গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রুপোলি পর্দার হাতছানি শহর থেকে মফস্সলে। বাজারে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ‘অ্যাক্টিং স্কুল’। ফলাও করে তার বিজ্ঞাপন এবং প্রচার। কোর্স করলেই মিলবে ইন্ডাস্ট্রিতে ‘সুযোগ’। অথচ একটা সময় ছিল, যখন অভিনেতা তৈরি হত মঞ্চ থেকে। নতুন অভিনেতারা অভিনয় শিখতেন অগ্রজদের অভিনয় দেখে। কিন্তু অভিনয় কি সত্যিই কাউকে শেখানো যায়? নিয়মমাফিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক জন সাধারণ ব্যক্তি কি অভিনেতা হয়ে উঠতে পারেন?
সুদীপ্তা চক্রবর্তী টলিপাড়ার শক্তিশালী অভিনেত্রী। অভিনয়ের পাশাপাশি বিগত তিন বছর ধরে নিজের অ্যাক্টিং স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সুদীপ্তা। টলিউডের প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাদেরও প্রয়োজন মাফিক ওয়ার্কশপ করান তিনি। নতুনদের প্রসঙ্গেই সুদীপ্তা বললেন, ‘‘অভিনয় জিনিসটা নিজের মধ্যে থাকতে হবে। ধরা যাক, আমি খুব ভাল হাসতে পারি। প্রথম বারে অনেকেই কিন্তু হাসতে পারবেন। কিন্তু পরিচালক দশটা রিটেক নিলে তখন দশ বার ওই হাসিটা হাসার জন্য অনুশীলনের প্রয়োজন।’’
অভিনেতা জানেন তাঁর প্লাস পয়েন্ট। তাই তিনি কোন চরিত্রিটি সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারবেন তার একটা সম্যক ধারণা অভিনেতার থাকে। কিন্তু সুদীপ্তার যুক্তি, ‘‘সব চরিত্র তো সে রকম হবে না। অজানা চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে তখন প্রশিক্ষণ কাজে আসে।’’ কথাপ্রসঙ্গেই সুদীপ্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। জানালেন, অভিনয়ের পাশাপাশি পেশাদারি মনোভাব তৈরির প্রশিক্ষণ তাঁর কোর্সের একটি অন্যতম অংশ। বললেন, ‘‘একটা সিরিয়াল হিট। সাফল্য যাতে মাথায় উঠে না নাচে সেটা শিখতে হয়। একই ভাবে একটা হিট সিরিয়ালের পর হাতে কাজ নেই, সেই কঠিন সময়ে নিজেকে ধরে রাখার পদ্ধতিও আমি ছাত্রছাত্রীদের শেখাই।’’
অভিনেত্রী এবং নাট্যকর্মী সোহিনী সেনগুপ্ত দীর্ঘ দিন ধরেই নতুনদের তৈরি করছেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে অভিনয় শেখা সম্ভব সে কথা মেনে নিয়েই সোহিনী বললেন, ‘‘নটী বিনোদিনীকে তো কেউ অভিনয় শেখাননি। কিন্তু উনি মন দিয়ে অসাধারণ অভিনয় করতেন। অভিনেতার কাছে এই মনটাই মূল অস্ত্র।’’ সোহিনীর মতে, অভিনেতার অভিনয় তাঁর আবেগপ্রবণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনের উপর নির্ভর করে। ওয়ার্কশপের মাধ্যমে ছাত্রের প্রাথমিক ভয়টা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন সোহিনী। উদাহরণ দিলেন, ‘‘কোনও বাচ্চা মেয়ে হয়তো আগে কোনও দিন জোরে হাসেনি। কিন্তু ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তাকে সেই হাসিটা শেখানো সম্ভব।’’ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও অভিনয় ক্ষমতাকে আরও উন্নত করা সম্ভব বলে জানালেন সোহিনী। তাঁর কথায়, ‘‘স্কিল শিখে নিলে তখন অভিনেতার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। ফলে সময়ের সঙ্গে সেটা তাঁর অভিনয়কেও প্রভাবিত করে।’’
অভিনয় শিখে এক জন ব্যক্তি তার পর অডিশন দিচ্ছেন, ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম ঘটনা আকছার দেখা যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত অভিনেতারাও এখন কোনও কোনও ছবির শুটিংয়ের আগে ওয়ার্কশপ করে নেন। এর প্রয়োজনীয়তাও ব্যখ্যা করলেন সুদীপ্তা। বললেন, ‘‘এখন ছবির শুটিং হয় দশ দিনে! সেখানে অভিনেতার প্রস্তুতি বা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সময় কারও নেই। তাই তারা আগে থেকে তৈরি হয়ে ফ্লোরে যেতে চাইছেন। সেখানে ওয়ার্কশপ কাজে আসে। এটা তো খুবই ভাল বিষয়।’’
সুদীপ্তা মনে করেন, অভিনয় দেখতে সোজা মনে হলেও তা কিন্তু আদতে সহজ নয়। এর পিছনে দীর্ঘ পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন। সুদীপ্তার ব্যখ্যা, ‘‘ছোটবেলায় বাবা-মা জোর করে গান বা নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিতেন। কিন্তু সেখান থেকে সকলেই কি পরে সফল হয়েছেন? আসলে একটা বয়সের পরে নিজের ইচ্ছে ছাড়া কোনও কিছু শেখা অসম্ভব।’’
সম্প্রতি ‘ছোটলোক’ ওয়েব সিরিজ়ের দৌলতে দর্শকদের কাছে পরিচিত মুখ দামিনী বেণী বসু। দীর্ঘ দিন ধরেই টলিপাড়ায় অভিনয়ের ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন দামিনী। প্রশিক্ষণেরও বিভিন্ন আঙ্গিক আছে বলে জানালেন দামিনী। তাঁর কথায়, ‘‘এনএসডির স্ক্রিনিং টেস্ট এবং আইআইএম-এর কোনও ছাত্রের প্রেজ়েন্টশনের ওয়ার্কশপ আলাদা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তি যাতে আরও ভাল পারফর্ম করতে পারেন, সে দিকে জোর দেওয়া হয়।’’ দামিনী টলিউডের পাশাপাশি বলিউডেও বিভিন্ন প্রজেক্টে অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করছেন। নতুনদের শেখাতেও তাঁর কোনও ক্লান্তি নেই। বললেন, ‘‘নতুনদের শেখাতে গেলে থিওরি এবং প্র্যাকটিকাল, এই দু’ভাবেই শেখাতে হয়। এক জন পেশাদার অভিনেতাকে কোচ করতে গেলে নিশ্চয়ই আমার অ্যাপ্রোচটা আলাদা হবে।’’
দামিনী বিশ্বাস করেন, যে কেউ ‘পারফর্ম’ করতে পারেন। তাঁর মতে, অভিনয়ের সব খুঁটিনাটি দিকই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রপ্ত করা সম্ভব। তবে সেখানে শর্ত রয়েছে। দামিনী বললেন, ‘‘সে কি চায় শিখতে? সেটাই আসল প্রশ্ন। কেউ যদি শিখতে চায়, তা হলে সে নিশ্চয়ই সময়ের সঙ্গে শিখে নেবে।’’ অভিনয় জগতে কেউ আসেন নিজের ইচ্ছায়, আবার কেউ আসেন পরিস্থিতির চাপে পড়ে। দামিনীর সতর্কবাণী, ‘‘যে পরিবারের চাপে বা প্রযোজকের চাপে অভিনয় শিখতে এসেছে, সে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সে হয়তো অন্য কিছু হতে চায়। তাই আগে নিজেকে বুঝতে হবে তার মনের ইচ্ছে।’’
বর্তমান যুগে মানুষের হাতে সময় কম। চটজলদি সব কিছু শিখে নেওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু স্বল্প সময়ে অভিনয় শিখে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই জানালেন দামিনী। তাঁর কথায়, ‘‘ক্লাসে এলাম না। এ দিকে আমার শুধুই সার্টিফিকেট চাই! এই ভাবে ওয়ার্কশপ করে কখনও অভিনয় শেখা সম্ভব নয়।’’
ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ দিন অভিনয়ের ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী-নির্দেশক সোহাগ সেন। তিনি কিন্তু বিশ্বাস করেন অভিনয় শেখা সম্ভব, তবে শেখানো সম্ভব নয়। সোহাগ স্পষ্ট বললেন, ‘‘অভিনয়ও এক ধরনের বিজ্ঞান। তাই একটু বুদ্ধি দিয়ে নিয়মগুলো অনুসরণ করলে একটা পর্যায় পর্যন্ত অভিনয় করা সম্ভব।’’ ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির অভিনেতারাও এখন পারফরম্যান্স উন্নত করতে ওয়ার্কশপের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছেন। সোহাগের কথায়, ‘‘প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ক্যামেরা বা লাইটের মতো বিষয়গুলো তাঁদের জানা। নিজেদের খামতিগুলোও তাঁদের জানা। সেই খামতিগুলো নিয়ে আমরা গাইড করলে তিনি আরও ভাল অভিনেতা হয়ে ওঠেন।’’ সুঅভিনেতা হয়ে ওঠার চাবিকাঠি অভিনেতা কতটা বুঝতে পারছেন বা কতটা গ্রহণ করতে পারছেন তার উপর নির্ভর করেই বলে মনে করেন সোহাগ।
‘নান্দীকার’-এ প্রতি বছর ছাত্রছাত্রীদের ছয় মাসের বেসিক ওয়ার্কশপ করান সোহিনী। একই সুর তাঁর কণ্ঠেও। বললেন, ‘‘আমাদের এখানে অনেকেই দেখি, ক্যামেরার সামনে লুক নিয়ে মাথা ঘামান। অনেক সময়ে সেটা অভিনয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।’’ আরও বললেন, ‘‘প্রথম তিন মাসে মোবাইল থেকে দূরে থাকা, এসি ছাড়া প্র্যাকটিস, সারা দিনের খাবার সঙ্গে রাখা এবং দিনের শেষে নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে অভিনেতার কাঠামো তৈরির চেষ্টা করা হয়।’’ পরবর্তী তিন মাসে থাকে থিওরি, লাইট, সেট, মেকআপের প্রশিক্ষণ।
অভিনয় যে শেখা যায়, তা এক বাক্যে মেনে নিলেন টলিউডের সব অ্যাক্টিং কোচই। কিন্তু সেটা যে দীর্ঘ দিন ধরে শিখতে হবে তা নিয়েও কারও দ্বিমত নেই। সোহিনী মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘এক জন অভিনেতা কিন্তু স্ট্রাগলার। অভিনয়ের বিভিন্ন কৌশল শিখতে এক জন অভিনেতার সারা জীবন পর্যন্ত লাগতে পারে। কারণ, প্রতিদিন অভিনয়ের মাধ্যমগুলোও বদলাতে থাকে। তাই মন শক্ত করে শেখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy