অরোশিখা দে। ছবি: সংগৃহীত।
সম্প্রতি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ’দ্য শেমলেস’ ছবির জন্য ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন কলকাতার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত। ওই ছবিতে ছিলেন আরও এক বাঙালি অভিনেত্রী। যদিও তিনি কলকাতার বাসিন্দা নন, অসমে জন্ম। তবে, কর্মস্থান মুম্বই। দীর্ঘ স্ট্রাগল, কিন্তু জীবনের কঠিন লড়াইয়ের প্রতিটা মুহূর্ত প্রাণ খুলে উপভোগ করেন। অনুপ্রেরণা কঙ্কনা সেনশর্মা। ভবিষ্যতে তাঁর পরিচালনায় আসার ইচ্ছে। বলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা ঠিক কতটা কঠিন, মুম্বই শহরই বা কী দিল তাঁকে এতগুলো বছরে? অকপট স্বীকারোক্তি অরোশিখা দে’র।
প্রশ্ন: ‘দ্য শেমলেস’ জীবনে ঘটার পর কী বদল হল?
অরোশিখা: সকলের কাছ থেকে অনেক শুভেচ্ছা পাচ্ছি। সমাজমাধ্যমের দৌলতে ইতিমধ্যেই লোকে ছবিটার কথা জানতে পেরেছে। বেশ কিছু কাজের প্রস্তাব পাচ্ছি। আরও কিছু ভাল কাজের প্রতীক্ষায় রয়েছি।
প্রশ্ন: অভিনয় জীবনের শুরুটা কী ভাবে, সিনেমার প্রতি বরাবরই কি আগ্রহ ছিল?
অরোশিখা: আমার পড়াশোনা বেঙ্গালুরুর মাউন্ট কারমেল কলেজে। বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়েছি। ছোটবেলায় অভিনয়ের থেকেও নাচটাই বেশি টানত আমাকে। তাই ছোট থেকে শোভনা নারায়ণ, মায়া রাওয়ের কাছে কত্থক শিখেছি। শামাক দাভারের কাছেও নাচ শিখেছি। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় নাটকের সঙ্গে যুক্ত হলাম। তার পর থেকেই অ্যাক্টিংয়ের পোকাটা যেন কামড় দিল। তখন বাবা-মাকে নিজের ইচ্ছের কথা জানাতে তাঁরা বললেন, আগে মুম্বই না গিয়ে বরং অভিনয় শেখাটা দরকার। তখন এফটিআই পুণেতে ভর্তি হই। দু’বছর অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করি। সেটা আমার জীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। তার পর মুম্বই চলে এলাম।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে প্রথম সুযোগ এল কী ভাবে?
অরোশিখা: আমি মুম্বইয়ে আসি ২০০৭ সালে। তখন প্রথম ছবির প্রস্তাব পাই নাগেশ কুকনুরের কাছ থেকে। তার আগে একটা সিরিজ় করেছিলাম ‘উপনিষদ গঙ্গা’ নামের। পরিচালক ছিলেন চিত্রপ্রকাশ দ্বিবেদী। তার পর দিব্যা দত্তের সঙ্গে ‘হার্ট অব ভিন্ডি বাজ়ার’ বলে একটি ছবিতে কাজ করি। এর পর নাসিরুদ্দিন শাহের সঙ্গে ‘চার্লি কে চক্কর মেঁ’ ছবিতে কাজ করি। তার পর কিছু মালয়লম ছবি করেছি। এই এতগুলো বছরে নিজের ‘স্ট্রাগল’-এর প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি।
প্রশ্ন: এই ছবিতে দুই বাঙালি অভিনেত্রী, পরিচালক বুলগেরিয়ান। কাদের দাপট বেশি থাকত?
অরোশিখা: (শুনেই হাসি)। হ্যাঁ, দুই বাঙালি মেয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু আমরা খুব একটা দাপট দেখাতে পারিনি। কারণ অনসূয়ার সঙ্গে প্রথম কাজ। আর শুটিং শুরু হওয়ার আগে আমরা দশ দিনের ওয়ার্কশপ করেছিলাম। ওই ক’টা দিনে পুরো টিমটার সঙ্গে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। ফলত কাজটা ভাল হয়। সেটা ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। তবে সেটে আমরা বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে কথা বলতাম। আর যখন চাইতাম, আমরা কী বলছি অন্যেরা যেন বুঝতে না পারে, তখন একেবারে ঝরঝরে বাংলায় কথা বলতাম। আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম, ‘‘দুটো বাঙালি মেয়ের কথা কেউই বুঝতে পারছে না।’’
প্রশ্ন: ‘দ্য শেমলেস’ ছবির এই সম্মান, অনসূয়ার এই পুরস্কার পওয়াটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র শিল্প ও শিল্পীদের কতটা উৎসাহ দেবে?
অরেশিখা: এত বড় মঞ্চে এ রকম কোনও পুরস্কার পাওয়া এমনিতেই সম্মানের এবং তা যে কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই যথেষ্ট উৎসাহ দেয়। আমরা তো চাই, লোকে আমাদের কাজ দেখুন। বলুন, ‘দেখো কী কাজ করেছে!’ ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটা যখন কানে দেখানো হল, সেই সময় দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল, ছবিটা শেষ হওয়ার পরে দর্শক আমাকে খুঁজছিলেন। আর অনসূয়ার পুরস্কার জেতাটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আর এটা শুধু অনসূয়ার জন্য নয়, সিনেমাটার জন্যও ভাল যে, লোকে আমাদের নিয়ে কথা বলছে।
প্রশ্ন: ছবিটা এখনও ভারতীয় দর্শক দেখে উঠে পারেননি, আগামী দিনে সম্ভাবনা রয়েছে?
অরোশিখা: হ্যাঁ, সম্ভাবনা নিশ্চয়ই রয়েছে। কান চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে এসেছে। আমাদের প্রযোজকেরা চেষ্টা করছেন কোনও ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবিমুক্তির।
প্রশ্ন: ছবিতে আপনাকে কোন চরিত্রে দেখা যাবে?
অরোশিখা: এই চরিত্রটাকে ‘ধূসর’ বলব না। কিন্তু, এই চরিত্রটা ‘অ্যান্টাগনিস্ট’। এই মহিলা পয়সার জন্য যা খুশি করতে পারে। সেখানেই মাঝখানে ঢুকে পড়ে রেণুকা (অনসূয়ার করা চরিত্র)। তার পর আমার পর্দার মেয়ের সঙ্গে একটা সম্পর্ক হয়, যেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না দূর্বা (আরোশিখার চরিত্রের নাম)। এখানে আমার চরিত্রটা শুধুই যে এক মায়ের, তেমন নয়। অনেকগুলো শেড আছে।
প্রশ্ন: অনসূয়ার সাফল্য দেখে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?
অরোশিখা: ভাল লাগছে, একটা ভাল কাজ সব সময়ই প্রশংসার দাবি রাখে। অনসূয়া তার কাজের জন্য যে একা প্রশংসা পাচ্ছে, তেমনটা নয়। আমরাও প্রশংসিত হচ্ছি। ছবিটাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তাই এই পুরস্কারটা একা অনসূয়ার নয়, গোটা ছবির। আর অনসূয়াও সেটাই বলেছে।
প্রশ্ন: আপনি এফটিআইয়ের প্রাক্তনী, মাঝেমধ্যেই তো এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে নানা বিতর্ক শোনা যায়!
অরোশিখা: হ্যাঁ, এফটিআইয়ের ছাত্রছাত্রীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি মনে করি, কোনও জিনিস অপছন্দ হলে তার বিরুদ্ধে সরব হওয়া উচিত। আর যার মনে হয় আওয়াজ তোলার দরকার নেই, সে চুপ করে থাকুক। দুটোর কোনটাতেই সমস্যা দেখি না। আর এ সবের কারণে শিল্প বা শিল্পীর কোনও ক্ষতি হয় বলেও মনে হয় না। সেই দিক থেকে পায়েল কাপাডিয়া একটা উদাহরণ হতে পারে। ও প্রতিবাদ করেছিল এক সময়। কিন্তু ওর সাফল্য কেউ আটকে রাখতে পারেনি। ও কখনও কোনও কিছুতে ভয় পায়নি। যখন কোনও অন্যায় হয়, তখন তো আওয়াজ তুলতেই হবে।
প্রশ্ন: আগে বিদেশের মাটিতে সম্মানিত হলেই তবে কি ‘দ্য শেমলেস’-এর মতো ছবিকে নিয়ে দেশে চর্চা হয়?
অরোশিখা: যে কোনও সম্মানই খুব দরকার। সেটা দেশে হোক কিংবা বিদেশে। আর কানের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মান পাওয়া সত্যিই গর্বের। কোনও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি বড় কোনও মঞ্চে সম্মানিত হলে ছবিটার সঙ্গে তার কলাকুশলীরাও তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সম্মান পান। কারণ, এই ধরনের ছবিতে নামী তারকারা থাকেন না। যাঁরা থাকেন, সবাই নিজের ২০০ শতাংশ দিতে চান। কারণ তাঁরাও চান, দর্শক তাঁদের চিনে নিন। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এটুকুই চান যে, অন্য সিনেমার মতো তাঁদের ছবিও যেন দর্শক দেখেন।
প্রশ্ন: বলিউডে সাফল্য পাওয়া কতটা কঠিন বলে মনে হয়?
অরোশিখা: আসলে সাফল্য পাওয়ার কোনও ফর্মুলা হয় না। আমি যখন মুম্বই এসেছিলাম, জানতাম যে এই সফরটা খুব সোজা হবে না। আমি গেলাম আর কাজ পেয়ে গেলাম, তেমনটা হয় না। আমি জানতাম, আমাকে স্ট্রাগল করতে হবে। তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম। না হলে প্রতিটা দিন আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে যেত। নিজের ব্যর্থতা গ্রহণ করতে জানতে হবে, না হলে সাফল্য পাওয়ার চাপটা মাথায় চেপে বসবে। তবে স্বপ্ন দেখে যেতে হবে। আমি সেই স্বপ্নটা অনেক কাল আগেই দেখেছিলাম আর আমার ছবি কানের মঞ্চে সম্মানিত হয়েছে।
প্রশ্ন: বলিউডে নাকি তারকা-সন্তানেরাই অগ্রাধিকার পান, তা হলে এত ছেলেমেয়ে রোজ মুম্বই পাড়ি দিচ্ছেন কোন আশায়?
অরোশিখা: এটা ঠিক, তারকা-সন্তানেরা প্রথম সুযোগ পান বলিউডে। আমরা অনেক পিছিয়ে সেই দিক থেকে। তবে স্ক্রিনে যখন আসবে, তখন অভিনয়ই শেষ কথা বলবে। এটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ক্যামেরার সামনে সবই সমান। সে তারকা-সন্তান হোক কিংবা আমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা কেউ...। সবাইকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।
প্রশ্ন: কলকাতায়, বাংলা ছবিতে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে?
অরোশিখা: আমি তো অপেক্ষা করছি, কেউ আমাকে ডাকুক। আমি চাই কলকাতায় কাজ করতে। সুযোগ পেলেই ছুটে চলে আসব।
প্রশ্ন: কাদের কাজ পছন্দ বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে?
অরোশিখা: যে চার জনের আমি ভক্ত, তাঁরা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অতনু ঘোষ, রাজ চক্রবর্তী, অনীক দত্ত। আর অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীকে ভাল লাগে। আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
প্রশ্ন:অভিনেত্রীরা কেউ নেই পছন্দের তালিকায়?
অরোশিখা: আমি কঙ্কনা সেনশর্মার অনুরাগী। তিনি আমার অনুপ্রেরণা। আমার অসম্ভব ভাল লাগে কঙ্কনাকে। আমি ওঁর বাংলা ছবি দেখি, হিন্দি ছবি দেখি। অনেক কিছু শিখি।
প্রশ্ন: কঙ্কনা তো পরিচালক এখন...
অরোশিখা: হ্যাঁ, আমার তো ইচ্ছে, ওঁকে বলি, “ম্যাম, আমি আছি, ভেবে দেখতে পারেন”(হাসি)।
প্রশ্ন: সিনেমার ক্ষেত্রে শরীর প্রদর্শনে কোনও ছুতমার্গ রয়েছে আপনার?
অরোশিখা: অভিনেতা হিসেবে আমার কোনও ছুতমার্গ নেই। সিনেমার প্রয়োজন থাকলে আমার অসুবিধে নেই। তবে দর্শক টানার জন্য শরীর দেখাতে হলে আমার অসুবিধে রয়েছে। এ ছাড়াও, বাইরে থেকে হয়তো এই ধরনের দৃশ্য উত্তেজক মনে হয়। কিন্তু, বাস্তবে এই ধরনের সিন করা ভীষণ ক্লান্তিকর। কারণ, বিভিন্ন ক্যামেরায় বিভিন্ন ভাবে শট নেওয়া হয়। আমিও ছবিতে ‘কিসিং সিন’ করেছি, তবে তার বেশি কিছু করতে হয়নি। তবে, সব সময় পরিচালকের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি।
প্রশ্ন: কান থেকে ফিরে আসার পর সব প্রচার কি শুধুই অনসূয়াকে ঘিরে?
অরোশিখা: না, আমার তেমনটা মনে হয় না। ও যোগ্য, তাই পুরস্কারটা পেয়েছে। কিন্তু প্রচুর নামী সমালোচক আমার কথা উল্লেখ করেছেন, মিতা বশিষ্ঠের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলোই তো অ্যাওয়ার্ডের সমান। আমি যদি এটা ভাবতে থাকি, কে কী পেয়ে গেল, তা হলে তো আমারই ক্ষতি। আমার আনন্দটা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।
প্রশ্ন: আগামী দিনের পরিকল্পনা হিসাবে কিছু ভেবেছেন?
অরোশিখা: একটা প্রশংসা পেয়েছি মানে বাড়ি বসে থাকব, আমি তেমন মানুষ নই। নতুন কাজ পেতে গেলে আবার লড়াই শুরু করতে হবে। আজ থেকে চার বছর পর চাইব, যাতে কঙ্কনার সঙ্গে কাজটা করে ফেলতে পারি।
প্রশ্ন: নিজেকে নিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখেন?
অরোশিখা: স্বপ্ন পূরণ করতেই তো মুম্বইয়ে এসেছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy