ঋত্বিকদার মৃত্যুদিনে অনেক স্মৃতি মনের মধ্যে ভিড় করছে। কারণ, দাদার হাত ধরেই আমার সিনেমা জগতে প্রবেশ। সেই ছবির নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সব কথা লিখে বোঝাতে পারব কি না, জানি না। আমার বয়স হয়েছে। তবে এটুকু বলতে পারি, দাদার সঙ্গে কাটানো যাবতীয় স্মৃতি আমার মনে আজও টাটকা।
আরও পড়ুন:
দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হয় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আমি তখন সরকারি চাকুরে। এ দিকে নিয়মিত নাটক করি। তখন বাংলাদেশের নাটকে বিপ্লবের প্রভাব। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিয়মিত নাটক করা হচ্ছে। সেই নাটকগুলো মূলত পরিচালনা করতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি ছিলেন আমার গুরুস্থানীয়। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর এই ছবিটার কাজ যখন শুরু হয়, তখন সেখানে জড়িত ছিলেন হাসান ভাই। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় তিনি আমাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। আমার ইচ্ছে ছিলই। তার পর জানতে পারলাম, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক! সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। কারণ, সেই সময়ে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন আমাদের আইকন। তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘সুবর্ণরেখা’র মতো ছবি আমরা তত দিনে দেখে ফেলেছি।
হাসান ভাই আমাকে পরদিন নিয়ে গেলেন পুরনো ঢাকার হাবিবুর রহমানের কোনও একটি বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম, ঋত্বিকদা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে রয়েছেন। যত দূর মনে পড়ছে, তাঁর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট বা বিড়ি। আলাপ পর্বের পর হাসানভাইকে দাদা বললেন, ‘‘এডারে কাল এফডিসিতে (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন) লইয়া যাস।’’ দাদা আর কিছু বললেন না দেখে আমি একটু হতাশই হলাম।
পরদিন এফডিসিতে গিয়ে দেখলাম ঋত্বিকদা আউটডোর শুটিং করছেন। আমাদের দেখে হাসলেন। তার পর মেকআপ ম্যানকে বললেন, ‘‘এই ছেলেডার মাথায় একটা উইগ পরায়ে দাও তো। আমি একডু ঘুইরা আসতেছি।’’ তখন আমার বয়স ২৫ বছর। কিন্তু মাথায় চুল কম ছিল। আমি তৈরি। আধ ঘণ্টা পর দাদা ফিরে এলেন। আমার মুখটা ধরে এ দিক-ও দিক থেকে দেখলেন। তার পর উইগটা খুলে ফেললেন। দিয়ে বললেন, ‘‘চুল ছাড়াই ভাল লাগতাসে। পাশ...!’’ আমিও পাশ করে গেলাম।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
তার পর আরিচা ঘাটে শুটিংয়ের ডেট। তখন আমি সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। ছুটি নিয়ে ফ্লোরে গেলাম। প্রথম দিন দেখলাম, শুটিং হল না। আবার এক দিন গেলাম। সে দিনও আমার দৃশ্যের শুটিং হল না। আমি দাদাকে বললাম যে, আমি তো আর ছুটি নিতে পারব না। জলবণ্টন বিভাগের কর্মী আমি। আপৎকালীন পরিষেবা। তাই ঘন ঘন ছুটি পাওয়া মুশকিল। দাদা শুনে বললেন, ‘‘নায়িকাকে জলে ভেজানোর একটা দৃশ্য নিয়ে আমি ব্যস্ত। দেখছি, আজকেই যদি তোমার শুটিং করতে পারি।’’ আমিও খুশি হলাম। কিছু ক্ষণ পরে দাদা ডেকে বললেন, ‘‘আজ হইব তোমারডা।’’
দৃশ্যটা ছিল রোজ়ীর (অভিনেত্রী রোজ়ী আফসারী) পিছু পিছু আমি কবিতা বলতে বলতে হাঁটছি। তার পরে ঘড়া মাটিতে রেখে আমার গলায় টান দিয়ে পাঞ্জাবি ছেঁড়ার একটা দৃশ্য ছিল। শট শেষ হল। সকলেই খুব প্রশংসা করলেন। এ দিকে আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া। রোজ়ীর নখের আঁচড়ে আমার বুক ছড়ে গিয়েছে, রক্ত বেরোচ্ছে। দাদাকে গিয়ে বিষয়টা বললাম। দাদা হেসে রোজ়ীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘‘শক্তিশালী অভিনেত্রী!’’ এমনই ছিল দাদার রসবোধ।
তার পরেও শুটিং করেছিলাম আরও দিন চারেক। তিনি যে ঋত্বিক ঘটক— সেটাই আমাকে কোনও দিন বুঝতে দেননি। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। শুটিংয়ের মাঝেই দাদা তখন বেশ অসুস্থ। ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় আমার নাটকের প্রশংসা পড়ে, দাদা আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘‘তুমি যে মঞ্চে অভিনয় করো, আমাকে তো জানাওনি!’’ আমি বললাম যে, নিজের প্রশংসা নিজের মুখে করা ঠিক নয়। শুনে হাসলেন। তার পর বললেন, ‘‘তোমারে একডা কথা কই। নিজের ঢোল নিজে পিটাইবা। অন্যেরে দিলে কিন্তু ফাডাইয়া ফেলব!’’
শুটিংয়ের পর ঢাকাতেই ছবির ডাবিং শুরু হল। দাদা বলেছিলেন, আগে যদি জানতেন যে আমি মঞ্চে অভিনয় করি, তা হলে আমার চরিত্রের দৈর্ঘ্য আরও বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু দাদার সঙ্গে কাজ করে আমার তত দিনে স্বপ্নপূরণ হয়ে গিয়েছে। বললাম, “বড় চরিত্র চাই না, আপনার সঙ্গে যেটুকু কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে, সেটাই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে।” সত্যিই অত বড় পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও দাদার থেকে আমি অনেক স্নেহ এবং ভালবাসা পেয়েছি।
আরও পড়ুন:
মানুষটা ছিলেন চূড়ান্ত অগোছালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ আমাকে স্পর্শ করেছিল। সহকারীর সঙ্গে দাদার ঝগড়া। সহকারীকে বললেন, ‘‘হায়াতেরে স্ক্রিপ্টটা দাও।’’ এ দিকে সহকারী জানালেন যে, দাদা তাঁকে চিত্রনাট্যই দেননি। দাদা সেটা হারিয়ে ফেলেছেন! শেষে রেগে গিয়ে দাদা কাগজ ও কলম চেয়ে নিলেন। ঝড়ের গতিতে দৃশ্যটা লিখে ফেললেন। অবাক হয়ে গেলাম। তাঁর থেকে অভিনয় শিখেছি। কাজের ধরন শিখেছি। মেকআপ করা শিখেছি। পরবর্তী জীবনে আমি তিন দশক পরিচালনার কাজ যখন করেছি, তখন দাদার শিক্ষা আমাকে সাহায্য করেছে।
অভিনেতা হিসেবে ঋত্বিকদার হাত ধরে আমার অভিনয় জীবনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে আমি গর্বিত। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মুক্তি পাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই রাজেনদা (পরিচালক রাজেন তরফদার) আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁর ‘পালঙ্ক’ ছবিতে আমি সুযোগ পেলাম। শেষের দিকে ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। পত্রপত্রিকা মারফত এবং কলকাতার কেউ ঢাকায় এলে দাদার খবর নিতাম। তখন তো মোবাইল ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকত।
ঋত্বিকদাকে বাংলাদেশ ভুলে যায়নি। তাঁকে আমি এখনও মিস্ করি। রেডিয়োয় তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলাম। পরে পত্রিকায় পড়েছিলাম। মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। ঋত্বিকদার স্মৃতিচারণায় আমরাও এক সময় ছোট ছোট আয়োজন করার চেষ্টা করতাম। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটির পঞ্চাশ বছর পূর্তিতেও একটা বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি সেখানে দাদাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলাম। সম্প্রতি এই ছবির প্রযোজক হাবিবুর রহমানের ৮০তম জন্মদিন পালিত হল। সেখানেও আমরা সকলে দাদাকে স্মরণ করেছি। ঋত্বিকদার অবদান কোনও দিন ভুলতে পারব না।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)