বাপ্পি লাহিড়ি।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সঙ্গীতের বিশেষ ধারা জনপ্রিয় হয়েছিল আমেরিকায়। শহুরে নৈশজীবন থেকে উদ্ভূত এই বিশেষধারার সঙ্গীতে সম্পৃক্ত হয়েছিল ইলেকট্রিক পিয়ানো, সিন্থেসাইজার, ইলেকট্রিক রিদম গিটারের মতো যন্ত্রের সুর মূর্ছনা। যে সুর ‘ফোর অন দ্য ফ্লোর’ রিদম-এ নিবদ্ধ থাকত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
পানীয়ের গ্লাসে চেতনা কিঞ্চিৎ টলোমলো, যৌন আবেদন মূর্ত হচ্ছে শব্দে-ছন্দে-শরীরী বিভঙ্গে। ওই যান্ত্রিক শব্দকল্পে তৈরি হচ্ছে বিশেষ এক মুহূর্ত। যা ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে সদ্য যুবক থেকে কিশোর সমাজে। শরীর দুলছে। দোলা লাগছে মনেও।
অতঃপর, এ হেন ‘ডিস্কো মিউজিক’-এর ভারতীয়করণ জনপ্রিয় হচ্ছে আশির দশকে। ঝিনচ্যাক আলো, রঙিন নাচের মেঝে, চকচকে পোশাক, বেলবটম, চকচকে হেডব্যান্ড, ইলেকট্রনিক যন্ত্রের উপস্থিতি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফোর-ফোর বিটস। চোখ বন্ধ করলে যে যে গান আপনার মনে পড়ছে—তার বেশির ভাগই সদ্যপ্রয়াত বাপ্পি লাহিড়ির সুরে।
বস্তুত, ভারতীয় সঙ্গীতে শব্দবদল বা সাউন্ডস্কেপ পরিবর্তন নিয়ে যে ভাবনা মূলত শুরু করেছিলেন রাহুলদেব বর্মণ, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে, তা আরও সম্প্রসারিত করেন বাপ্পি। রাহুলের পরীক্ষানিরীক্ষার আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় ফিল্মি সঙ্গীত ছিল মূলত সুরনির্ভর বা মেলোডিপ্রধান। সেখানে যে গানের সঙ্গে নাচ ছিল না বা আধুনিক নাচ ছিল না, এমন নয়। কিন্তু সেই নাচ, বা সেই ছন্দ অনেকাংশেই ছিল ধ্রুপদী চিন্তা থেকে উৎসারিত। ধ্রুপদী যন্ত্রের ব্যবহারের সঙ্গে বিভিন্ন রাগাশ্রয়ী সুর ছিল এই ধরনের নাচ-গানের প্রাণভ্রমরা। এ কথা সত্য যে, চল্লিশের দশক থেকে ক্যাবারে নাচ দেখেছে বলিউড। কিন্তু তার সঙ্গে যে সঙ্গীত ব্যবহৃত হত, তা ছিল মূলত পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার অনুকরণ।
ভারতীয় ছবির আবহে এই যে যন্ত্রসঙ্গীত এবং কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার, তাকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছিলেন রাহুলদেব। উদাহরণ হিসাবে শোলের ‘মেহেবুবা, মেহেবুবা’ গানটি এই পরিসরে স্মরণ করা যেতে পারে। রাহুলদেবের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বাপ্পি। বাপ্পির আগে ‘ডিস্কো মিউজিক’ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হলেও ধারাবাহিক ভাবে তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। স্মর্তব্য, এই সাফল্যের মাপকাঠি শুধু জনমনোরঞ্জন নয়, অর্থনৈতিকও।
বস্তুত, সত্তর এবং আশির দশকে যখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের গানের শব্দকল্পে এই বদল আসছে, তখন দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুবিধ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশের প্রাক-মুক্ত অর্থনীতির সাঙ্গীতিক দুনিয়াতেও প্রকাশপাচ্ছে যে লক্ষণ। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাপ্পি তাঁর বিভিন্ন গানে যে সব যন্ত্র ব্যবহার করছেন, তার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সঙ্গীতে এত বিপুল এবং এত ধারাবাহিক ভাবে সেই সব যন্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। দেশের অর্থনীতিক উদারীকরণ পরবর্তী অধ্যায়ে সাধারণ্যে যে সব যন্ত্র সহজে উপলব্ধ হবে। কিন্তু সেই সময়ে ফিল্মি সঙ্গীতে আবহে এই ধরনের যন্ত্র ব্যবহার এক দিকে যেমন ছিল ব্যয় সাপেক্ষ, তেমনই অন্য দিকে, তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল অপ্রমাণিত। বাপ্পি সেই ঝুঁকিটি নিয়েছিলেন। এবং সফল হয়েছিলেন।
তবে, ডিস্কো মিউজিক, ফিউশন করতে গিয়ে যে মূল ধারার সঙ্গীত থেকে বাপ্পি সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়েছিলেন, এমন নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘চলতে, চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রখনা’ গানটির কথা। কিশোরকুমারের কণ্ঠে যে গান এক অনন্য সৃষ্টি। কিশোর নিজে যে গান তাঁর বেশির ভাগ লাইভ অনুষ্ঠানের শেষে গাইতেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘বাপ্পির এই গানের পর অনেক গানের অনুরোধ আসে। কিন্তু আমি তখন সমস্যায় পড়ি। কারণ, এমন একটা গান দিয়েই তো অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়।’’
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্ম অপরেশ লাহিড়ি ও বাঁশরী লাহিড়ির একমাত্র পুত্র অলোকেশের। ছোট থেকে তবলা শিখতেন। যা হয়তো পরবর্তী কালে রিদম বা লয় নির্ভর গানের সুর দক্ষতার সঙ্গে করতে তাঁকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল।
এ কথা অনেকেই স্মরণে রাখতে পারেন যে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাপ্পি মুম্বই পাড়ি দেন। তুতো মামা কিশোরকুমার তত দিনে মুম্বইয়ে নিজের জায়গা পাকা করেছেন। ফলে গোড়ার দিকে লড়াই থাকলেও মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র সঙ্গীতে দুনিয়ায় একেবারে আনকোরা ছিলেন না বাপ্পি।
বাবা এবং মা সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ায় ধ্রুপদী সঙ্গীত থেকে আধুনিক কিংবা শ্যামাসঙ্গীত—নানা ধারার গানের সুর এবং লয় সম্পর্কে তাঁর ছোট থেকেই সম্যক ধারণা হয়েছিল। পরবর্তী কালে যা সঞ্চারিত হয় তাঁর কাজের মধ্যে। যেখানে ‘ডিস্কো মিউজিক’ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ভক্তিগীতি। রয়েছে আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয় আধুনিক গান, ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়’, কিংবা ‘তোমার ঘরের পুতুলগুলো’। এরই পাশে স্থান পেয়েছে ‘অমরসঙ্গী’-র মতো বাংলা ছবি, যার প্রত্যেকটি গানই জনপ্রিয় হয়েছে।
মূলত সুরকার হিসাবে তাঁর পরিচিতি হলেও সেটি তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়, বহু গান তাঁর কণ্ঠেও জনপ্রিয়। ২০২০ সালে তাঁর শেষ গান ‘বাগি- ৩’। শুধু বলিউড নয়, হলিউডে বিশেষ জায়গা ছিল ওঁর। ‘ডিজনি’-র ‘মোয়ানা’ চরিত্রের জন্য যে বিশেষ আবহসঙ্গীত শোনা যায়, তা-ও তো বাপ্পিরই সৃষ্টি।
গা-ভর্তি সোনার গয়না, রাতেও চোখে সানগ্লাস, ঈষৎ স্থূল চেহারা, ঢোলা পোশাক। সদাহাস্যময় ব্যক্তিত্ব টিভির পর্দার রিয়েলিটি শো-এর বিচারক থেকে এফএম রেডিও-র অনুষ্ঠান—সর্বত্রই ছিলেন সপ্রতিভ।
অকস্মাৎ ২০১৪ সালে এসেছিলেন রাজনীতিতে। শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপি-র প্রার্থী হিসেবে। তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যান। তার পর থেকে ধীরে ধীরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসেন।
গত এপ্রিলে করোনা ধরা পড়ে। সেই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে বাড়িও ফেরেন। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ‘অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (ওএসএ)’-তে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন তিনি।
‘ডিস্কো কিং’ নিশ্চয়ই এত ক্ষণে অন্য জগতেও জমিয়ে রয়েছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy