মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
দীর্ঘ ১৪ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলিচালনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নিয়ে ভোট ময়দানে নেমে পড়ল সিপিএম। রবিবার নন্দীগ্রামেরই রেয়াপাড়ার একটি মঞ্চ থেকে মমতা নন্দীগ্রামে ওই পুলিশি অভিযানের জন্য নাম না করে শিশির অধিকারী এবং শুভেন্দু অধিকারীকে দায়ী করেন। এমনকি, হাওয়াই চটি-পরা পুলিশ ঢোকানোর ‘দায়’ও চাপিয়ে দেন তাঁদের ঘাড়ে। যদিও শিশির তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘‘ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে!’’
ঘটনাচক্রে, কয়েক মাস আগেও শুভেন্দু এবং কয়েক দিন আগে শিশির তৃণমূলেই ছিলেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তাঁরা ‘সক্রিয়’ ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কিন্তু এখন দু’জনেই বিজেপি-তে। শুভেন্দু আর মমতা নন্দীগ্রামে ভোটপ্রার্থী। ফলে স্বভাবতই মমতা নন্দীগ্রামে ‘গুলিচালনা’র ‘দায়’ অধুনা তাঁর প্রতিপক্ষ পিতা-পুত্রের উপর চাপিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে সিপিএমের বক্তব্য, তা হলে তো তৎকালীন বিরোধী নেত্রী স্বীকার করে নিলেন যে, ওই ঘটনা তৃণমূলের চক্রান্ত ছিল! কারণ, শিশির-শুভেন্দু এবং মমতা— তিনজনেই তো তখন বিরোধী তৃণমূলে ছিলেন। মমতার রবিবারের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে নেটমাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয় সিপিএম তুলে এনেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তখন বারবার বলা ‘চক্রান্ত’-এর প্রসঙ্গও। ঘটনাচক্রে, তখন বুদ্ধদেব তো বটেই, বিমান বসুও কয়েকটি সভায় নন্দীগ্রামের ওই ঘটনার পিছনে বিরোধী তৃণমূলের চক্রান্তের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ১৪ জনের প্রাণহানির পর তাঁদের সেই স্বর চাপা পড়ে যায়।
ঘটনাচক্রে, ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশি অভিযানে যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁরা সকলেই পুলিশের গুলিতে মারা যাননি। নিহতদের মধ্যে আটজনের দেহে গুলির আঘাত ছিল। পাঁচজনের দেহে ছিল তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাত। বাকি একজনের দেহে ছিল বোমার আঘাত। তখনই সিপিএম প্রশ্ন তুলেছিল, পুলিশ তো বোমা বা তীক্ষ্ণ অস্ত্র ব্যবহার করে না! রবিবার মমতার মন্তব্যের পর তারা বলছে, ‘‘এতদিন পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তার জবাব দিলেন। তৃণমূলের দুষ্কৃতীরাই বাকি ছ’জনকে খুন করেছিল। নিহতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।’’
রবিবার নন্দীগ্রামে শেষদফার প্রচার শুরু করেন মমতা। সেই সময়েই রেয়াপাড়ার একটি মঞ্চ থেকে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘যারা গুলি চালিয়েছিল আপনাদের মনে আছে, পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল অনেকে। মনে আছে? মনে পড়ছে? অনেকে পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল। নিশ্চয়ই ভুলে যাননি! নন্দীগ্রাম, নন্দীমা, আমার মনে আছে সব। আমি ডেট ওয়াইজে বলে দেব। মনে আছে, হাওয়াই চটি পরে এসেছিল বলে ধরা পড়ে গিয়েছিল। এ বারেও সেই সব কেলেঙ্কারি করছে। অনেক বিএসএফ, সিআইএসএফ-এর ড্রেস-ট্রেস কিনেছেন। কারণ, যাঁরা এ সব করেন না তাঁরা জানেন। আর আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমি পরে শুনেছিলাম, এই বাপ-ব্যাটার পারমিশন ছাড়া সে দিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। আমিও একটা গভর্নমেন্ট চালাই। আমিও খোঁজখবর পরে নিয়েছি। দেখুন, আমি ভদ্রলোক বলে কিছু বলিনি। ফেয়ার এনাফ!’’
মমতার ওই মন্তব্যের পরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ময়দানে নেমে পড়েছে সিপিএম। এমনকি, সেই সময় যে সব বামপন্থী মনোভাবাপন্ন যুবক-যুবতী বুদ্ধদেব এবং তাঁর বক্তব্যকে খারিজ করেছিলেন, তাঁরা নেটমাধ্যমে সরাসরি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করেছেন। লিখছেন, ‘আপনি জিতে গিয়েছেন স্যর! আপনিই প্রথম চক্রান্তের কথা বলেছিলেন। আমরা কেউ শুনিনি। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, আপনিই ঠিক বলেছিলেন। আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি’। ওই ঘটনার পর প্রথমদিকে বুদ্ধদেব বলার চেষ্টা করেছিলেন, হাওয়াই চটি পরা পুলিশের তত্ত্ব ‘বানানো গল্প’। চক্রান্ত। সোমবার সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক নেতা বলেছেন, ‘‘বুদ্ধ’দা তো একাধিক বার এ কথা বলেইছেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেছিলেন, আগে জানলে পুলিশ পাঠাতেন না। পড়ে থাকত নন্দীগ্রাম আরও কিছু দিন। মুখ্যমন্ত্রী এ বার তো বুদ্ধ’দার কথাতেই সিলমোহর দিলেন! সত্যিটা বেশি দিন চেপে রাখা যায় না। তবে নন্দীগ্রামের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর এত দিনের মিথ্যাচারের জবাব এ বার দেবেন ইভিএমে।’’
নেটমাধ্যমে অনেকেই বুদ্ধদেবের তখনকার উদ্ধৃতি তুলে প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কি পুলিশেরই একাংশের আধিকারিকদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসাজসে নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চের ঘটনা ঘটেছিল? অনেকের আবার প্রশ্ন, ‘তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যাওয়া অধিকারীদের সমালোচনা করতে গিয়ে, তাঁরা কতটা খারাপ, সেটা নন্দীগ্রামকে বোঝাতে গিয়ে আসলে মুখ্যমন্ত্রীর ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। বিজেপি-কে প্যাঁচে ফেলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই প্যাঁচে পড়ে গিয়েছেন’।
শিশির অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই মমতার ওই বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিকের কথায়, ‘‘ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এত বড় মিথ্যাবাদী বাংলায় জন্মেছে কি না আমি জানি না। আমার ৮২ বছর বয়স। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। কিন্তু এমন মানুষ আমি কখনও দেখিনি। উনি যাঁদের কাঁধে পা দিয়ে তিনি এখানে এলেন, তাঁদের তিনি ভুলে গিয়েছেন। শুভেন্দুর রক্ত এখনও ওঁর পায়ে লেগে আছে। উনি যা বলছেন, উপরওয়ালাই তার বিচার করবেন। আমি এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করব না।’’ শিশিরের আরও মন্তব্য, ‘‘ওই মিথ্যার জবাব নন্দীগ্রামবাসী দেবেন। মমতা হারছেন। সে কারণেই এ সব কথা বলছেন। হেরে যাওয়ার সঙ্কেত পেয়ে গিয়েছেন উনি। তাই পাগলের প্রলাপ বকছেন। তবে উনি পারেন না এমন কিছু নেই। কিন্তু ওঁর কথা কেউ বিশ্বাসও করে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy