ঐতিহাসিক: বিপন্ন ডালহৌসি স্কোয়ার। ছবি: সুমন বল্লভ
বছর ২০ আগে বিপদটা সামনে এসেছিল। যখন হেরিটেজ সংরক্ষণে উদ্যোগী কয়েক জন মানুষের বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ এলাকার (ডালহৌসি স্কোয়ার) ৫০টি ঐতিহাসিক ভবনকে নিয়ে করা সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল, ২০০ বছরেরও পুরনো বহু ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে ফেলে নতুন ভবন করার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। ফলে বিপন্ন হতে বসেছে ঐতিহ্যশালী ওই জায়গা।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ডালহৌসি স্কোয়ারের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও অর্থ সংগ্রহে উদ্যোগী হয় ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড’ বা ডব্লিউএমএফ (এই সংস্থা বিশ্ব জুড়ে ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ করে থাকে)। যার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে ২০০৪ ও ২০০৬ সালে ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ওয়াচ’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৫ সালে ডব্লিউএমএফ-এর তরফে একটি ‘স্ট্র্যাটেজি প্ল্যানিং ওয়ার্কশপ’ করা হয়। ২০০৭-এ বি বা দী বাগ এলাকার অন্যতম স্থাপত্যের নিদর্শন সেন্ট জন্স গির্জা সংরক্ষণের জন্য পাইলট প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়।
তার পরে কেটেছে অনেকগুলো বছর। ডালহৌসি স্কোয়ারের ৫৫টি ভবনকে হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সংশ্লিষ্ট জ়োনের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, তা সংরক্ষণে খুব একটা উদ্যোগ প্রশাসনিক স্তরে নজরে পড়েনি। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচন ফের ডালহৌসি স্কোয়ার-সহ কলকাতার ঐতিহ্যকে আলোচনার বৃত্তে নিয়ে এসেছে। যে আলোচনা আলাদা মাত্রা পেয়েছে কাল, রবিবার বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডে) আগে। কারণ, বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে ঘোষণা করেছে, তারা ক্ষমতায় এলে কলকাতা শহরকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ শহরের তালিকাভুক্ত করার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
যার পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলছেন, ‘‘এ সব রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।’’ রাজ্য হেরিটেজ কমিশন আবার জানাচ্ছে, প্রয়োজন হলে বিধানসভায় আইন পাশ করে রাজ্য সরকার সরাসরি ইউনেস্কোর কাছে আবেদন জানাবে শহরের হেরিটেজ মর্যাদার জন্য। কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্নের বক্তব্য, ‘‘বাইরে থেকে এসে অনেকেই শহরের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলছেন। অথচ হেরিটেজ কমিশন দীর্ঘদিন ধরে শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করে চলেছে।’’
হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, ইউনেস্কোর হেরিটেজ মর্যাদা পাওয়া অত সহজ নয়। কারণ, হেরিটেজ মর্যাদা পেতে হলে আগে ড্রয়িং-সহ একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে হেরিটেজ ঘোষণার পক্ষে যুক্তি কী, তা বলতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, ওই এলাকার ঐতিহ্য অবিকৃত থাকতে হবে। অর্থাৎ, এক দিকে পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করা হচ্ছে, একই সঙ্গে কোনও এলাকাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তেমন হলে হবে না।
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘গোটা শহরকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করা মুশকিল। শহরের কোনও নির্দিষ্ট এলাকা, যেমন ডালহৌসি স্কোয়ার বা উত্তর কলকাতার কোনও কোনও অংশ, যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং যা এখনও অবিকৃত অবস্থায় আছে, তার হেরিটেজ মর্যাদার জন্য বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করা যেতে পারে।’’ স্থপতি সুবীর বসু আবার জানাচ্ছেন, লালদিঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কলোনিয়াল-স্থাপত্যশৈলীর অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘যদিও টেলিফোন ভবনটি ওই এলাকার নির্মাণশৈলীর নিরিখে একটি ব্ল্যাক স্পট। কারণ, এলাকার বাকি স্থাপত্যের সঙ্গে ওটির কোনও সামঞ্জস্য নেই।’’
তবে দলের ইস্তাহারে ঠাঁই পেলেও আলাদা করে কলকাতার হেরিটেজ শহরের মর্যাদার কী প্রয়োজন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেতা চন্দ্রকুমার বসু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোনও সরকারই হোক অথবা ইউনেস্কোর মতো কোনও প্রতিষ্ঠান, আমার মনে হয় আলাদা করে কলকাতার হেরিটেজ মর্যাদার প্রয়োজন নেই। সুপ্রাচীন, সমৃদ্ধশালী ইতিহাসের ভিত্তিতে কলকাতা ঐতিহ্যের শহর হিসেবে মানুষের মনে ইতিমধ্যেই মান্যতা পেয়েছে।’’
কিন্তু নির্বাচনে যেখানে সব কিছু নিয়েই দড়ি টানাটানি চলে, সেখানে কলকাতার ঐতিহ্য নিয়েও যে রেষারেষি চলবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?—জানাচ্ছেন হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy