হলদিয়ার সিটি সেন্টার এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর নাকা। সঙ্গী রাজ্য পুলিশ। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।
জোড়া ফলাই বাড়িয়ে দিচ্ছে জেদ।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী জেলায় এসে শাসিয়ে গিয়েছেন, ‘সব উত্তর বুঝে নেব’। তারপর আবার পুলিশেরই একাংশের সাহায্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন শাসক দলের সাংসদ, ভোটের মুখে এমন অভিযোগে সরব হয়েছে সিপিএম।
এই পরিস্থিতিতে শেষ দফায় নন্দীগ্রামের জেলায় ১৬টি আসনের ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর পুলিশের শিরদাঁড়া কতটা সোজা থাকে, সে দিকে নজর সকলের। জেলার পুলিশকর্মীরা অবশ্য দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। মান রাখতে জান কবুলেও পিছপা হবেন না তাঁরা।
পুলিশের এই ভূমিকা ভরসা জোগাচ্ছে বিরোধীদের। সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন, ‘‘পুলিশ সুপারের ভূমিকা এখনও নিরপেক্ষ রয়েছে। ভোট অবাধ হবে বলেই আমাদের আশা।’’
ভোট অবাধ হলে তো শাসকের শঙ্কা বাড়ার কথা। মুখে অন্তত সে কথা মানছেন না তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। জেলা সভাপতি শিশির অধিকারী বলেন, ‘‘ভোট তো অবাধ হবেই। মানুষও আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’’ তবে তৃণমূল সূত্রে, বুথে বুথে ভূতের নেত্য চালিয়ে ভোটে জল মেশানোর সুযোগ যে এ বার প্রায় নেই তা বুঝে গিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা।
এই অবস্থায় আশাবাদী আম জনতা, নিজের ভোটটা নিজেরা দিতে পারবেন। তাঁদের ভরসা জোগাচ্ছে জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ায় ঋজু অবস্থান। ‘দিদি’র আদরের ভাই কেষ্টর জেলাতে থাকাকালীন বছর দেড়েক আগেই এই পুলিশ কর্তা টের পেয়েছিলেন পুলিশের এখন ‘কঠিন’ সময়! সাংবাদিকদের কথাটা বলে ফেলে রাজরোষেও পড়েছিলেন তিনি। ছ’মাসের মধ্যে বদলি হতে হয়েছিল বীরভূমের তৎকালীন পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে।
সেই অলোকের সামনে এ বার আরও ‘কঠিন’ পরীক্ষা। এখন তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। এই জেলায় ভোট-প্রচারে এসেই পুলিশকর্মীদের শাসিয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে কি ভোট নিয়ে বাড়তি চাপ অনুভব করছেন? প্রশ্নটা শুনে হাসলেন পুলিশ সুপার। তারপর দৃঢ় জবাব, ‘‘চাপের কোনও কিছু নেই। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে নিজের ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’’
জেলার অন্য পুলিশ আধিকারিক-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও টের পাওয়া পেল উর্দির মান রাখতে তাঁরা মরিয়া। এক পুলিশ আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘কলকাতায় পুলিশকে (তাপস চৌধুরী) গুলি করে খুন করল। থানায় থানায় তৃণমূল নেতারা দাদাগিরি করছে। আর এখন তো মুখ্যমন্ত্রী আমাদের আত্মমর্যাদায় ঘা দিলেন। তবে দিদিমণি যাই বলুন না কেন, আমাদের দবাং চলবে।’’
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নন্দীগ্রামের জেলায় দায়িত্বে আসার পর থেকে শিরদাঁড়া সোজা রেখেই কাজ করতে দেখা গিয়েছে এই পুলিশ কর্তাকে। হলদিয়ায় ব্যবসায়ীর থেকে তোলা চেয়ে না পেয়ে মারধর, দোকান ভাঙচুরের অভিযোগ দায়ের হওয়া মাত্র তৃণমূলের শ্রমিক নেতা খোকন দাসকে গ্রেফতার করে রাজোয়িরায় পুলিশ। গত জুলাইয়ে তমলুক থানার শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের পরও দলের জেলা নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সহিদুল খান নামে এক তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করতে পিছপা হয়নি পুলিশ।
এ বার ভোট-পর্বেও বারবার পুলিশের সক্রিয় ভূমিকাই দেখেছে পূর্ব মেদিনীপুর। ভোট ঘোষণার পরপরই রামনগরের সিপিএম প্রার্থী তাপস সিংহের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল কর্মীদের। সে ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত তিন তৃণমূল কর্মীকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। উত্তর কাঁথি বিধানসভার কানাইদিঘি এলাকার ঘড়ছাড়া বাম সমর্থকরাও সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন পুলিশের সাহায্যে। তাঁরা কেমন আছেন তা এলাকায় গিয়ে জেনে এসেছেন খোদ পুলিশ সুপার।
ক’দিন আগে ভগবানপুরের দাপুটে তৃণমূল নেতা, মহম্মদপুর ১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নান্টু প্রধানকেও ধরেছে জেলা পুলিশ। ব্লক অফিসে ভাঙচুর, প্রশাসনিক আধিকারিকদের মারধরের ঘটনায় নাম জড়ানোর পরও প্রায় দু’মাস বহাল তবিয়তে ছিলেন নান্টু। সম্প্রতি জেলা পুলিশের একটি দল ওড়িশার কটক থেকে গ্রেফতার করে এনেছে নান্টু ও তাঁর ৫ সঙ্গীকে। নান্টুকে পুলিশের গতিবিধি জানানোর অপরাধে চাকরি খুইয়েছেন ভগবানপুর থানার সিভিক ভলান্টিয়ার গোকুল মিদ্যা।
অলোক রাজোরিয়ার নেতৃত্বে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটায় ভোটেও জেলা পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে বলেই আশা বিরোধীদের। নিচু তলার পুলিশ কর্মীরাও উর্দির মান রাখতে মরিয়া। আর সে ক্ষেত্রে তাঁদের ভরসা সেনাপতি রাজোরিয়া। জেলার এক সার্কেল ইনস্পেক্টরের কথায়, ‘‘পুলিশে চাকরি করতে গেলে শাসক দলের নেতাদের নানা চাপ সহ্য করতেই হয়। কিন্তু এই পুলিশ সুপার ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাত করেন না। এতে পুলিশ হিসেবে আমাদের মনোবল বাড়ে।’’ জেলার আর এক পুলিশ আধিকারিকও মানছেন, ‘‘অভিজ্ঞতায় বুঝেছি পুলিশ সুপার হিসেবে উনি বেশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকেন।’’
অলোক রাজোরিয়া অবশ্য গোড়ায় শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় যে সাত পুলিশ সুপারকে বদলির নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজোরিয়াও। তখন তিনি বীরভূমের পুলিশ সুপার। তবে ভোট মিটতেই তাঁকে ফেরান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তারপর থেকেই অনুব্রত মণ্ডলের জেলায় শাসকদল-পুলিশ সুপার ‘সমীকরণ’ কিছুটা হলেও বদলাতে শুরু করে।
পূর্ব মেদিনীপুরে দায়িত্বে আসার পর থেকেও রাজোরিয়াকে শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখা যায়নি। উল্টে তৃণমূলের লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কড়া হাতে ব্যবস্থা নিয়েছেন। যা শুধু জেলার পুলিশ কর্মীদের নয়, ভরসা জোগাচ্ছে বিরোধীদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy