Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Film Review

এক অনুতপ্ত স্বামী ও বাবা, ‘বাঁসুরি’র সুরের মতো ভোলা যায় না অনুরাগ কশ্যপকেও

কিছু কিছু দৃশ্যে আবেগের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় তা সামান্য অতি নাটকীয় লাগে। মনে হয়, যা এড়িয়ে গেলে আরও সাবলীল একটা ছবি পাওয়া যেত।

‘বাঁসুরি’র পোস্টার

‘বাঁসুরি’র পোস্টার

ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২১ ১৫:২১
Share: Save:

চা-বাগানের পাহাড়ি উঁচু-নীচু রাস্তার সঙ্গে বাঁশির সঙ্গতে ‘বাঁসুরি’ এক মন ভাল করে দেওয়া শৈশবের গল্প বলে। হরি বিশ্বনাথের প্রথম ছবি ‘রেডিওপেট্টি’-র মতোই এ ছবির মূল আকর্ষণ সারল্য। এক অদ্ভুত সারল্যকে বাজি রেখে হরি সাজিয়েছেন দৃশ্যের পর দৃশ্য- কখনও বৃষ্টি দিনের জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানোর ছবি এঁকে, কখনও বাবুই পাখির বাসায় আবার কখনও সাইকেল চালিয়ে পার করা স্কুল ফিরতি রাস্তায়। আর এই সবকিছুর মধ্যে ‘বাঁসুরি’ সম্পর্কের গল্প বোনে।

ডেভিড আর মদন হরিহর আত্মা- তারা স্কুল যায় এক সঙ্গে, আবার বাবুই পাখির বাসা আবিষ্কারের মতো অমোঘ সুখও উদযাপন করে এক সঙ্গে। ডেভিডের বাবা মিস্টার রোজারিও পারিবারিক সূত্রে চার্চের প্রার্থনা সঙ্গীতে পিয়ানো বাজান। বাবাকে চমকে দিয়ে যখন ডেভিডও অবলীলায় তার অপরিণত আঙুলের যাদুতেই পিয়ানোয় তোলে সুরের মূর্ছনা, গর্ব করে বাবা বলেন- ‘‘ওর রক্তে আছে।’’ দরজার আড়াল থেকে এই উক্তি শুনে ফেলার পর থেকে চতুর্থ শ্রেণির মদনের অসীম কৌতূহল জাগে- তার রক্তে তবে কী আছে? এই বিচিত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দাদু হিমশিম খান, মা মদনের উপর চোখ রাঙায়। অথচ মদনের উপর চেপে বসে তার বাল্য জেদ, তাকে জানতেই হবে তার বাবা কী বাজাত? কারণ তার রক্তেও নিশ্চয়ই তাই আছে!

মদনের বেড়ে ওঠা তার মা স্বপ্না আর দাদু হীরালালকে কেন্দ্র করেই। তার কাছে তার ৮ বছর ধরে জেলবন্দি বাবার পরিচয় দুবাইয়ের চাকুরিরত প্রবাসী হিসেবে। ছেলের প্রশ্নে নাজেহাল হয়ে স্বপ্না সেই সাজানো পরিচয়ে যোগ করলেন আর এক পরিচয়। একটা বাঁশি কিনে এনে ছেলেকে বললেন, তার বাবা দারুণ বাঁশি বাজায়। আসল পরিচয় ও নির্মিত পরিচয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব নিয়েই এগিয়ে চলে ‘বাঁসুরি’-র গল্প। মদন যে বাবার অপেক্ষায় ও অনুপ্রেরণায় রপ্ত করে ফেলে বাঁশি বাজানো সেই ব্যক্তিমানুষ একটি কল্পনা- সে দারুণ বাঁশি বাজায়, সে থাকে দুবাইয়ের মতো মস্ত শহরে। কিন্তু যে বাবা বাস্তবের, সে রাগের মাথায় এব‌ং এক ভ্রাতৃস্থানীয় বন্ধুর প্ররোচনায় মানুষ খুনের মতো গূঢ় অপরাধে জেলের ঘানি টানে। এই দুই পরিচয় কি মিলবে? সে প্রশ্নের উত্তর তোলা থাক দর্শকদের জন্যই। পাওয়ার কাঁচা-মিঠে এক মন ভাল করে দেওয়া গল্প, যা একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে অনায়াসে দেখে আসা যায়।

সবুজ গালিচার মতো বিস্তীর্ণ চা বাগান আর পাহাড়ের কোলে আঁকাবাঁকা মায়াবী পথ বারবার চোখ ধুইয়ে দেয় শান্তিতে। কখনও বাঁশিকে দূরবীন করে তার ভিতর দিয়ে, কখনও চা-পাতার আড়াল থেকে, আবার কখনও দাদুর সেলাই-মেশিনের ফাঁক দিয়ে ধরা একের পর এক কবিতার মতো ফ্রেমে উঠে আসে দাদু-নাতির খুনসুটির সম্পর্ক, মদন-স্বপ্নার স্নেহ ও যত্নের পরিভাষা, ডেভিড ও মদনের মধ্যে জটিলতাহীন বন্ধুত্ব। ক্যামেরার সূক্ষ্ম কাজে এমন কাব্যময় ফ্রেম মুগ্ধ করে বারবার। যদিও কিছু কিছু দৃশ্যে একটাই স্থির ফ্রেম অনেকক্ষণ ধরে থাকায় তা কখনও ক্লান্তিকর লেগেছে- যেমন কারাগারের মদনের বাবা সদাশিবের সঙ্গে স্বপ্না ও হীরালালের কথোপকথনের দৃশ্য।

বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সংসার চালাতে হয় পেশায় ফিজিওথেরাপিস্ট স্বপ্নাকে। কার্যত একজন একা মায়ের মতোই ৮ বছর ধরে মদনকে বড় করা স্বপ্নার ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত দৃপ্ত। মাসুদ আখতার দাদুর চরিত্রে ভীষণ মাননসই, এবং তার দাপুটে অভিনয় দেখে বারবারই মুগ্ধ হতে হয়। ভাল লাগে ডেভিডের বাবার চরিত্রে ড্যানিশ হুসেনকে। মদনের চরিত্রে অঙ্কন মল্লিককে ভারি মিষ্টি লাগে। তার সাবলীল অভিনয়ের পাশাপাশি যথেষ্ট প্রশংসনীয় তার বন্ধু ডেভিডের চরিত্রে দীপ্র সেন, যদিও তার অভিনয়ের জায়গা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপস্থিতিতেও প্রত্যাশিত ভাবে নজর কেড়েছেন অনুরাগ কাশ্যপ- মদনের বাবা সদাশিবের ভূমিকায়। একজন পূর্বতন আসামী এবং অনুতপ্ত স্বামী ও বাবার চরিত্রে অনুরাগ বলা যেতে পারে ছবির না ভোলা চরিত্র হয়ে উঠেছেন।

অভিনয় ও ক্যামেরার পাশাপাশি এ ছবির আর এক রসদ আবহসঙ্গীত। ডেভিডের বাড়িতে পিয়ানোর আমেজ, স্কুল-জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসা লোকসঙ্গীতের সুর, এবং তার সঙ্গে গোটা সিনেমা জুড়ে মদনের বাঁশি- স্বপ্নিল সব দৃশ্যপটের সঙ্গে মিশে তৈরি হয় এক অদ্ভুত কবিতা। দেবজ্যোতি মিশ্রর সুরে অন্বেষা দত্তগুপ্ত ও পাপনের গলায় ব্যবহৃত গান দু’টিও খুব মাননসই।

১ ঘন্টা ৫২ মিনিটের সিনেমা বাঁসুরি তবু কিছু কিছু শট একটু বেশি দীর্ঘায়িত মনে হয়। শৈশবের সারল্যকে খুঁজতেও হরি নির্ভর করেছেন কাগজের নৌকার মতো কিছু চিরাচরিত বহুল ব্যবহৃত ইমেজের ওপ‍র- এখানে ছক ভাঙলেন না তিনি। এছাড়াও, কিছু কিছু দৃশ্যে আবেগের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় তা সামান্য অতি নাটকীয় লাগে। মনে হয়, যা এড়িয়ে গেলে আরও সাবলীল একটা ছবি পাওয়া যেত। তবু, সব মিলিয়ে ‘বাঁসুরী’ শৈশবকে ফিরে পাওয়ার কাঁচা-মিঠে এক মন ভাল করে দেওয়া গল্প, যা একবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে অনায়াসে দেখে আসা যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Anurag Kashyap Film Review Rituparna Sengupta Bansuri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy