আপাত ভাবে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ মনে হলেও, ‘অ্যাডোলেসেন্স’ দেখতে বসে, কেন্দ্রীয় চরিত্রের ১৩ বছরের ‘খুনি’ জেমি মিলার, তার বাবা, মা, দিদি এবং তার আশপাশে গজিয়ে ওঠা গোটা জগৎ দেখতে দেখতে বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল আমেরিকান অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার ম্যাক্ক্যান্ডলেসের কথা। যাঁর জীবন নিয়ে জন ক্র্যাকয়ের লেখা বিখ্যাত বই ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’ এবং ওই বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত একই নামের শন পেনের ২০০৭ সালের ছবি। যাঁরা বইটি পড়েননি বা ছবিটি দেখেননি কিংবা ক্রিস্টোফারের কিংবদন্তিপ্রতিম জীবন সম্পর্কে অবগত নন, তাঁদের জন্য সংক্ষেপে ওঁর ঘটনাটি জানাই।
মাত্র ২২ বছর বয়সের অতি মেধাবী তরুণ ক্রিস্টোফার, আমেরিকার আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হয়ে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে জীবনের মানে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে্ন। তার মা কাঁদেন। স্বপ্নে ছেলের ডাক শুনে উঠে বসেন। তাঁর কঠিন বাবা ভেঙে পড়েন রাস্তায়। বোনের মনখারাপ। বছর কেটে যায়। ঘরের ছেলে ঘরে আর ফেরেন না। ও দিকে ঘর ছাড়ার আগে তিনি কেটে টুকরো টুকরো করেছেন তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড। ত্যাগ করেছেন তাঁর প্রিয় গাড়ি। এমনকি, পুড়িয়ে ফেলেছেন পকেটে থাকা সীমিত টাকা। সামাজিক বা সভ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব কিছুকে তিনি ত্যাগ করতে চান। এবং এর পর শুরু হয় তাঁর একলা পথিকের যাত্রা। লক্ষ্য, এই সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ড ও পৃথিবীর মাঝে নিজেকে ও নিজের আনন্দকে জানা, চেনা ও বোঝা। অস্তিত্বের কারণ খোঁজা। এর পর এ দিক সে দিক ঘুরে, নানা মুখের ও অভিজ্ঞতার ভিড় পেরিয়ে তিনি অবশেষে পৌঁছে যান বরফে ঢাকা আলাস্কায়। এবং সেখানে উলঙ্গ প্রকৃতির মধ্যে পড়ে থাকা একটি পরিত্যক্ত বাসে তিনি বাসা বাঁধেন। আদিম যাপনে কাটে সময় ও জীবন। চোখে মুখে ফুটে ওঠে ‘সভ্য’ থেকে ‘অ-সভ্য’ হয়ে ওঠার আনন্দ। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, তিনি বড্ড একা হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। শুরু হয় একাকিত্বের সঙ্গে লড়াই। এবং তার পর একদিন এক দুর্ঘটনার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। একা পাণ্ডববর্জিত আলাস্কার বুকে, তাঁর শেষ নিঃশ্বাসে বিলীন হয়ে যায় জীবনের সব প্রশ্ন। তবু, মৃত্যুর আগে ক্রিস্টোফার এক জায়গায় লিখে যান একটা লাইন— "হ্যাপিনেস ইজ় ওনলি রিয়্যাল, হোয়েন শেয়ার্ড" (সুখ তখনই বাস্তব, যখন তা কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়)।
ক্রিস্টোফার যখন ঘর ছাড়েন, তখন তিনি যদিও জেমির মতো কিশোর নন। যে সময়ের তাঁর বেড়ে ওঠা, তখন সমাজমাধ্যম, ইন্টারনেট কিম্বা মোবাইলের ঘনঘটা ছিল না। তবু যেটা ছিল, তা হল আত্মপরিচিতির খোঁজ। কিশোর থেকে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া যে কোনও তরুণ মনের মধ্যেই যা কি না গাঁথা থাকে। আটের দশকের তরুণ ক্রিস্টোফার সেই খোঁজেই সব ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে প্রকৃতির কাছে গিয়েছিলেন। উত্তরের আশায়। আর আজকের সময়ের, ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর জেমি মিলার বেছে নিয়েছিল তার কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ইন্সটাগ্রাম এবং অবশেষে সেই ছুরিটা। যুগ বদলায়। সময় বদলায়। কিন্তু তরুণ মনের ছটফটানি একই থাকে। সুর্যাভিমুখী লতানে গাছের মতো শরীর, মন ও অস্তিত্ব দিয়ে চারিপাশে অবলম্বন খোঁজে। খোঁজে ওই 'হ্যাপিনেস' বা সুখ এবং খোঁজে কার সঙ্গেই বা তা 'শেয়ার' করবে! আর যা সময়মতো না পেলেই ঘটে বিভ্রাট। যেমন ঘটল জেমির ‘অ্যাডোলেসেন্স’ জীবনে।
ফিলিপ বারান্টিনির পরিচালনায়, জ্যাক থর্ন ও স্টিফেন গ্রাহামের রচনায় এবং ম্যাথিউ লিউইসের সিনেমাটোগ্রাফিতে ফুটে ওঠা ৪৫-৬০ মিনিট দৈর্ঘ্যের মাত্র চারটি এপিসোডে নিয়ে নির্মিত এই মিনি সিরিজ ‘অ্যাডোলেসেন্স’। মুখ্য চরিত্র ১৩ বছরের জেমি মিলার (আওয়েন কুপার), যে গ্রেফতার হয় তার এক ক্লাসমেট কেটি লিওনার্ডকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগে। ব্যস। এটুকুই। এর পর এই সিরিজে যা হয়, সেটাকে গল্প আকারে বলার চেষ্টা করব না। কারণ ‘অ্যাডোলেসেন্স’ -এর উৎকর্ষ গল্পে নয়, নির্মাণে। সিনেমার মাধ্যম ও ব্যাকরণকে নিংড়ে ব্যবহার করা এই সিরিজ় চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষার ক্ষমতার একটি নতুন নিদর্শন। যেখানে ফর্ম এবং ন্যারেটিভ মিলেমিশে একাকার।
একটি খুনকেন্দ্রিক সূত্রে এই সিরিজ়ের চলন শুরু হলেও, কাহিনি প্রবাহের ধারা অনুসারে, এটি 'হুডানইট' নয়। বরং নির্মাতারা প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এটি একটি 'হোয়াইডানইট' এবং 'হাউডানইট'। ফলে এ সিরিজ় স্রেফ গল্প বলতে মোটেই চায় না, বরং দর্শককে জেমির জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়। এবং নাগপাশের মতো সে জগতের বাস্তব ক্রমশ আমাদের টুঁটি চিপে ধরে। ফলে আবার বলি, এ সিরিজ না দেখলে বোঝা বা বোঝানো মুশকিল। অনুভব করানো মুশকিল শব্দ বা বাক্য দিয়ে। কারণ, এই সিরিজ অনুভূতির। এ সিরিজ অভিজ্ঞতার। অথচ নিবিড়। টানটান গতিময় ছন্দে বাঁধা। গিমিকসর্বস্ব নয়, বরং বলা যায়, 'মনোরঞ্জন'-এর বাজারে মনস্তত্ত্বে ডুব।
‘অ্যাডোলেসেন্স’ যেন এক বহুমাত্রিক আয়নাঘর, যার কেন্দ্রে রয়েছে সমকালীন বেশ কিছু বিষয়। বয়ঃসন্ধি, একাকিত্ব, বিষাক্ত পৌরুষ, সমাজমাধ্যমের প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য, অভিভাবকত্বের অপরাধবোধ ইত্যাদি। এবং এই সব বিষয়কে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখি আমরা বিভিন্ন আয়নায়। আর প্রতিটি এপিসোড এবং তার নানা চরিত্র ও অনুষঙ্গ যেন এক এক রকমের আয়না। কখনও সে আয়না একজন পুলিশ অফিসারের চোখ,যে কি না নিজেও একজন বাবা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে লড়ছে। কখনও সে আয়না আবার একজন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর, যে তার প্রিয় বান্ধবীর খুনের পর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে স্কুলঘরে বসে। আবার সে আয়না কখনও একজন ফরেনসিক সাইকোলজিস্ট, যিনি কেঁপে কেঁপে ওঠেন ‘মাত্র’ ১৩ বছর বয়সি জেমির হুঙ্কারে। তার পর শেষ এপিসোডে সেই আয়না কখনও জেমির পরিবার তো, কখনও জেমির ১৩ মাসের অব্যবহৃত বিছনার উপর পড়ে থাকা তার নিঃসঙ্গ ছোট্ট টেডি। আয়না হয়ে ওঠে সংলাপ, জেমির মা-বাবার কথোপকথনও।
তবে এই যে বহুমাত্রিক ভাবে এক ও নানান বিষয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরা, অথচ কোনও রকম গায়ে পড়ে জ্ঞান দিতে আসার ভাব কাটিয়ে, এটা কিন্তু সম্ভব হয় এই সিরিজের ট্রিটমেন্ট এবং নির্মাণের কারণেই, যার ব্রহ্মমূলে রয়েছে বাস্তবতার স্বাদ। রিয়্যালিস্টিক সিনেমা এবং সিনেম্যাটিক রিয়্যালিটি-র বেড়া পেরিয়ে ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর এই রি্য্যাল টাইম ফিকশন, অর্থাৎ যাকে আজকের ভাষায় 'লাইভ স্ট্রিমিং' বলা হয়, তার ঘটনা দেখার অনুভূতিতে, পর্দার চরিত্র, প্রেক্ষিত এবং অনুভূতিগুলি অচিরেই দর্শকের অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়। এবং এসব কিছুই সম্ভব হয়, নির্মাতাদের একটি সিদ্ধান্তে 'ওয়ান শট ফিল্ম' বা 'ওয়ান টেক ফিল্ম'-কে দৃশ্যায়নের ব্যাকরণ হিসাবে নিয়ে নেওয়ার ফলে।
‘অ্যাডোলেসেন্স’ -এর চারটি এপিসোড আসলে চারটি টানা দীর্ঘ শট। প্রতিটি শট নিটোল, শুরু থেকে শেষ অবধি। এর মাঝে না আছে কোনও বিরতি, কোন ‘কাট’ বা সম্পাদনা। এমনকি, নেই কোনও ভিস্যুয়াল এফেক্ট দিয়ে শট জোড়ার প্রয়াসও। নিখাদ দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের এক একখান এপিসোড চওড়া টেক।
পরিচালক বারান্টিনি এবং এই সিরিজের স্রষ্টা থর্ন ও গ্রাহাম চেয়েছিলেন যাতে দর্শকেরা ‘অ্যাডোলেসেন্স’ -এর জগতের ভিতরের একজন সদস্য হয়ে সব কিছুকে দেখতে ও অনুভব করতে পারেন। দর্শক ও চরিত্রদের মধ্যে যেন কোনও 'সিনেম্যাটিক ডিস্ট্যান্স' না থাকে। রিভার্স অ্যাঙ্গল নেই। কাট অ্যাওয়ে নেই। ক্লোজ় আপ নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা গানের গায়ে পড়ে ইমোশান জাগানো নেই। এমনকি, প্রথম এপিসোডে খুনের মুহূর্তের সিসিটিভি-র ক্লিপটি দেখানোর সময়, ল্যাপটপের স্কিনের কোনও ক্লোজ় আপ পর্যন্ত নেই। বরং নিজের ছেলেকে উলঙ্গ হতে দেখা জেমির বাবার মুখের দমফাটা রাগ-যন্ত্রণা-ঘেন্না আছে। ইনফরমেশন, কাট ইনফরমেশনের বদলে বরং এই সিরিজের নির্মাতারা বেছে নিয়েছেন অনুভূতির উপর অনুভূতির ইট গাঁথার ব্যাকরণ। প্রথাগত ক্যামেরা ব্লকিংয়ের বদলে বোধ হয় সেই জন্যই এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয়েছে এই এক শটে তোলা এক একটি গোটা এপিসোডের আইডিয়া।
একটা গোটা শটে পুরো ছবি নির্মাণ না করলেও, লম্বা দৈর্ঘ্যের শটের ব্যবহার ঐতিহাসিক ভাবে কিংবদন্তি পরিচালকেরা করে গেছেন। আলফ্রেড হিচকক, অরসন ওয়েলস বা মার্টিন স্করসেসি বারে বারে এই লং শট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সম্পূর্ণ 'ওয়ান শট ফিল্ম' বলতে সবারই মনে পড়বে 'বার্ডম্যান'-এর কথা। কিন্তু তা ছিল ভিএফএক্স দিয়ে জুড়ে বানানো 'ওয়ান শট'। তবে এস ব নিদর্শন সত্ত্বেও ‘অ্যাডোলেসেন্স’ এই ভিড়ের থেকে আলাদা দাঁড়ায়, কারণ তার এই 'ওয়ান শট' এখানে নিজে একটি চরিত্রে ও ভাষায় পরিণতি পায় এবং এপিসোড এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই ট্রিটমেন্ট সম্ভব ছিল না নিখুঁত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া। শুটিংয়ের বহু আগে প্রস্তুতি শুরু হয় স্ক্রিপ্টিং থেকেই, যেখানে চরিত্রের প্রতিটি চালচলন ছকে ফেলা হয় করিয়োগ্রাফির মতো করে। যে জন্য কাট-বিহীন টানা একটা শট হাওয়া সত্ত্বেও সিরিজের গতি এক মুহূর্তের জন্য মন্থর হয় না। ওটিটি-র টানটান চিত্রনাট্যের থিয়োরি মেনে, দর্শককে কামড়ে রাখে চিত্রনাট্য।
এর পর শুটিংয়ের সময় প্রতিটি এপিসোডের জন্য তিন সপ্তাহ মতো সময় বরাদ্দ করা হয়। প্রথম সপ্তাহ জুড়ে চলে মূলত ব্লকিং এবং অভিনেতাদের মহড়া। শুটিং লোকেশনে অভিনেতারা কী ভাবে কোথায় হাঁটবেন, থামবেন, কথা বলবেন, সব কিছু ছকে নিয়ে চলে রিহার্সাল। দ্বিতীয় সপ্তাহে এই দলে যোগ দেয় ক্যামেরা টিম। এ বার অভিনেতাদের পাশাপাশি ক্যামেরা টিমও রিহার্স করে প্রতিটি মুহূর্ত নিখুঁত ভাবে। এবং তার পর তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় শুটিং।
একটি শটে একটি এপিসোড। গড়ে দিনে দু'টি করে একই এপিসোডের বিভিন্ন টেক শুট করা হয়। এক বার ভুল হলেই পুনরায়। কারণ, মাঝে শট কেটে জুড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে দু-নম্বর এপিসোড শুট করতে ১৩ বার টেক নিতে হয় 'ওকে' টেক পাওয়ার জন্য এবং অবশেষে ওই ১৩ নম্বর টেকের শটটাই আমরা এখন সিরিজ়ে দেখতে পাই। মনে রাখতে হবে, এই এপিসোডে নানান কাস্ট মেম্বার এবং জুনিয়র আর্টিস্ট মিলিয়ে অভিনেতা অভিনেত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৭০ জন এবং এক জনের কোনও ভুল মানেই, আবার প্রথম থেকে টেক নেওয়া। অকল্পনীয় চাপ। এবং এই এপিসোডেরই শেষে সেই ড্রোন শট, যেটা আসলে কাঁধে থাকা ক্যামেরার উপরে। শট চলতে চলতে ড্রোন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুরোটাই চলে এক নিখুঁত ছন্দে। যেন সমসুরে বাজা অর্কেস্ট্রা। কাস্ট কিম্বা ক্রু, একচুল এ দিক ও দিক হলেই আবার গোড়া থেকে শুরু। এবং এ ভাবেই তৃতীয় এপিসোডের ১২ নম্বর টেক, চতুর্থের ১৬ নম্বর এবং প্রথম এপিসোডের ২ নম্বর টেক 'ওকে' হয়।
আর এই পুরো শুটিং সম্পন্ন হয় এ সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফার ম্যাথিউ লিউইস এবং তাঁর সহযোগী দলের তত্ত্বাবধানে। 'ডিজেআই রনিন ৪ডি' নামক ক্যামেরায় একটি মাত্র লেন্সে তোলা হয় গোটা গোটা এপিসোড এক একটি শটে। লোকেশানের নানা স্পটে দাঁড়িয়ে থাকেন নানান ক্যামেরা অপারেটর। দৃশ্য ও চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলে ক্যামেরা। তার পর কখনও এর হাত থেকে ওর হাতে, তো কখনও গাড়ির রিগে বা কখনও ড্রোনে। ম্যাজিকের মতো ক্যামেরার হাত বদলে গাঁথা হয় টানা একের পর এক দৃশ্য মাত্র একটি টানা শটে।
এ তো গেল ক্যামেরার কারিকুরির কথা। এবার আসে অভিনয়। 'অ্যাক্টিং'-এর বদলে 'রিয়্যাক্টিং' এই সিরিজের অভিনেতাদের মূল সুর। প্রায় এক ঘণ্টার টানা শটে এক বার কিছু ভুল হাওয়া মানেই, পুরো ইউনিটকে আবার রিসেট করে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। প্রত্যেক অভিনেতা এ রকমই চূড়ান্ত চাপে পারফর্ম করে গেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই কেন্দ্র চরিত্রে থাকা মাত্র ১৩ বছরের আওয়েন কুপার (জেমি মিলারের চরিত্রে), যে কি না কখনও সিনেমা-টেলিভিশন, এমনকি স্টেজেও অভিনয় করেনি, তাকে সরাসরি অভিনয় করে যেতে হবে টানা ৪০-৬০ মিনিট। এবং সে যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলে, তা চমকে দেয়। এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। তৃতীয় এপিসোডে, জেমি ও ফরেনসিক সাইকোলজিস্ট ব্রায়োনি অ্যারিস্টনের দৃশ্যটির ১২ নম্বর টেক ফাইনাল করা হলেও সেখানে দেখা যায় এক জায়গায় জেমি কথা বলতে বলতে হাই তোলে। স্ক্রিপ্টে সেই হাইয়ের কথা মোটেও ছিল না। সেটি ছিল, ওই দিন বিকেলের দ্বিতীয় টেক। জেমির ভূমিকায় অভিনয় করা ছোট্ট আওয়েন তত ক্ষণে ক্লান্ত, সে বেচারা হাই আর চেপে রাখতে পারেনি। কিন্তু উল্টো দিকের চরিত্রের তাৎক্ষণিক ডায়লগ "অ্যাম আই বোরিং ইউ?" মুহূর্তটিকে স্বাভাবিক করে তোলে!
আরও পড়ুন:
যাই হোক, এত দক্ষযক্ষের ফলাফল কিন্তু মধুর। বর্তমানে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ যে স্রেফ সাড়া জাগানো গ্লোবাল হিট কিম্বা বিশ্বব্যাপী সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োচ্ছে, তা নয়। সিরিজ়টি ইতিমধ্যেই পৃথিবী জুড়ে রীতিমতো একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা সিরিজ়টিকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেছেন। এই শো বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে— কিশোরদের মধ্যে অপরাধের প্রতি ঝোঁক, আধুনিক ব্যস্ত সমাজে পারিবারিক অবহেলার ভূমিকা, সমাজমাধ্যম কী ভাবে নিঃশব্দে টিনএজারদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারতেও নানা ক্ষেত্রে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে! প্রখ্যাত পরিচালক থেকে সেলিব্রিটি মহল এবং সাধারণ মানুষ এই সিরিজ়ের আলোচনায় ও প্রশংসায় মেতেছেন।
গত মাসে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছে যে, ‘অ্যাডোলেসেন্স’ এখন থেকে পাবলিক সেকেন্ডারি স্কুলগুলিতে দেখানো হবে একটি নতুন মিডিয়া লিটারেসি ও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার নিজে সিরিজটির প্রশংসা করে বলেন, "এই সিরিজ়টি আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রাত্যহিক যে সব চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার একটি আবেগপূর্ণ এবং বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।”
সিরিজ়টি শুরু হতেই, পুলিশের হঠাৎ আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ১৩ বছরের জেমির মতো সেই যে আমরাও ধড়ফড় করে উঠে বসি, তার পর থেকে আর আমাদের পালানোর উপায় থাকে না। ক্যামেরা আমাদের বাঁচায় না। যে সব মুহূর্ত অস্বস্তিকর বা কষ্টের, সম্পাদনা সেগুলোকে লুকোয় না। আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়ও না। আমাদের দেখে নিতে হয়। খুঁজে নিতে হয়। আর পর্দার সামনে অসহায়তা নিয়ে বসে থাকতে হয় অপেক্ষায়। ঠিক জেমির পরিবার যেমন বসে থাকে।
শেষ কবে এরকম কোনও সিরিজ় বা সিনেমা বিনোদনের পর্দা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঢুকে পড়েছে, মনে পড়ে না। আসলে, এটাই তো সিনেমার ভাষার কর্তব্য। পর্দার ও পারের আর এ পারের জীবনকে মিলিয়ে দেওয়া। অবলীলায়।