Advertisement
E-Paper

অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কে সংশয়ের আবহে ‘পুরাতন’-এ নতুন হয়ে উঠলেন দুই অভিনেত্রী

সত্যজিতের সেই ‘দেবী’ আবার সুমন ঘোষের পরিচালনায় ফিরছেন বাঙালির আবেগ হয়ে, মুগ্ধতা হয়ে, শিকড় হয়ে। শর্মিলার সেই গহিন মন জানে গঙ্গার চোরাস্রোতের প্রাচীন কথা। জানে অলস দুপুরের মাদকতা।

কেমন হল ‘পুরাতন’?

কেমন হল ‘পুরাতন’? ছবি: সংগৃহীত।

সপ্তর্ষি রায়

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:০১
Share
Save

পুরনো রবীন্দ্র রচনাবলি, চুয়াত্তরের ব্যাঙ্কের পাসবই, আটাত্তরের রূপালি সঙ্ঘের চাঁদার বিল, রিড উপড়ানো হারমোনিয়াম, পুরীর লাঠি, পুরনো রেডিয়ো। এক স্মৃতিভ্রষ্টা বৃদ্ধার পরিসর। এই বৃদ্ধার নাম শর্মিলা ঠাকুর। তাঁর হারিয়ে যাওয়া সময়কে তিনি সমসাময়িক করে রেখেছেন নিজের কাছে। সত্যজিতের সেই ‘দেবী’ আবার সুমন ঘোষের পরিচালনায় ফিরছেন বাঙালির আবেগ হয়ে, মুগ্ধতা হয়ে, শিকড় হয়ে। সেই শিকড়ের বিস্তার ‘পুরাতন’ ছবির গল্পে জড়িয়ে থাকা গঙ্গার পার ঘেঁষা পুরনো বাড়ির শ্যাওলারঙা গাছের নিঃশ্বাসে। শর্মিলার সেই গহিন মন জানে গঙ্গার চোরাস্রোতের প্রাচীন কথা। জানে অলস দুপুরের মাদকতা।

চৈত্র অবসানের মধ্যাহ্ন। সূর্যের আরক্ত রোদ এসে পড়েছে পুরনো কলকাতার বুকে। ভাটার টানে গঙ্গা সরে গিয়েছে ঘাটের সিঁড়ি থেকে অনেক দূরে। কুমোরটুলি পার্কের আমগাছের তলায় ঝরে পড়ছে মুকুল। পার্কের বিপরীতে রঙচটা লাল বাড়িটার বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে। পার্কের রাধাচূড়া গাছটা একেবারে হলুদ হয়ে উঠেছে, পাশের অমলতাসটাও যেমন… আমাদের মনের মতো সেই দুপুরবেলা ফিরে আসে ‘পুরাতন’ দেখতে দেখতে। কী এর অর্থ? সরাসরি বলা যায় না। সবটাই অনুভবের। এ ছবি প্রত্যেক মানুষের প্রাচীন ভাবনাকে জাগিয়ে দেয়।

তবে গল্পে আশপাশের নিকটজনের কাছে শর্মিলা চরিত্রের মন পড়া দুষ্কর। মনে হয় পুরনো সময় নিয়ে তিনি বেশ আছেন। নতুন সব কিছুকেই গ্রহণ করে সচল হওয়ার দায় তো ওই চরিত্রের নেই। কী অনায়াসে, কী নিবিড় অনুভূতিতে, কী পরম মমতায় শর্মিলা গড়ে তুলেছেন চরিত্রটিকে, চোখ সরে না। দেখতেই থাকি। চোদ্দো বছর পর ফিরে এসে বাংলা ছবিতে তিনি যে আবেশ গড়ে তুললেন তা নতুন, পুরাতন নয়।

‘পুরাতন’ ছবির একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত।

‘পুরাতন’ ছবির একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।

পরিচালক সুমনও যোগ্য সঙ্গত করেছেন রুপোলি পর্দায় এই অলীক সৃষ্টিতে। এ ছবি সব কিছু বলে দেয় না। এ ছবির দর্শকের মন যেন আপনা থেকেই নিজের সঙ্গে কথা বলে। শর্মিলা ধরা দেন অদেখা অবয়বে। এক ক্লোজ় আপ শটে শর্মিলা ঠাকুরের বলিরেখা, শিরা-ধমনীর জালবিন্যাস সম্পৃক্ত হয়ে যায় প্রাচীন বৃক্ষের শিকড়ের সঙ্গে। শিরা আর শিকড়ের এই সূক্ষ মেলবন্ধন ভাঙা-গড়ার জীবনবৃত্তকে জীবন্ত করে তোলে। এই গভীর জীবনবোধকে সুমন ঘোষ সেলুলয়েডে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এই ছবি দেখতে বসলে আপনি হারিয়ে যাবেন ‘তেলেনাপোতার’ মতো কোনও এক স্থানে যেখানে বৃহৎ এক জীর্ণ অট্টালিকা, খসে পড়া পলেস্তারা, শিকড়ের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে দুর্গপ্রাকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বলা বাহুল্য, বাড়িটিই হয়ে উঠেছে ছবির একটি চরিত্র, সে-ই যেন মহাকালের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই বাড়ির অলিন্দে ঘটা কত অতীত, কত সুখস্মৃতি, কত বেদনার মুহূর্ত লুকিয়ে আছে যা মাঝেমাঝেই এসে ধরা দেয় এই ছবির মা-মেয়ের স্মৃতিতে। গল্পে মেয়ে ঋতিকা, জামাই রাজীব, পরিচারিকা হীরা শর্মিলা বা বৃদ্ধার এই স্মৃতিবিভ্রমে প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে অনুধাবন করেন আসল সমস্যাটি। তার পর এই গল্পটি হয়ে ওঠে আদ্যন্ত মা আর মেয়ের নিবিড় বন্ধনের গল্প।

বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে চাকুরিরতা ঋতিকা তাঁর মায়ের আদরের মামনি। মায়ের স্মৃতিবিভ্রান্তি কন্যাসন্তানকে উদ্বিগ্ন করে। অগোছালো হয়ে যায় তাঁর জীবন। ভালবাসার মানুষ, পেশায় ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সে। সেই ভালবাসার মানুষের মন আবার তার পূর্বতন মৃতা স্ত্রীর স্মৃতিসহবাসে আটকে। মা আর প্রেম, সম্পর্কের দু’জায়গায় সংশয় নিয়ে লড়াই করে চলে ঋতুপর্ণার চরিত্র। মনের এই ভীষণ লড়াই, সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছে, তার বিভিন্ন অভিব্যক্তি অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা। পুরনো আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটে একান্ত স্মৃতির উপকরণগুলোকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, মায়ের জন্মদিনে মাকে সে সব ফিরিয়ে দিয়ে যে আবেগঘন মুহূর্ত নির্মাণ করেছেন তিনি তা এক কথায় অনবদ্য। যে মুহূর্তে তিনি অস্ফুটে বলে ওঠেন ‘মা ওয়াজ় নেভার আ উওম্যান উইথ মিস্ট্রিজ়’... তখনই মা-মেয়ের অন্তরের সম্পর্কে কোথাও চিড় ধরে। মাকে ঠিক বুঝতে পেরেছে তো মেয়ে?

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

এই ছবিতে ঋতুপর্ণার আরও একটি ভূমিকা রয়েছে। প্রযোজক হিসাবে তিনি সমস্ত চাপমুক্ত থেকে নিজের অভিনয়ে জোর দিয়েছেন, তার ছাপ এ ছবিতে সুস্পষ্ট। তবে নিজের বাড়িতে থাকাকালীন চুলের বিন্যস্ত সাজ না দেখালে আরও একটু সম্পৃক্ত হত চরিত্রটি। নিজের বাড়ির স্টোররুমে বাবা-মা-কুট্টি (ছোটকাকা)-অর্চনাদির (বাড়ির তৎকালীন পরিচারিকা) স্মৃতি রোমন্থনের দৃশ্যটি বড় মায়াময়। মন নরম হয়ে আসে। কান্না পায়।

বার্গম্যানের ‘অটম সোনাটা’ দেখা দর্শক যখন এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে দেখতে বসবেন তখন নিঃসন্দেহে এ ছবিকে আলাদা বলবেন। ব্যতিক্রমী এই কারণে, এই ছবির তন্ত্রীতে বপন করা স্মৃতির পুরাতনী ভাববস্তু যেন এক ধ্রুপদী গাথাকবিতা। রাজীব চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এক জন ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার। ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে রাজীব চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন সুমন। ধৃতিমানের তোলা ছবিগুলিই ব্যবহার করেছেন সিনেমায়। প্রাক্তন মৃতা স্ত্রী পৃথার সঙ্গে যাপন এই চরিত্রকে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। অতীতের না বলা যন্ত্রণা অচিরেই বন্দি হয় রাজীবের বেদনার্ত অশ্রুতে। ইন্দ্রনীল পুরো মাত্রায় সফল এই চরিত্র নির্মাণে। পরিচারিকার ভূমিকায় বৃষ্টির অভিনয় যথাযথ এবং কয়েকটি দৃশ্যে বেশ মর্মস্পর্শী। আদিত্যবিক্রমের সম্পাদনা আর রবিকিরণের সিনেমাটোগ্রাফি এ ছবিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

এই ছবিতে রক্তমাংসের চরিত্ররা যেমন বাঙ্ময়, তেমনই বাঙ্ময় কিছু প্রাণহীন বস্তুও। কালের যাত্রাপথের পদধ্বনি যেন তারাও শুনতে পেয়েছে। একটি বাক্স তার মধ্যে অন্যতম। অনেক না-বলা কথা, ঘটনা তার মধ্যে লুকিয়ে আছে। মনে হল পরিচালক যখন গল্প বলতে বসেছেন তখন না হয় ওই বাক্সকে ঘিরে আরও একটু গল্প আমার মতো অতিসাধারণ দর্শকের জন্য বলতেই পারতেন। ছবির এক সংলাপের কথা মনে থেকে গেল।

‘যে কোনও সম্পর্কেই এক জন আর এক জনকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চায়, আর সেখানেই যত বিদ্বেষ!’ এ যে একেবারে আঁতের কথা, আমার-আপনার সকলের কথা। এখানে এসে এই ছবি হয়ে উঠেছে আত্মআবিষ্কারের ছবি! ধন্যবাদ ‘ভাবনা আজ ও কাল’কে এমন ছবি উপহার দেওয়ার জন্য।

ছবি শেষ হয়। পথে নামি। মনে হয় অনেক দিন নিজেকে খোঁজা হয়নি। ফুটে ওঠে ঋতুপর্ণার মুখ। শর্মিলার প্রাচীনকে আগলে রাখা জীবন। মনে হয় সত্যিই তো আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অতীতের তীর হতে সেই যে দীর্ঘশ্বাস, আমরা কি তা ভুলেই আছি? কোথায় সেই শূন্যতা, যা একদিন কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলবে আমাদের?

New Bengali Film Film Review Rituparna Sengupta Sharmila Tagore

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}