‘অমলাদি’র কাছেই অনুরাধা শিখেছিলেন, নাচ বলে আলাদা কিছু হয় না।
১৯৬৬-র ১০ জুন। অনুরাধা লোহিয়ার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন। এই দিনেই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল অমলাশঙ্করের। রবীন্দ্রসরোবরের ভিতরে একটা বড় জায়গা নিয়ে ছিল ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। মায়ের সঙ্গে সেখানে ভর্তি হতে এসেছিলেন অনুরাধা (তখন ফতেপুরিয়া)। অমলাশঙ্কর বসেছিলেন একটা চেয়ারে। পরনে সাদা খোলের কমলা পাড় শাড়ি। সুন্দর করে বাঁধা চুল, তাতে গোঁজা একটা ফুল। নাচ নয়, তাঁর সেই উপস্থিতির মধ্যে দিয়েই যেন প্রকাশ পাচ্ছিল শিল্পী সত্তা। আকর্ষণ।
দশ বছরের ছোট্ট অনুরাধার মনে হয়েছিল এমন সৌন্দর্য তিনি আগে কখনও দেখেননি। দেখলেও এ ভাবে ধাক্কা দেয়নি। সারা জীবন তাঁকে ‘হন্ট’ করে বেরিয়েছে প্রথম দিনের সেই স্মৃতি। আর তাই অমলাশঙ্করের ৯৯তম জন্মদিনের দিন ঠিক ওই রঙের একটা শাড়ি পরে গিয়েছিলেন তাঁকে প্রণাম জানাতে।
এই ‘অমলাদি’র কাছেই অনুরাধা শিখেছিলেন, নাচ বলে আলাদা কিছু হয় না। জীবনের মধ্যেই তা থাকে। “ওঁর ক্লাসটা হত রবিবার সকালে। বলা হত ক্রিয়েটিভ ক্লাস। বাকি তিনটে ছিল ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী। ক্ল্যাসিকাল গুরুজিরা শেখাতেন। কিন্তু অমলাশঙ্করের ক্লাসটা ছিল ‘স্পেশাল’। ওই ক্লাস শুরু হত হাঁটা দিয়ে। ছোট থেকে যদি সুন্দর ভাবে হাঁটা রপ্ত করা যায়, সারাজীবন তার সুফল পাওয়া যায়। আলাদা আলাদা তালে সকলের হাঁটা শুরু হত। কিন্তু একসময় গিয়ে দেখা যেত সকলে একই তালে, একই সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছে।
“বড় বড় জিনিস অনেকেই শেখান। কিন্তু অমলাদি সবার আগে আমাদের সচেতন করে দিতে পেরেছিলেন যে, নাচ আর জীবন আলাদা নয়। তুমি কেমন দেখতে ভুলে গিয়ে খেয়াল রাখ কী ভাবে হাঁটছ, বসছ, কথা বলছ। নাচ হয়তো সারা জীবন তোমরা করবে
না, কিন্তু নাচ তোমাদের ছাড়বে না।’’ বলছিলেন অনুরাধা। তাঁর কথায়: ‘‘অমলাদি আমাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব দিয়ে কী ভাবে নিজেকে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা করে তোলা যায়, সেটাও শিখিয়েছেন।’’ অমলাশঙ্করের ক্লাসে কোনও পরীক্ষা ছিল না। ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার ব্যাপার ছিল না। অনুরাধা জানাচ্ছেন, অমলাদি বলতেন,
কম্পিটিশন যদি কারও সঙ্গে করতেই চাও, তবে নিজের সঙ্গে কর।
খুব সহজে একটা জীবনদর্শনকে অমলাশঙ্কর বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
কল্পনা করা, ভাবা, এই ব্যাপারগুলো অনুরাধা শিখেছেন অমলাশঙ্করের কাছে। ধ্রুপদী নাচ শেখাটা যে কত জরুরি তা তিনি প্রথমেই পরিষ্কার করে দিতেন সকলকে। তাই ১৯৭২ সালে অনুরাধা যখন সেন্টার ছেড়ে ক্ল্যাসিকাল কুচিপুডিকে বেছে নিয়ে শিখতে শুরু করেন, অমলাশঙ্করের কাছ থেকে পাওয়া কল্পনা আর ভাবনার কনসেপ্টকে তিনি কাজে লাগাতেন মঞ্চে পারফর্ম করার সময়। অমলাশঙ্করের সঙ্গে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছেন অনুরাধা। সিকিম, পটনা যাওয়ার কথা মনে পড়ে তাঁর। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ট্রেনে ওঠার পর থেকেই শুরু হয়ে যেত অমলাশঙ্করের কাছ থেকে শেখার পালা। কী ভাবে সবাই মিলেমিশে
কম্পার্টমেন্ট শেয়ার করা হবে, কী ভাবে কস্টিউম ট্রাঙ্ক রাখা হবে, এমন ভাবে সেগুলো রাখা হবে যাতে প্রয়োজন হলে তার উপরে শুয়েও পড়া যাবে। মজা করতে করতে যাওয়া, কোনও বাধার সামনে আটকে না পড়া, এ সবই ছিল অমলাশঙ্করের শিক্ষা।
আরও পড়ুন: ‘কঙ্গনার কেরিয়ারই নেপোটিজমে ভরা’, নাগমার কটাক্ষে পাল্টা আক্রমণ অভিনেত্রীর
অমলাশঙ্কর সব সময় অনুরাধাকে এটাই শেখাতেন যে ‘জীবনের থেকেও বড় হওয়ার চেষ্টা কর’। আর সেটাও এমন ভাবে বলতেন যেন কিছুই না। “ফলে নাচতে গিয়ে শাড়ি পরা, মেক আপ নেওয়া, সবই আমরা ছোট থেকেই নিজেরা করতাম। কেউ আমাদের সাহয্য করতে এগিয়ে আসত না। আমার মনে আছে, আমি বারো বছর বয়সেই এমন সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারতাম যে সকলে অবাক হয়ে যেত।”
আরও একটা খুব বড় ব্যাপার অমলাশঙ্করের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অনুরাধা। “আমরা খেয়ালই করি না কখন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অমলাদি বলতেন ‘একদম সোজা হয়ে দাঁড়াবে’। জীবনের শেষ অবধি নিজেও সেটা করেছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতেন। কী
খাচ্ছেন, কী ভাবে বসছেন, দাঁড়াচ্ছেন সে ব্যাপারে সজাগ। আশি বছর বয়সে উনি নেচেছেনও। ভাবা যায় না! আর উনি আমাদের সকলকে ওঁর মতো করে তৈরি করেছিলেন।’’
আরও পড়ুন: টেকেনি প্রথম বিয়ে, বিবাহবিচ্ছিন্না বন্ধুর সঙ্গেই বর্তমানে সুখের সংসার অরিজিতের
অকপটে বলেন অনুরাধা, “এত সহজে একটা জীবনদর্শনকে উনি বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, ভাবতে আমার অবাক লাগে! উনি নিজে এসেছিলেন ছোট গ্রাম থেকে। ওঁর বাবা সোনার কারবারি ছিলেন। পরে কলকাতায় আসেন। প্রায় ৮০/৯০ বছর আগে ওঁর বাবা মেয়েকে নাচ শেখা এবং নাচ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। না বলেননি। উদয়শঙ্করের সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন নাচ করবেন বলে, বাবা বাধা দেননি। এর থেকে তো বোঝা যায় কত উদার ছিল ওঁর পরিবার। ওঁদের চিন্তাভাবনা।”
অনুরাধা যে দিন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন সে দিন ফোন করে বলেছিলেন, “আজকে তুমি আমায় যা দিয়েছ এর থেকে ভাল কোনও গিফট হয় না।” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় অমলাশঙ্করকে ডি লিট সম্মান জানিয়েছিল। সে দিন অমলাশঙ্কর অসুস্থ ছিলেন। তবু এসেছিলেন। হুইলচেয়ারে তাঁকে মঞ্চে তোলা হয়েছিল। অনুরাধার মনে পড়ে। ‘‘তাঁকে দেখে সকলেরই মনে হয়েছিল তিনি ক্লান্ত। কিন্তু যেই জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, আমরা অবাক হয়ে দেখি অমলাদি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছেন। ওই অসুস্থতার মধ্যেও তাঁর কানে জাতীয় সঙ্গীতের সুর পৌঁছনো মাত্রই তিনি সজাগ। এই ছিল তাঁর জাতীয়তা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy