২০১৬ সালের নারী দিবসে দেশের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং মহিলা সাংসদদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিআইবি।
বিগত তিন দশক ধরে উন্নয়নের ভাবনায় লিঙ্গগত বৈষম্যের বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরে জাতপাত-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সমাজের সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গগত বৈষম্য একটা জ্বলন্ত সমস্যা। উন্নয়নের পাশাপাশি অংশগ্রহণের প্রশ্নকেও লিঙ্গগত বৈষম্যের প্রেক্ষিতে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পঞ্চায়েত এবং পৌর ব্যবস্থায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়লেও দেশের আইনসভা ও বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের নামমাত্র অংশগ্রহণ রয়েছে।
নারীবাদীরাও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রক্রিয়ায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করতে চান। ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এবং দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর বিস্তারের স্বার্থে আমাদের দেশে বারবার সংসদে এবং রাজ্যের বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ বিল নিয়ে আলোচনা হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। যে সমস্ত দল দেশ চালিয়েছে— কংগ্রেস, বিজেপি, জনতা দল— সকলেই ইস্তাহারে সংসদ ও বিধানসভাগুলিতে এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময়েও বিজেপি সংসদ ও বিধানসভাগুলিতে এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের কথা বলেছিল। নরেন্দ্র মোদী ৩৭০ ধারা বিলোপ, রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক রদের মতো প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষা করলেও লোকসভা ও বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণে উদ্যোগী হননি।
ইউপিএ শাসনকালে একাধিকবার এই বিল সংসদে উঠেছিল। কিন্তু লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিংহ, মায়াবতীরা মহিলাদের আসন সংরক্ষণের সঙ্গে জাতিগত ও ধর্মীয় সংরক্ষণের প্রশ্নটি জুড়ে দেন। এতে মহিলা সংরক্ষণের বিষয়টি বিশ বাঁও জলে চলে যায়। মোদী সরকার নতুন করে সংসদ ও বিধানসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষণের জন্য কোনও বিল পেশ করেননি।
রাষ্ট্রসংঘের মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে মহিলাদের সমাজের বৃহত্তর বঞ্চিত অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজের এই অর্ধেক অংশকে আড়ালে রেখে কোনও দেশেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। ১৯৫২ সালের পর থেকে লোকসভা, রাজ্যসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ও জয়ী মহিলাদের সংখ্যা প্রমাণ করে, এখনও ভারতীয় মহিলারা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। ১৯৫২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন লোকসভা নির্বাচনে মহিলাদের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ২০১৯-এর নির্বাচনে পরিলক্ষিত হয়েছে। তা-ও মোট সদস্যের ১৪ শতাংশ মাত্র। ২০১৯-এর নির্বাচনে ৭৮ জন মহিলা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা সর্বকালের রেকর্ড। বিজেপি ৫৩ জনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়ে ৪০ জনের জয় সুনিশ্চিত করেছিল। সাফল্যের হার ছিল ৭৫.৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে, তৃণমূল ১৭ জন মহিলা প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়ে ৯ জনকে বিজয়ী করতে পেরেছিল। তাদের সাফল্যের হার ৫৩ শতাংশ।
লোকসভার পাশাপাশি রাজ্যসভার ক্ষেত্রেও মহিলা প্রতিনিধিত্ব তেমন ভাবে ঘটেনি। ২০১৭ সালে রাজ্যসভায় মহিলা প্রতিনিধিদের সংখ্যা ছিল ২৭ জন। যা রাজ্যসভার মোট সদস্যের নিরিখে মাত্র ১১ শতাংশ।
লোকসভা এবং রাজ্যসভার মতো আমাদের রাজ্য বিধানসভাতেও মহিলাদের সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় মহিলা বিধায়কের শতাংশের তারতম্য ঘটলেও তা কখনওই ৮ শতাংশের বেশি হয়নি। প্রসঙ্গত, রাজ্যগুলোর শিক্ষা বা আর্থিক উন্নয়নের মানের সঙ্গে বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের কোন প্রত্যক্ষ যোগসূত্র নেই। যেমন কেরলে নারীশিক্ষার হার সর্বোচ্চ। কিন্তু কেরল বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, উন্নয়নের যে কোনও মাপকাঠিতে রাজস্থান কেরলের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও রাজস্থান বিধানসভায় কেরলের চেয়ে মহিলা সদস্য অনেক বেশি। আবার মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড প্রভৃতি রাজ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব মধ্য স্তরে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের সর্বোচ্চ মহিলা বিধায়ক ছিলেন ৪১ জন। যা রাজ্য বিধানসভার মোট বিধায়কের ১৪ শতাংশ। ১৯৫২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রিসভায় মহিলাদের উপস্থিতির হার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ১৯৬২ সাল ছাড়া ৪-৫ জনের বেশি মহিলা বিধায়ক মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছেড়ে দিলে এই মুহুর্তে রাজ্যে ৫ জন মহিলা মন্ত্রী রয়েছেন। মোট মন্ত্রীর সংখ্যা ৪৪ এর তুলনায় যা যথেষ্ট কম। যে সমস্ত মহিলা বিধায়ককে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, তাঁদের তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হচ্ছে। জনকল্যাণ, ত্রাণ, বয়স্ক এবং প্রবহমান শিক্ষা, সমবায়, আদিবাসী উন্নয়নের মতো দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে মহিলা মন্ত্রীদের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া স্বরাষ্ট্র, অর্থ, পঞ্চায়েত, উচ্চশিক্ষার মতো দফতর পুরুষ বিধায়কদের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে।
স্থানীয় স্তরে মমতার সরকার পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করেছেন। যা মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সংগঠনের পাশাপাশি মন্ত্রিসভা এবং বিধানসভায় এখনও মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব যথেষ্ট কম। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে দেশের সংসদ ও বিধানসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণই একমাত্র পথ। পারবে কি তৃণমূল, কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন দল দলীয় মোট প্রার্থীর ৩০ শতাংশ মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করতে? বিজেপি সাংগঠনিক স্তরে ৩০ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করলেও নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ দিশা দেখাতে পারেনি। বাম-কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও দল পরিচালনা এবং নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারা ধরা পড়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলি পারবে কি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অধিক মহিলা প্রার্থী দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে? সমাজের অর্ধেক আকাশকে অন্ধকারে রেখে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হতে পারে না। যে দলগুলি প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের কথা বলে, নির্বাচনে মহিলা প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে কেন?
(লেখক রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy