সৌরভ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
টলিপাড়ার তরুণ প্রজন্মের এক জন। কিন্তু ঝুলিতে প্রশংসিত কাজের সংখ্যা একাধিক। অভিনয় থেকে পরিচালনায় আসা। ব্যক্তিগত এবং পেশাদার জীবন পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী সামলে চলছেন সাবলীল ভাবে। মুক্তি পেয়েছে তাঁর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘কেমিস্ট্রি মাসি’। সম্প্রতি এক দুপুরে তাঁর অফিসে কফির আড্ডায় আনন্দবাজার অনলাইনের রেকর্ডারের সামনে অকপট সৌরভ।
প্রশ্ন: ‘কেমিস্ট্রি মাসি’র ভাবনা কী ভাবে বাস্তবায়িত হয়, প্রথমেই সেটা জানতে চাই।
সৌরভ: ‘রাজনীতি’র পর আমি এমন একটা গল্প নিয়ে কাজ করতে চাইছিলাম, যেটা আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। এমন একটা সমস্যা, যার সঙ্গে হয়তো সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশকেও লড়াই করতে হয়েছে। অনেক ভাবনাই ছিল। কিন্তু তার পর আমরা এই বিষয়টা নির্বাচন করি, যেখানে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক জন গৃহবধূ ইউটিইবার হতে চাইছেন।
প্রশ্ন: শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্যা। অঙ্ক বা পদার্থবিদ্যা ছেড়ে রসায়ন। ছাত্রাবস্থায় কি রসায়ন আপনার প্রিয় বিষয় ছিল?
সৌরভ: (হেসে) কেমিস্ট্রিতে ভাল হলে, নিশ্চয়ই আমাকে আর বাণিজ্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হত না। আসলে এটাও আমাদের টিমের সম্মিলিত ভাবনা। সম্পর্ক, প্রেম থেকে শুরু করে খেলা বা রাজনীতি— ‘কেমিস্ট্রি’ বিষয়টা কিন্তু সর্বত্র প্রযোজন। যে নামটা আশপাশের সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে, সে রকম একটা শব্দ বা বিষয়কে নির্বাচন কেন করব না?
প্রশ্ন: বছর দুয়েক আগে দীর্ঘ দিনের বিরতির পর ছোট পর্দায় ফিরেছিলেন দেবশ্রী রায়। এটা তো ওঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ়। ওঁকে রাজি করানো কি সহজ ছিল?
সৌরভ: শুরুতে তিনি রাজি হবেন কি না, তা নিয়ে আমাদেরও একটু সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমরা এমন এক জন অভিনেত্রীর খোঁজে ছিলাম, যাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে, কিন্তু মুখে সেই কাঠিন্যটা নেই। তখন দেবশ্রীদির কথা মাথায় আসে। শহরের একটি ক্লাবে কোনও আশা না নিয়েও ওঁকে চিত্রনাট্য শোনাই। ভেবেছিলাম, কেমিস্ট্রির কচকচানি শুনে শুরুতেই না বলে দেবেন। কিন্তু দেখলাম উনি দিব্যি শুনছেন।
প্রশ্ন: তারপর...
সৌরভ: শেষ হওয়ার পর বললেন, ‘‘আমি এ রকম একটা কাজের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, যেখানে আমি কিছু করে দেখাতে পারব।’’ সত্যি বলছি শুরুতে বিশ্বাস করতে পারিনি। সেখান থেকে অবশেষে সিরিজ়টা মুক্তি পেল। ভাল লাগছে।
প্রশ্ন: ‘টুয়েলভ্থ ফেল’ ছবিটা দেখেছেন?
সৌরভ: আমার দুর্ভাগ্য যে, কাজের চাপে এখনও ছবিটা দেখে উঠতে পারিনি। কিন্তু দেখতে চাই।
প্রশ্ন: শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রসঙ্গ এই সিরিজ়ে রয়েছে। সম্প্রতি আমাদের রাজ্য রাজনীতিতেও তা নিয়ে ঝড় উঠেছে। কখনও মনে হয়েছে যে, সিরিজ়টা আপনাকে কোনও সমস্যায় ফেলতে পারে?
সৌরভ: (কিছু ক্ষণ ভেবে) পৃথিবীতে ‘অরাজনৈতিক’ বলে কিছু নেই। আর আমরা কেউই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নই। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে আমি তো তাদের থেকে কোনও সাহায্য নিই না। তা হলে ভয় পাব কেন! ‘প্রোপাগান্ডা’র বিষয় হলে সেখানে ভয় কাজ করতে পারে। কিন্তু আমার তো সে রকম কোনও উদ্দেশ্য নেই। শিল্পী হিসেবে চারপাশটা তুলে ধরতে চাই। আমার মনে হয়, আমাদের প্রশাসন প্রচন্ড উদার এবং বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। একটা সিরিজ়ে কী দেখানো হল, সেটা নিয়ে তাঁরা বিশেষ একটা মাথা ঘামাবেন না।
প্রশ্ন: ‘সুপার থার্টি’র মতো ছবি বা ‘কোটা ফ্যাক্টরি’ সিরিজ়ও তো বাংলার দর্শক চুটিয়ে উপভোগ করেছেন।
সৌরভ: অবশ্যই। কারণ ওই যে বললাম, এমন একটা গল্প বা সমস্যা যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ নিজেদের মেলাতে পারবেন। এখন শহর থেকে শুরু করে মফস্সল— সব জায়গাতেই অনেকে ইউটিউবে বিনামূল্যে পড়ুয়াদের কোচিং ক্লাস করাচ্ছেন। সাম্প্রতিক অতীতে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর চর্চা শোনা যাচ্ছে। তবে, বাংলায় এই প্রথম এ রকম একটা বিষয় নিয়ে কোনও কাজ হল।
প্রশ্ন: বাংলা ওয়েব সিরিজ় নাকি থ্রিলার আর যৌনতার ভারে ক্লান্ত। আমার মতে এর নেপথ্যে কী কী কারণ রয়েছে?
সৌরভ: যদি বাংলা ওয়েব সিরিজ় কোথাও গিয়ে গতি হারায়, তা হলে তাকে আবার সচল করে তোলাটা আমাদেরই দায়িত্ব। অযৌক্তিক যৌনতা কিন্তু এখন অনেকটাই কমেছে। অন্য দিকে, থ্রিলারের যে একটা নির্দিষ্ট দর্শক রয়েছে, সেটা কিন্তু অনস্বাকীর্য। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে ‘ঝাঁকের কই’ হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তাই শুধু কনটেন্টকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় ভিন্ন স্বাদের কনটেন্ট তৈরির চেষ্টা কি হচ্ছে?
সৌরভ: সকলেই নিজের মতো করে চেষ্টা করছেন। সাম্প্রতিক উদাহরণ দিচ্ছি। তথাগত (পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়) ‘পারিয়া’ ছবিটা তৈরি করল। সৌকর্য (পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল) ‘ভূতপরী’ করেছে।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিলেন। এখন পরিচালনার ভার বেশি। অভিনয় কি ইচ্ছে করেই কমিয়ে দিলেন?
সৌরভ: অভিনয় করতে গেলে তো পরিচালকদের তরফে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়। আমি অভিনয় করতে চাই। কিন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তরটা হয়তো ইন্ডাস্ট্রির প্রযোজক এবং পরিচালকরাই দিতে পারবেন।
প্রশ্ন: অভিনয়ে প্রত্যাশিত সুযোগ না পাওয়ার নেপথ্যে কি আপনার ‘পি আর স্কিল’ দায়ী?
সৌরভ: আমার ওটা বেশ কম। ইন্ডাস্ট্রির পার্টিতেও আমাকে খুব একটা দেখবেন না। ওটাকে অভ্যাসও করতে চাই না।
প্রশ্ন: ৯টা ওয়েব সিরিজ় পরিচালনা করেছেন। অথচ আপনার ঝুলিতে ছবি নেই!
সৌরভ: (হেসে) আমি কোনও কাজে শুরু থেকেই তাড়াহুড়ো পছন্দ করি না। এমন কিছু করতে চাই না, যেটা করার পর মনে হয় যে, এটা না করলেই হয়তো ভাল হত। আপাতত ভাবনাচিন্তা চলছে। এই বছরেই হয়তো ছবি পরিচালনা করব।
প্রশ্ন: তার মানে কি আপনি ‘হিট’ বা ‘ফ্লপ’ নিয়ে চিন্তা বেশি করেন?
সৌরভ: আমার কাজ যেন দর্শক সিরিয়াসলি দেখেন সেটাই চাই। হিট বা ফ্লপ অনেক পরের বিষয়। কিন্তু আমার মনে হয়, শিল্পের এইটুকু দাবি থাকা উচিত, যাতে সেটা মানুষের মনে ছাপ রেখে যেতে পারে। ছাপ না ফেলতে পারলে বুঝব আমি কিছুই করতে পারিনি। দীর্ঘ দিন দর্শকের ভরসা ভাঙতে ভাঙতে আমরা যে জায়গা এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে আমি যেটুকু দর্শকের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি, সেটা সহজে হারাতে চাই না।
প্রশ্ন: আপনার নিজের প্রযোজনা সংস্থা, ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। ‘নতুন’ হিসেবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কতটা কঠিন?
সৌরভ: চারপাশে তো ব্যাঙের ছাতার মতো প্রযোজনা সংস্থা খুলছে। তার মানে নিশ্চয়ই ভাল কাজ হচ্ছে। আমার মনে হয়, এখন নির্মাতা বা অভিনেতাদের জন্য সুযোগ অনেক বেশি। আসলে বিষয়বস্তুর গুণগত মানের লক্ষ্যমাত্রাই আসল। সেটাই ঠিক করে দেয় যে, আমি কোথায় পৌঁছতে চাই।
প্রশ্ন: পরিচালক হিসাবে প্রথম সিরিজ়েই রজত কপূর অভিনয় করছেন। এ রকম সুযোগ তো সকলে পান না!
সৌরভ: (হেসে) তার নেপথ্যেও কিন্তু আমার দীর্ঘ দিনের লড়াই ছিল। নিজের ‘স্ট্রাগ্ল’ নিয়ে গালভরা আলোচনা করতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু এটা সত্যি যে, এমন সময়ের মধ্যে দিয়েও এগিয়েছি, যখন সব ছেড়ে দিতে চেয়েছি। মাসের পর মাস হাতে কোনও কাজ ছিল না, সে দিনও আমি দেখেছি। টিভি ছেড়ে প্রযোজনা সংস্থা শুরু করার পর উপার্জন তলানিতে এসে ঠেকেছিল। জীবনে তখন একটা ‘সাজেশন বই’ নিয়ে কেউ পাশে দাঁড়ালে হয়তো ভাল হত।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় কি প্রকৃত ‘সাজেশন’ দেওয়ার মতো মানুষ আছেন?
সৌরভ: না, নেই। আর থাকলেও সেটা কাজ করে না। জীবনে ধাক্কা খেতে খেতে যে পরামর্শ পাওয়া .যায়, তার থেকে আর বড় কিছু হতে পারে না। জীবনে কান পাতলে সেই জীবন অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়। কিন্তু আমাদের চারপাশে এতই কোলাহল যে আমরা হয়তো কাত পাততে ভুলে যাই।
প্রশ্ন: কোন প্রজেক্ট থেকে মনে হল, যে সঠিক ‘সাজেশন’ পেয়েছেন বা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন?
সৌরভ: (একটু ভেবে) মনে হয় ‘কার্টুন’ সিরিজ় থেকে। তার পরেও বাধাবিপত্তি আসে। ‘ধানবাদ ব্লুজ়’-এর সময় বাবাকে হারাই। তার পর আমার বিবাহবিচ্ছেদ। এ রকম সময়ও গিয়েছে কয়েক বছর ধরে আমরা কোনও সিরিজ় করতে পারিনি। আশপাশ থেকে অনেক কটাক্ষ কানে এসেছে। কিন্তু নিজের একাগ্রতা হারিয়ে যেতে দিইনি। অনেক কিছু পেরিয়ে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
প্রশ্ন: ওই কঠিন সময়ে ইন্ডাস্ট্রির সাহায্য পেয়েছিলেন?
সৌরভ: অনেকের কাছেই সাহায্য চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। এক সময় যাঁরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু এখন আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। তার জন্য আমার কোনও খারাপ লাগা কাজ করে না। বরং নিজে সেটা ভেবে আমার বেশ মজা লাগে। কারণ, প্রত্যাখ্যান এবং লাঞ্ছনা এগুলো জীবনের অংশ। তখন খুব রাগ হত। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, ওগুলো না পেলে হয়তো জেদও বাড়ত না। খুব ভাল কোচকে কিন্তু খুব ভাল তিরস্কার করতে জানতে হয়।
প্রশ্ন: আপনার প্রাক্তন স্ত্রী মধুমিতা সরকার এবং আপনার সম্পর্ক নিয়ে এখনও চর্চা হয়। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
সৌরভ: মাঝেমধ্যে আমাদের যোগাযোগ হয়।
প্রশ্ন: আপনি ওঁর কাজ দেখেন?
সৌরভ: সত্যি বলছি, সব কাজ দেখা হয় না। তবে কিছু কাজ তো অবশ্যই দেখেছি।
প্রশ্ন: কী মনে হয়, মধুমিতা আপনার কাজ দেখেন?
সৌরভ: (হেসে) সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। আমাদের ছোট ইন্ডাস্ট্রি। তাই কে কী কাজ করছে সেটা নিয়ে প্রত্যেকেরই কমবেশি ধারণা থাকে।
প্রশ্ন: আপনি এক সময় বলেছিলেন, মধুমিতার সঙ্গে আপনার অভিনয় করতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি কি ওঁকে কখনও পরিচালনা করতে চাইবেন?
সৌরভ: আজ পর্যন্ত কাজের জায়গায় অন্য কোনও সমীকরণ বা বোঝাপড়াকে আমি কখনও আসতে দিইনি। দর্শকদের প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি। তাই ভবিষ্যতে কোনও কাজে যদি মনে হয়, তা হলে অবশ্যই মধুমিতাকে প্রস্তাব দেব।
প্রশ্ন: অনুরাগীরা তো আপনাদের এখনও একসঙ্গে পর্দায় দেখতে চান।
সৌরভ: জানি। সমাজমাধ্যমে অনেক প্রতিক্রিয়া পাই। যিনি অনুরাগী তিনি তো সেটা চাইবেনই। কিন্তু বুঝতে হবে, কিছু চাইলেই কি সেটা সব সময় সম্ভব হয়!
প্রশ্ন: তারকাদের নিয়ে অনুরাগীদের এই বাড়তি কৌতূহলকে কী ভাবে দেখেন?
সৌরভ: শুধু অনুরাগী কেন। আমরা প্রত্যেকেই আসলে এখন পৃথিবীটাকে একটা ‘বিগ বস্’-এর মতো দেখি। মানুষের যে অংশটা প্রকাশ্যে আসে না, সেটাকেই সকলে জানতে চায়। এটা ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি নিজে সমাজমাধ্যমে কতটা সচল?
সৌরভ: নিজের কাজের প্রচার ছাড়া খুব একটা আগ্রহ নেই। কবিতা পাঠ করি। আমার কবিতার একটা বড় সংখ্যক শ্রোতা রয়েছেন। তাঁদের ভুলি কী করে।
প্রশ্ন: নতুন কাজের কী খবর?
সৌরভ: ‘রাজনীতি’ সিক্যুয়েলের চিত্রনাট্যের কাজ চলছে। কলকাতা আর ওড়িশায় শুটিং হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy