অর্পণ ঘোষাল। ছবি-সংগৃহীত।
‘মেয়েবেলা’ ধারাবাহিক থেকে ছোট পর্দায় পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন অভিনেতা অর্পণ ঘোষাল। আর এ বার অর্ণ মুখোপাধ্যয় পরিচালিত ‘অথৈ’। মঞ্চে ‘অথৈ’-এ অভিনয় করছেন ৭-৮ বছর ধরে। সেই ‘মাইকেল ক্যাসিয়ো’ তথা ‘মুকুল’ চরিত্রেই অভিনয় করলেন বড় পর্দায়। বড় পর্দায় প্রথম কাজ নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি অর্পণ।
প্রশ্ন: মঞ্চ থেকে বড় পর্দায় ‘অথৈ’। দু’টিতেই আপনি জড়িয়ে। কী কী পরিবর্তন দেখলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে?
অর্পণ: মঞ্চে ‘অথৈ’-কে কখনওই অর্ণ মুখোপাধ্যায় ‘পণ্য’ হিসাবে দেখেননি, বলা ভাল, দেখতে হয়নি। এমনই করতে হবে, এ রকম কিছু বেঁধে দেননি। মঞ্চে তিনি নিজেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসেন। অন্যকেও সেই সুযোগ করে দেন। কিন্তু ছবির ক্ষেত্রে তো সেই সুযোগ সব সময়ে থাকে না। ছবির ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন অর্ণদা ও অনিবার্ণদা (ভট্টাচার্য) দু’জনই। শুটের আগেই লোকেশন, পোশাক সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ওরা আগেই প্রস্তুতিটা নেন, তার অন্যতম কারণ দু’জনকেই ক্যামেরার সামনে ও পিছনে দুই জায়গাতেই থাকতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার ‘মুকুল’ চরিত্রটির জন্য আলাদা করে কতটা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
অর্পণ: প্রায় ৭-৮ বছর আগে থেকে মঞ্চে এই নাটকে অভিনয় করছি। নাটক থেকে মঞ্চে আসার ফলে একটা সুবিধা হয়েছে। এই চরিত্রের জন্য প্রস্তুতিটা বহু দিন ধরে হয়ে আছে। তাই চরিত্রটি নিয়ে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস রয়েছে। বাংলা ছবিতে সে সময় থাকে না যে, আলাদা করে একটি চরিত্রের জন্য বহু দিন ওয়ার্কশপ করব।
প্রশ্ন: অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের জন্যই কি এত সহজে বড় পর্দায় সুযোগ পাওয়া সম্ভব হল, যে হেতু ওঁর দলের আপনি নাট্যকর্মী?
অর্পণ: এটা সত্যি, ‘অথৈ’ সিনেমা হল বলেই আমার বড় পর্দায় আসা হল। আমার যা ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল তাতে অভিনেতা হওয়ার কথা ছিল না। আমি নাট্যদল ‘নটধা’-য় গিয়ে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে অভিনয় শিখি। বাইরে কোনও ওয়র্কশপও করিনি। তাই আমার অভিনয়ের পিছনে অবদান পুরোটাই অর্ণদার। যাঁর হাত ধরে মঞ্চে উঠেছি, তাঁর হাত ধরেই বড় পর্দায় এলাম।
প্রশ্ন: অভিনয়ে আসার কথা ছিল না। তা হলে কোন পেশায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল?
অর্পণ: বড় হয়ে কী হব, ছোটবেলায় এগুলি নিয়ে কখনওই ভাবিনি। হঠাৎই ঘুরতে ফিরতে থিয়েটারে আসা আর সেখান থেকেই অভিনয় করা। তবে ক্যামেরার সামনে অভিনয়ের ইচ্ছে সেই ভাবে ছিল না। ভেবেছিলাম, থিয়েটার করব আর ফ্রিল্যান্সে লেখালিখি করব। এখনও কিছু পরিকল্পনা নেই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
প্রশ্ন: থিয়েটারের অভিনেতাদের জন্য বড় পর্দায় আসার রাস্তাটা কি খুব সহজ?
অর্পণ: আমি বুঝেছি, বাংলায় তো অডিশনের পদ্ধতি বা কাস্টিং খোলামেলা ভাবে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগাযোগের উপর নির্ভর করে। ঠিক জায়গায় নিজের কাজ নিয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগের দরকার হয়। যোগাযোগ না থাকলে, প্রতিভা থাকলেও এগিয়ে যাওয়া যায় না। বাংলায় এমনই হয়। এ সব আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
প্রশ্ন: আপনার অভিজ্ঞতা ! সেটি কেমন?
অর্পণ: যে সমস্ত সুযোগগুলি আমি পেয়েছি, সবই থিয়েটার বা অন্য কাজের সূত্রেই। যদি সেই যোগাযোগগুলি না থাকত, আমি হয়তো সেই অডিশনগুলি দিতেই পারতাম না। যাঁদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগই হত না! আমার অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও আমার লড়াইটা হয়তো কলকাতা থেকে দূরের কোনও মফস্সলের বা বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও প্রতিভাধর ছেলের তুলনায় সহজ হয়েছে, এটুকু বলতে পারি।
প্রশ্ন: পর্দার জন্য ‘মাইকেল ক্যাসিয়ো’ তথা ‘মুকুল’ চরিত্রের জন্য আপনাকেই বেছে নেওয়া হল! কেন?
অর্পণ: আমি যখন প্রথম ‘অথৈ’-তে অভিনয় করি, আমার বয়স ২৪। তখন অর্ণদা মনে করেছিলেন যে, এই চরিত্রটা আমি পারব। এখনও সেটাই মনে করেন হয়তো। তাই বড় পর্দায় কাজ। তবে অর্ণদা যদি বলেন, একটি দৃশ্যে শুধুই পিছন থেকে হেঁটে যেতে হবে, আমি সেটিও করতে রাজি।
প্রশ্ন: অর্ণ ও অনির্বাণ দুই বন্ধু। আবার কাজের ক্ষেত্রেও দু’জনেই পেশাদার। মঞ্চে বা পর্দায় অভিনয়ের সময়ে মতবিরোধ হতে দেখেছেন?
অর্পণ: দু’জন সৃজনশীল মানুষ একসঙ্গে কাজ করলে মতপার্থক্য হতেই পারে। মতের বিরোধ হোক। মনের বিরোধ না হলেই হল। ছবির আগে নিজেরা ভাল করে আলোচনা করেছেন। প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর তাই ছবির সেটে গিয়ে আর কোনও মতপার্থক্য হয়নি ওঁদের। যা হয়েছে, তার আগে। ওঁরা এত কাজ এত দিন ধরে একসঙ্গে করেছেন, তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
প্রশ্ন: ‘অথৈ’ নাটকে জাতপাত নিয়ে ভেদাভেদের প্রসঙ্গ রয়েছে। চলচ্চিত্রেও নিশ্চয়ই সেই প্রসঙ্গ আছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টিকে কী চোখে দেখছেন?
অর্পণ: আমরা শহরকেন্দ্রিক জীবনযাপন দিয়ে সবটা বিচার করি। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় গেলে দেখা যায়, জীবন এখনও কী কঠিন! এমনকি শহরেও আজও দেখা যায়, ব্রাহ্মণ মেয়ের জন্য ব্রাহ্মণ পাত্রই খুঁজতে হবে। বিয়ের বিজ্ঞাপণগুলি দেখলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে বিয়ের প্রসঙ্গগুলি এলে বোঝা যায়, আমরা আজও তেমন উদার হতে পারিনি!
প্রশ্ন: সমকামিতার প্রসঙ্গও রয়েছে এই নাটকে। কী মনে হয় ‘সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন’ নিয়ে মানুষ কথা বলতে এখনও দ্বিধা বোধ করেন?
অর্পণ: সমাজমাধ্যম হোক বা বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি এই বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন অনেকেই। তাই অনেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। তাঁরা জানেন, এটা বললেও মানুষ ভাল ভাবে গ্রহণ করবেন না। মানুষ সহজে নিজের কথা বলতে পারবে, সমাজ এমন পরিসর এখনও দেয় না। বলা ভাল, সমাজ ততটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
প্রশ্ন: ‘মেয়েবেলা’ সফল ধারাবাহিক। তার পরে ওটিটি আর বড় পর্দা। টেলিভিশন কি ছেড়ে দিলেন?
অর্পণ: আমার সত্যিই কোনও পরিকল্পনা নেই। আমার নাটকের দল ‘নটধা’র ৫০ বছর। দলে সময় দিতে চাইছি। তাই ছোট পর্দা থেকে আপাতত দূরে আছি। তবে পরবর্তী কালে আবার ফিরব না, এমন নয়।
প্রশ্ন: অর্ণ মুখোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্যের থেকে কী কী শিখলেন?
অর্পণ: অর্ণদাকে ১৩-১৪ বছর হল চিনি। ওঁর শিল্পের প্রতি এক অদ্ভুত নিবেদন আছে। অর্ণদার মধ্যে কোনও ভনিতা নেই। কোনও স্কুলের নাটকের ক্ষেত্রেও যে আবেগ দিয়ে কাজ করছেন, সেই একই আবেগ দেখতে পাই বড় কোনও নাটকের ক্ষেত্রেও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমটা ১০০ শতাংশই থাকে। অনির্বাণদাকে আমি মঞ্চে দেখেছি। আমাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। এমনকি, মঞ্চে মুখ্যচরিত্র না করলেও যে মেধা দিয়ে নিজেকে নিবেদন করেন, দেখে মনে হয়, উনি যে কাজটা করছেন, ওঁর চেয়ে ভাল আর কেউ পারত না। কোনও নাটকে ১০ শতাংশ সুযোগ থাকলেও, সেটাকে কী ভাবে সেরা করে তুলতে হয়, তা শিখেছি ওঁর থেকে।
প্রশ্ন: ‘অথৈ’-এর সেটে দু’জনকে কী ভাবে কাজ করতে দেখেছেন?
অর্পণ: তবে বলি, বাঁকুড়ার ৯ ডিগ্রি ঠান্ডায় সারা রাত ধরে ভিজতে হয়েছে। টানা ১৬ ঘণ্টা শুটিং-এর পরে কখনও মনে হতে দেননি যে, তাঁদের ভাল লাগছে না। একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে রাত তিনটের সময়ে ডোবা থেকে উঠবেন অর্ণদা। তখন ১০-১১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। আমি বলেই ফেলেছিলাম, ‘তুমিই তো পরিচালক। এমন দৃশ্য কেন লিখলে!’ ওই যে বললাম, ‘নিবেদন’! মিলিয়ে নিন এ বার।
প্রশ্ন: আচ্ছা, একটা অন্য প্রশ্ন! থিয়েটারের অভিনেতারা কি শুধুই নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, এমন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান?
অর্পণ: আসলে এটা হয়, কারণ সেই পরিচালকরা নাটকের মঞ্চে অভিনেতাদের কাজ দেখে নিয়েছেন। একসঙ্গে কাজও করেছেন। টালিগঞ্জের পরিচালকরা হয়তো সেই অর্থে নাটকের অভিনেতাদের কাজ দেখেননি। তাই কাস্ট করার কথা ভাবেননি।
প্রশ্ন: সাফল্য দেখে পরিবার কী বলছে?
অর্পণ: তাঁরা খুবই খুশি। ছবির পোস্টারের ছবি তুলে পাঠাচ্ছেন আমায়। ওঁরাও ভাবেননি, নাটক করতে করতে আমি এত দূর চলে আসব।
প্রশ্ন: আপনি বিবাহিত। তাই বলি, নাটক, ছোট পর্দা, ওটিটি ও বড় পর্দার কাজ, এত কিছুর মধ্যে স্ত্রীকে সময় দিতে পারছেন ঠিক করে?
অর্পণ: দেখতে গেলে আমার স্ত্রী আমার থেকে বেশি ব্যস্ত। সোমবার থেকে শনিবার ওর ৯টা-৫টা অফিস থাকে। ও প্রিমিয়ারে যেতে চেয়েছিল। সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
প্রশ্ন: এমন জগতে কাজ করছেন, যেখানে তথাকথিত ‘পদস্খলনের’ বহু সম্ভাবনা। ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে তার প্রভাব পড়ে! এ সব নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কখনও কোনও সমস্যা রয়েছে?
অর্পণ: বিয়ের আগে নবম শ্রেণি থেকে আমরা পরস্পরকে চিনি। যে হেতু আমায় এত দিন ও দেখছে, তাই আমি কী কী করতে পারি, আমি কতটা ভাল, বা খারাপ তা নিয়ে কোনও সন্দেহ তৈরি হয়নি। তবে এটা ঠিকই, আমরা এমন একটা কাজে রয়েছি, যেখানে এমন ‘মন’ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান। আমার তা হয়নি!
প্রশ্ন: ‘মেয়েবেলা’র পরে প্রচুর মহিলা ভক্ত আপনার। স্ত্রী কিছু বলে না?
অর্পণ: দেখুন, ‘পজ়েসিভনেস’ দেবারতির মধ্যে দেখিনি। বরং ও মজা করে বিষয়গুলি নিয়ে। কিছু হলে স্ক্রিনশট নিয়ে দেখায়।
প্রশ্ন: মুম্বইতে গিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হয় না?
অর্পণ: পরিকল্পনা বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই আমার। আমি কিছুই পরিকল্পনা করে করি না। এমনও হতে পারে, মনে হল যে অনেক অভিনয় করা হয়ে গিয়েছে, আর করব না। তবে এটা বলব, আমার লেখার ইচ্ছে আছে। তবে ভাল লিখতে পারি না। সেই দিকে নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করছি। নাটক, চিত্রনাট্য লেখালিখি নিয়েই পরিকল্পনা আছে।
প্রশ্ন: তা হলে কি ভবিষ্যতে অর্ণ ও অনির্বাণের পথই অনুসরণ করবেন?
অর্পণ: পরিচালনা খুব কঠিন কাজ। অনেক কিছু মাথায় নিতে হয়। আমি তো কিছু পরিকল্পনা করতেই পারি না। আর তা ছাড়া অর্ণদা-অনির্বাণদার মেধা অনেক। আমার তেমন নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy