লম্বা চুল রাখবেন ঠিক করেছেন। কমলা রঙের ফুলছাপ লম্বা ঝুলের জামা। গরমের তাতে চুমুক দিচ্ছেন পেয়ারা আর লঙ্কার শরবতে। স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ঠিক করেছেন নতুন ছবির জন্য একক ভাবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আর দেবেন না। সরাসরি কারণ জানতে চাইলাম।
প্রশ্ন: একক ভাবে আর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেবেন না কেন?
স্বস্তিকা: আমি ঠিক করেছি আমার নতুন ছবি ‘দুর্গাপুর জংশন’-এর পরে আর একক ভাবে আর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেব না। আমি তো ছবি নিয়ে কথা বলব। ছবি নিয়ে সবচেয়ে কম কথা হয়। আমার সাক্ষাৎকারে কেন আমায় অরিন্দম শীল, দিলীপ ঘোষের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে হবে? আশ্চর্য ব্যাপার!
প্রশ্ন: ছবি নিয়ে কথা বা গল্প বললে মানুষ তা শুনতে বা পড়তে রাজি নয়...
স্বস্তিকা: তা হলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। ‘দুর্গাপুর জংশন’-এর পর এ রকম ভাবে সাক্ষাৎকার দেব না। আমার অন্য যা কথা বলার আছে বা থাকবে, তা অন্য সময় সাংবাদিকদের ডেকে বলে নেব। ছবির প্রচারের সঙ্গে অন্য বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত মত প্রচার, এটা বন্ধ করব। সাংবাদিকদেরও কিছু করার থাকে না, আমি সেটাও বুঝি। মজা করে আমি তাই বলছিলাম, এই সারা দিন ধরে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে মনে হয় ঠিকে কাজের মতো হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। সাতটা বাড়ির কাজ, সবে দুটো হল। বাকি সব পড়ে আছে।
প্রশ্ন: ‘দুর্গাপুর জংশন’-এ কাজ করলেন কেন?
স্বস্তিকা: আমি এই ছবিতে মা নই। যদিও এই ছবিতে আগে করেছি। তার পর বিভিন্ন রকমের মায়ের চরিত্র করে ফেলেছি। এই ছবিতে মাতৃত্ব নেই, সন্তান নেই, তাদের সমস্যা নেই। এই ছবির গল্প আলাদা। ওষুধ খেয়ে মানুষ মরে যাচ্ছে। প্রাথমিক কিছু ওষুধ। ভিটামিন। বড় শহরে এমন ঘটনা ঘটলে চোখে পড়তেই অনেক সময় চলে যাবে। কিন্তু শহরতলিতে হলে চট করে চোখে পড়বে। আমি জানি না, বাংলায় ওষুধ নিয়ে আগে কোনও থ্রিলার ছবি হয়েছে কি না। ছবির গল্প বলবে এর পিছনে কে বা কারা।
প্রশ্ন: বাংলা ছবিতে নতুন মুখের চেয়ে পুরনো মুখের আধিক্য, এর নেপথ্যে কী কারণ?
স্বস্তিকা: বাঁচা গিয়েছে। পুরনো শিল্পীদের কাজ করতে দেখে মনে হয় আমার ৮০ বছর বয়সেও আমার জন্য কিছু চরিত্র থাকবে।
প্রশ্ন: কিন্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুনদের জায়গায় একটা বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে...
স্বস্তিকা: একটা ঘটনা বলতে হবে।
বলুন না...
স্বস্তিকা: অনির্বাণ মাইতি একবার ফেসবুকে লিখেছিলেন, অনেক অল্প বয়সের অভিনেতা, যাঁরা কথা শোনেন, তাঁরা ভাল অভিনয় করেন। কিন্তু তাঁরা নাকি কাজ পাচ্ছেন না। ভাতও জুটবে না তাঁদের। এই লেখা মনে রেখে দিয়েছিলাম। সায়ন্তন ঘোষালের ছবির কাজ যখন এল আমি ভাবলাম ওঁদের কথা। ওখানে অল্প বয়সের অভিনেতার দরকার ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি পরিচালককে বলেছিলাম আমার বয়স কম হলে আমি ওই চরিত্র করতাম। আমার প্রধান চরিত্রের দরকার নেই। সে ভাবে দেখতে গেলে, আমার কম বয়সে বা শুরুর দিকের অভিনয়ে আমি অনেক জায়গায় বলেছি লিড চরিত্র করব না। অন্য চরিত্র করব।

‘দুর্গাপুর জংশন’ ছবিতে বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: যেমন?
স্বস্তিকা: বুম্বাদার ‘তবু ভালবাসি’ ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম। নায়িকা ছিল রিমঝিম গুপ্ত। ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনয় করেছি, প্রধান চরিত্রে ছিল সায়ন্তনী। আমি সেই সময় কিন্তু টেলিভিশনে কাজ করে সায়ন্তনী আর রিমঝিমের থেকে বেশি নাম করে ফেলেছি। তা-ও দ্বিতীয় নায়িকার চরিত্র করেছিলাম। ‘তবু ভালবাসি’তে আমি ক্যানসারে মারা যাই। ‘নায়ক’-এ আমায় পুড়িয়ে মারা হয়। আমি নায়ককে পাইনি।
এখনকার কথায় আসি, আমার কথায় ওই নতুন অভিনেতাদের প্রযোজনা সংস্থা থেকে ফোন করা হয়। অনির্বাণদাকে ফোন করে সব নম্বর নিয়েছিলাম। প্রযোজনা সংস্থা সেই তালিকা দেখে বলল, এরা তো কেউ ফোনই তুলবে না। আমি জোর করলাম। শুনলাম ওই অভিনেতাদের মধ্যে এক জন বলেছে প্রধান চরিত্র ছাড়া সে করবে না। যে বলেছে, সে কী কাজ করেছে? কিছু না! তা হলে এমন একজন নবাগতার জন্য বাংলা ছবির প্রযোজক কেন দু’কোটি খরচা করবেন? আর এক জন বলেছে অডিশনই দেব না। আর এক জন বলেছে চিত্রনাট্য পাঠাতে, পুরো পড়ে ভেবে জানাবে। প্রযোজনা সংস্থা আমায় বলল এদের জন্য এত সময় নষ্ট করা যাবে না। আমি অনির্বাণদাকে বললাম কিছু না করেই এদের এত দেমাক? আমি তো চিত্রনাট্য পড়ি শুধু আমার চরিত্র জানার জন্য নয়, গল্পটার জন্য। তো এদের এ রকম সমস্যা থাকলে, এরা না খেতে পেয়েই মরবে।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম দিকের কাজের সময় কী করতেন?
স্বস্তিকা: আমার কেরিয়ার তো আমি প্রধান চরিত্র দিয়ে শুরু করিনি। আমি এখনও অডিশন দিই। অনেক সময়ই কাজ পাই না। পুরনো লোকদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি কাজ করবে না তো এদের নিয়ে করবে? নতুনদের নিয়ে করবেই বা কী ভাবে? আমি কিছু করিনি আমি লিড ছাড়া করব না, এমন যারা বলে তারা কাজ শিখবে কী করে? দশ মিনিট ইংরেজি বা বাংলায় কথাও বলতে পারবে না। অনির্বাণদাকে বলেছিলাম পুরো বিষয়টা, কারণ ওর জানা উচিত যারা কাঁদছে, তাদের কাছে কাজের খবর এলে তারা কী করে! অর্জুন দত্তের ছবিতেও অনেক নতুন মুখ দরকার ছিল। সেখানেও বলেছিলাম নতুনদের কথা। অর্জুন নাম দেখেই বলল, ওদের খুব নাকউঁচু, ওরা করবে না। অর্জুন আর সায়ন্তন দু’জনেই খুব ভাল পরিচালক। তাদের সঙ্গেও এরা কাজ করবে না। তা হলে মানুষকে আমাদের মুখই দেখতে হবে। আসলে কী জানেন, গ্ল্যামারের পিছনে ছুটলে দর্শক আমার থেকেও দূরে দূরে ছুটবে। এই সব অভিনেত্রী সেটা জানে না।
প্রশ্ন: ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর পর বিক্রম…
স্বস্তিকা: যা দৃশ্য আমি আর বিক্রম ওই ছবিতে করেছি সেটা পেরিয়ে অন্য কোনও দৃশ্য তো আর তৈরি হতে দেখলাম না। এখন বিক্রম আরও পরিণত। নিজের মতো করে চরিত্রকে আঁকছে।
প্রশ্ন: অভিনেতা এবং নায়ক— দুটো ক্ষেত্রেই কি বিক্রম সফল?
স্বস্তিকা: ওই বয়সে ওই জায়গায়, ও ছাড়া আর কিন্তু কেউ নেই। আমি বলতে চাইছি, একটা কাজ বিক্রম না করলে কে করবে? এটাই এই ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা। একটা কাজ ঋত্বিক না করলে সেটা কে করবে? কেউ নেই। টোটা একটা চরিত্র করতে চাইল না। ওঁর জায়গায় কে? ওই বয়স, বুদ্ধি, ওই শরীর নিয়ে সচেতনতা, শহুরে চেহারা— টোটার জায়গা কে? কেউ নেই। খেয়াল করে দেখেছি বিক্রমের অভিনেতা-নায়ক হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, যেমন রণবীর কপূর। আমার ‘পারিয়া’ ছবি নিয়ে বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু বিক্রম কী যে ভাল কাজ করেছে। জ্যাকি শ্রফ, সঞ্জয় দত্তের চেহারা নিয়ে ক’জন আসে? রণবীর কপূর কিন্তু পাশের বাড়ির ছেলে। বিক্রমের নায়কসুলভ বা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চেহারা নয়। ও কাজ দিয়ে সেটা পূরণ করছে।
প্রশ্ন: বাংলা ছবি এখন সাদামাঠা প্রেমের গল্প বলতে ভুলে গিয়েছে?
স্বস্তিকা: আমি এ রকম করতে চাই। মানুষ হয়তো জটিল গল্প বা থ্রিলার, গোয়েন্দা এই সব দেখতে চাইছে। দেখি একটু, এমন ভেবে তো অন্য ধারার ছবি করে কেউ তো দু’কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে না? তবে সৃজিতকে বলেছি প্রেমের গল্প বলতে। ছবি করতে।
প্রশ্ন: কে কে থাকবে তাতে?
স্বস্তিকা: আমাকে আর রাইমাকে নিয়ে করতে পারে। আর অনির্বাণ ভট্টাচার্য। একটা অনুষ্ঠানে প্রেমের চিঠি পড়েছি আমরা। সেটা ভীষণ প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের একসঙ্গে মঞ্চে দেখে মানুষের মধ্যে যা উন্মাদনা দেখলাম তাতে বুঝলাম আমার আর অনির্বাণের প্রেমের রসায়ন লোকে বার বার দেখতে চায়। এই রসায়ন হয়ে আছে। জানি না কেউ এই জুটিকে ব্যবহার করছে না কেন। এর সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। অনির্বাণও এত ভাল একজন অভিনেতা… খিদে রয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: সৃজিত তো প্রেমে পড়ে গান লিখেছেন...
স্বস্তিকা: প্রেমে পড়ে? বাহ! করুক। সৃজিতের প্রেম দীর্ঘজীবী হোক। আমি আর অনির্বাণ এই ফাঁকে ছবিটা করে ফেলি।
প্রশ্ন: আর ওটিটি?
স্বস্তিকা: ‘তাসের ঘর’ আর ‘বিজয়া’ যে ভাবে জাতীয় স্তরে নজরে এসেছে, হইচইয়ের অন্য গল্পে তা হয়নি।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: হইচইতে গার্হস্থ্য হিংসা, মেয়েদের অত্যাচারের গল্প...
স্বস্তিকা: আমি এই বিষয়গুলো দেখতে পারি না। আমি ‘লজ্জা’ দেখা শুরু করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ‘কালরাত্রি’-র ক্ষেত্রেও তাই হল। যে মুহূর্তে দেখলাম নতুন বৌ বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, বর মদ খেয়ে মারছে। ওটা দেখতে পারলাম না। ওখানেই শেষ। ভাল থাকতে চাই। কোনও দৃশ্য দেখে যদি আমার অনুভূতিতে আঘাত করে, তা দেখতে পারি না। আমরা সবাই কোনও না কোনও সময় শারীরিক, মানসিক হেনস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। তাই ওই দৃশ্য নিতে পারি না।
প্রশ্ন: বৃন্দা বসু কী ফিরবে?
স্বস্তিকা: হতেই পারে। সম্ভাবনা আছে।
প্রশ্ন: ‘বিজয়া’ আর ‘নিখোঁজ’ কী ভাবে আলাদা করতে পারলেন?
স্বস্তিকা: দুই ক্ষেত্রেই সন্তানের জন্য হাহাকার আছে। কান্নাও এক। কিন্তু চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের অনুভূতি আলাদা। নিজেই মাঝেমাঝে দেখে ভাবি কী করে করলাম?
প্রশ্ন: নিজের জীবন নিয়ে কী ভাবেন? একা থাকা নিয়ে...
স্বস্তিকা: জোর করে কেউ একা থাকে না। চাই জীবনে ভালবাসা থাকুক। সঙ্গী থাকুক, দিনান্তে যাকে সব বলা যাবে। আমরা সবাই এমন চাই। তবে পাব কি না, তা ঈশ্বর জানেন। এক বছরে একটা উপলব্ধি হয়েছে। কোনও এক মহিলা, যার অনেক গুণ, তার সঙ্গী পাওয়া মুশকিল।
প্রশ্ন: কী করে বুঝলেন?
স্বস্তিকা: আজকাল কাজের জন্য মুম্বই-কলকাতা করতে হয়। ফোনেই যোগাযোগ থাকে সকলের সঙ্গে। সে রকম একজনের সঙ্গে কথা হতে হতে হঠাৎ একদিন সে বলল, ‘আপনি এত ভাল অভিনয় করেন, গান করেন, এত ভাল লেখেন আপনার তো কত গুণ! আমি তো একটা কাজই পারি।’ আমি তখন মজা করে বলি আমি আঁকতে পারি, সেলাই পারি, পুজো-আচ্চার সব কাজ জানি। আসলে আর কী কী পারি সেটাও বলে দিই। তার পরে দেখি কথা বলা কমে আসে… অনেক পারার প্রসঙ্গ এলে কথা কমে যায়। তা হলে বিয়ের বিজ্ঞাপনে পাত্রীর এত গুণের কথা কেন বলা হয়? মহিলার অনেক গুণ কি তবে ভালবাসার সম্পর্কে পুরুষের জন্য সমস্যা হয়ে যায়?