‘কারুবাসনা’ নাটকের এক দৃশ্যে কবি জয় গোস্বামী। নিজস্ব চিত্র।
২০১৫ সাল। ‘কারুবাসনা’র প্রথম দিকের শো। মঞ্চে তখনও প্রবেশ করতে দেরি অনির্বাণ ভট্টাচার্যের। অন্তত আধ ঘণ্টা আগে থেকে উইংসের বাইরে চুপ করে বসে আছেন তিনি। সে দিকে চেয়ে রয়েছেন জয় গোস্বামী। ৬২ বছর বয়সে প্রথম বার মঞ্চে উঠবেন, ঈষৎ বুক দুরুদুরু তাঁরও। আর যা-ই হোক, অভিনয় বড় কঠিন কাজ কবি-হৃদয়ে টের পান। কিন্তু উৎসাহ তাঁরও কম নয়। একদৃষ্টে জয় দেখে চলেন অনির্বাণের সাধনা। আর এক শিল্পীর কারুবাসনা। যে টানে তিনিও যে ছুটে এসেছেন পরিচালক অর্পিতা ঘোষের ডাকে। জীবনানন্দ দাশের প্রথম উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়েছেন অর্পিতা, সে-ও তো এই কারুবাসনাতেই। যেখানে এক হয়ে যান সমস্ত শিল্পী। নাটকটিও শিল্পীদের গল্প বলতেই তৈরি।
২০২২ সালের ৩ নভেম্বর। আবারও একাডেমিতে মঞ্চস্থ হবে ‘কারুবাসনা’। মাঝে এতগুলো বছরও নিয়মিত ভাবেই শো হয়েছে। কিন্তু এ বার থাকতে পারবেন না জয় গোস্বামী। একাধিক বার করোনার ছোবলে কাবু হয়ে পড়েছেন এ যুগের জীবনানন্দ। এত দিন নাটকের প্রতি দৃশ্য শেষ হত যাঁর কবিতা পাঠে, তাঁকে বাদ দিয়েই ভাবতে হচ্ছে অর্পিতাকে।
জয় নিজেও কি যন্ত্রণায় নেই? শারীরিক ভাবে উপস্থিত না হলেও এখনও তিনি যে ‘কারুবাসনা’তেই সম্পৃক্ত। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “সেই ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে থিয়েটার দেখি। কিন্তু কখনও ভাবিনি অভিনয় করব। ৬২ বছর বয়সে প্রথম বার মঞ্চে উঠলাম। আমি কি আর পারি? হাত-পায়ের চলন কেমন হয় এ সব বুঝে ওঠা আমার পক্ষে কঠিন। কিন্তু অর্পিতার কথায় না বলতে পারলাম না। রিহার্সালে চলে এলাম। তাতে আমার বেশ লাভই হল। জীবনানন্দকে বুঝতে আরও একটু সুবিধা হল। কিন্তু বয়স হয়েছে এখন। রোগে কাবু হয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই পারি না। তাই এ বারের প্রযোজনায় থাকা হল না। আবার কখনও পারব কি না জানি না।”তবে কোনও কিছুর জন্যই তো ‘কারুবাসনা’ আটকে থাকতে পারে না! নাট্যকার অর্পিতা জানালেন, কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। কেউ দেখতে না এলেও একাই তিনি ‘কারুবাসনা’ দেখে যেতে পারেন যুগ যুগ ধরে।
অর্পিতার কথায়, “কারু হল শিল্প। যাঁরা সত্যিকারের শিল্পচর্চা করেন তাঁদের কাজটা খুব কঠিন হয়। আর পাঁচ জন মানুষ যে ভাবে জীবন কাটান, কারুবাসনার জন্য তা হয়ে ওঠে না। সমাজ শিল্পীকে কী চোখে দেখে? পারিবারিক অবস্থানে তিনি কতটা খাটো হয়ে যান? সে সব ধরা আছে জীবনানন্দের এই উপন্যাসে। বহু বছর এটাকে লালন করেছি। ২০১৪ সালে নাট্যরূপ দিয়েছি। তার পর ২০১৫ সালে প্রথম প্রযোজনা।”
অর্পিতা জানান, নাটকের প্রস্তুতিও ছিল চমকপ্রদ। জয়, নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ, সুজন মুখোপাধ্যায় আর তিনি মিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জীবনানন্দ চর্চা করেছেন। কোনও নাটকীয়তাই ছিল না। আর সেটাই নাটকে তুলে ধরেছেন। সঙ্গে দেবেশের সিনোগ্রাফি। যা গুটিকয়েক ব্লক আর আলো দিয়েই যুগ, সত্তা বদলে বদলে দিতে থাকে। সেই সঙ্গে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সঙ্গীত পরিকল্পনা। যা এক বার শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন অর্পিতা। সেই থেকে একযোগে শুরু ‘কারুবাসনা’।
অর্পিতা বলে চলেন, কারুবাসনাই শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। আজকের সমাজে এত সাফল্যের গল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে কারুবাসনার চরিত্র হেম। কবিতা লিখবে বলে সে আর সব কিছুকে পিছনে ফেলে আসে। এই নাটকে হেমের দ্বন্দ্ব বিশেষ ভাবে স্পষ্ট হয়েছে। একই চরিত্রের এক পিঠ অনির্বাণ ভট্টাচার্য। অন্য পিঠ নীল, ওরফে সুজন। অর্পিতার মনে পড়ে যায় সেই স্মৃতি, যখন সুজন ‘কারুবাসনা’য় বিভোর। অনির্বাণও সদ্য নাম করছেন। এই নাটক থেকে বাদ পড়তে চাইতেন না কেউই। আর এখনও, তাঁরাই হেম। পরবর্তী প্রযোজনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। হেম আউড়ে চলে জীবনানন্দের কবিতা, “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;”।
অর্পিতা জানান, শুধু জীবনানন্দের কবিতা এ নাটকে রয়েছে এমন নয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আছে। জয়ের কবিতাও আছে। জয়ের কবিতা দিয়েই শেষ হয় নাটক। অজিতেশের নাটকের একটা অংশও রয়েছে, যা হেমের মুখে আসে। পৃথিবীর সমস্ত শিল্পীর গল্প আসলে কারুবাসনা। তাঁদের নিজস্ব জীবনদর্শন অর্পিতার কথায়, “ইঁদুরদৌড়ের বাজারে হারিয়ে যাচ্ছে। শিল্পীরা এখন বাজারে বসে আছেন। নাটকের শেষেও লোকে এসে হেমকে জ্ঞান দেয়, কবিতা লিখে কী হবে?’’ কিন্তু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখাতেই যে শিল্পীরা জয়ী। অর্পিতা বলেন, “জীবনানন্দ এত লেখা লিখে যে ট্রাঙ্ক বন্ধ করে চলে গেলেন, কিছু চাইলেন না জীবনের কাছে। জীবন তাঁকে ফিরিয়ে দিল, কিন্তু অনেক বছর পরে। যদি বেঁচে থাকতেন, দেখতেন মানুষের কাছে কী ভাবে পৌঁছে গিয়েছেন।”
অর্পিতা জানান, জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে তিনিই এই নাটকে আসতেন। পরবর্তী সময়ের কবি হিসাবে জয়ের কথা ভেবেছেন। প্রত্যেকটা দৃশ্যের শেষে তিনিই এসে কবিতা পাঠ করে যেতেন। অর্পিতার কথায়, “আমি যেটা রাখতে চেয়েছিলাম সেটা হল পরম্পরা। শিল্পী একক নয়। গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। শিল্পীরা সমাজের কোন জায়গায় থাকবেন তা নিয়ে দেশ চিন্তিত নয়। শিল্পীদের লড়াই চলতেই থাকে। শিল্পীরা যদি হারিয়ে যান, তবে সমাজ সংবেদন হারাবে।”
জীবনানন্দ লিখছেন, “কারুবাসনা আমায় নষ্ট করে দিয়েছে।” কিন্তু বিফল হয়নি অর্পিতার নিবেদন। বললেন, “বিস্মিত হয়ে দেখেছি, মানুষ নাটকটি গ্রহণ করেছেন। বছরে একাধিক শো করি, সবক’টিই দেখতে আসেন বহু মানুষ। আমার দলের অনেকেই বলেছিলেন, এ নাটক কেউ বুঝবে না, দেখবে না। আমি তো দেখি উল্টো!”
সে বার উইংসের বাইরে অনির্বাণের বসে থাকা দেখে মুগ্ধ জয় আরও এক বার বুঝেছিলেন, জীবনানন্দের ম্যাজিক। স্মৃতিমেদুর হয়ে বললেন, “কবিতা বা লেখা বোঝার জন্য এই নৈঃশব্দ্য খুব জরুরি। সেটা যে অভিনেতা উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি যে এক দিন বড় অভিনেতা হবেন, তাতে আর সন্দেহ কী!” বর্তমানে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নিয়ে ব্যস্ত অনির্বাণ ফোন ধরার সময় পান না। তবে জয়ের কথায় ভেসে এল তাঁর প্রস্তুতির দিনগুলির ছবি। অনির্বাণকে বলতে শুনেছিলেন, “আমি দিনের বেশির ভাগ সময়টা চুপ করে থাকতাম। আর একটা কাজ করতাম। কলকাতার রাস্তায় হেঁটে-হেঁটে ঘুরতাম, মানুষ দেখতাম, জনস্রোত দেখতাম।” জয় বলেন, “উনি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু এই কথাটা খুব শ্রদ্ধাযোগ্য মনে হয়েছিল। বয়সে ছোট হলেই যে তাঁকে শ্রদ্ধা করা যাবে না, এমন তো কথা নয়। সেই শ্রদ্ধা আমার এই নাটকের সবার প্রতি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy