ার জায়গায় এক জন অভিনেত্রী বলবে, আমি চুমুটা পরিচালকের সঙ্গেই অভ্যাস করব। সবাই মিলে যদি এই সব ক্ষেত্রে না বলা যেত তা হলে কাজ বন্ধ হত। তবেই একটা শিক্ষা দেওয়া যেত। যদিও তা হওয়ার নয়।

আরও পড়ুন: সে দিনের মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগী, আজকের এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে চেনেন!

যা হয়েছে সেটা হল, বার বার আমার কাজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রযোজক চেয়েছেন, আমি না, ঠিকমতো কথা বলতে না পারা স্টার কিড ছবিতে কাজ করবে। আমার কস্টিউমের মাপ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল! তাতে কী?

৯৯ শতাংশ এক হলেও এই বৃত্তে এক শতাংশ ব্যতিক্রম আছেন। তাঁদের জন্য দেবলীনা দত্ত বেঁচে আছে। তাঁরা ব্যতিক্রম বলে মাফিয়া হাউজে তাঁরা ঢুকতে পারবেন না। ওই হাউজগুলোয় ঢুকতে গেলে এক ধরনের কথা বলা, পোশাকে চাকচিক্য থাকতেই হবে। আমরা কারও সঙ্গে দেখা হলে বলি, ‘কেমন আছো’, ওরা বলবে, ‘হ্যালোউ’। হ্যালো-র মধ্যেও ইঙ্গিত থাকে। ওটার মধ্যে না ঢুকে আমরা নন রুলিং পার্টি হিসেবে কাজ করেছি। যাঁরা কাজ করিয়েছেন তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood Debolina Dutta Nepotism Casting Couch
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy