Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
অরণ্যের অন্দরমহলে
TMC

প্রকল্পের সুফল কি ভোটবাক্সে যাবে

কেমন আছেন বাসিন্দারা। কোন বাঁকে রাজনীতি। আখ্যান জঙ্গলমহলের

স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করতে উপভোক্তাদের লাইন।

স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করতে উপভোক্তাদের লাইন। ফাইল চিত্র।

তাপস সিংহ
নয়াগ্রাম (ঝাড়গ্রাম) শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২১ ০৬:১৪
Share: Save:

কেমন আছেন বাসিন্দারা। কোন বাঁকে রাজনীতি। আখ্যান জঙ্গলমহলের

সাত-সকালে সর্ডিহা স্টেশনের রেলগেটের পাশে দাঁড়িয়ে অদূরের সোনাঝুরির জঙ্গল চোখ টানে...লাল মাটি ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়োয় বটে, কিন্তু মন জুড়োয় কি?

জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে সেই নাশকতা... অসহায় মানুষের হত্যাকাণ্ড, আর্তনাদ এখনও যেন সর্ডিহা আর খেমাশুলি স্টেশনের মাঝের এই রেললাইনের পাশে দাঁড়ালে শোনা যায়। পাশের রাজাবাঁধ গ্রামের প্রভাস মাহাতো এখনও ২০০৮-এর মে মাসের সেই দিনের কথা স্পষ্ট মনে করেন, ‘‘বড় ভুল হয়ে গেল...বড় ভুল করেছিল ওরা, মাওবাদীরা। তবে উল্টো দিক থেকে মালগাড়ি না এলে এত ক্ষয়ক্ষতি হত না গো!’’

পাল্টে গিয়েছে জঙ্গলমহল। পাল্টে গিয়েছে আজকের রাজাবাঁধ। উন্নয়ন স্পষ্টতই চোখে পড়ে এলাকায় পা রাখলে। সর্ডিহা রেলগেটের দিকে যাওয়ার মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা বাদ দিলে বাদবাকি উন্নয়ন হয়েছে। রাজাবাঁধ গ্রাম যেখানে, সেই সর্ডিহা পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে। তাই এই বেহাল রাস্তার জন্য এলাকায় অভিযোগের তিরও তাদেরই দিকে।

কিন্তু, সামাজিক এত সব প্রকল্পের সুফল কি তাঁরা পাননি? ‘‘অবশ্যই পেয়েছি। গ্রামের সবাই পেয়েছি।’’ স্বীকার করেন চা-চপ-মুড়ি বিক্রেতা প্রভাস। একমত হন দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে আসা অনেকেই।

সর্ডিহা না হয় শহরের কাছাকাছি এলাকা। কিন্তু নির্বাচনের মুখে সুদূর এলাকাগুলি কী বলছে? ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বেরিয়ে লোধাশুলি-ফেকোঘাট-গোপীবল্লভপুর-রামেশ্বর হয়ে নয়াগ্রাম— বিস্তীর্ণ এই জঙ্গলমহলের ক্যানভাস এখন পাল্টে গিয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই, বামফ্রন্ট আমলে যা হয়নি, গত দশ বছরে সেই কাজ করে দেখিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিভিন্ন জনপদে থামতে থামতে, কথা বলতে বলতে, দেখতে দেখতে সেই সব কাজের খতিয়ানও মিলেছে। বিশেষ করে রাস্তা-পানীয় জল-বিদ্যুৎ এবং অবশ্যই নানাবিধ সামাজিক প্রকল্পের সুবিধার কথা জানিয়েছেন মানুষজন। সরকারি সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে শাসক এবং বিরোধীদের মধ্যে বাছবিচার করা হয়েছে, এমন অভিযোগও বিশেষ মেলেনি।

নয়াগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কুলিয়ানা গ্রামের কথাই ধরা যাক। বেলা হয়েছে বেশ। বাড়ির উঠোনে কাজ করছিলেন সুকেশ ঘোষ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের জ্যাঠতুতো ভাই। সুকেশবাবু ঝাড়গ্রাম জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি। এই কুলিয়ানাই দিলীপ ঘোষের বাড়ি। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত এই পঞ্চায়েতের কাজের খতিয়ান দেওয়ার পাশাপাশি সুকেশবাবু এটা জানাতে ভোলেননি যে, তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরাও। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড করিয়েছে তাঁদের পরিবারও। দিলীপবাবুর ছোট ভাই হীরক ঘোষের স্ত্রী গঙ্গাও জানালেন, অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গেই ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড করিয়েছেন তাঁরাও।

এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায় নয়াগ্রামের চামারবাঁধ হাইস্কুলের ছাত্রীদের সঙ্গে। বারো ক্লাসের ছাত্রী অনুপমা রাউত, বনশ্রী দে-রা জানান, ট্যাব কেনার ১০ হাজার টাকা ইতিমধ্যেই তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসে গিয়েছে।

উন্নয়নের এই মডেলকেই হাতিয়ার করে এ বারের নির্বাচনী ময়দানে নেমেছে তৃণমূল। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে ওই অযাচিত ধাক্কা খাওয়ার পরে কতটা ঘুরতে পেরেছে তারা?

তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি দুলাল মুর্মুর দাবি, ‘‘অনেকটাই ফিরেছে।’’ খড়িকামাথানির স্কুলে বাংলার শিক্ষক, নয়াগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ২০১১ ও ’১৬-য় নির্বাচিত বিধায়ক দুলালবাবু বলেন, ‘‘সামাজিক প্রকল্প নিয়ে আমরা এ বার ভাল সাড়া পাচ্ছি মানুষের।’’ ছাতনাশোল বিবেকানন্দ চকে তৃণমূল পার্টি অফিসে বসে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের সহ-সভাপতি দুলালবাবু বলেন, ‘‘২০১৯-এ মানুষ কিছুটা ভুল বুঝেছিল। মানুষকে ভুল পথে চালনাও করা হয়েছে। কিন্তু গত দশ বছরের কাজের খতিয়ান আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরছি। ‘দুয়ারে সরকার’ প্রবল ভাবে সাড়া জাগিয়েছে।’’

এরই পাশাপাশি নয়াগ্রামের নতুন জঙ্গলকন্যা সেতু প্রত্যন্ত এই এলাকাকে আরও কাছে এনে দিয়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু তৈরি হওয়ায় মেদিনীপুর-খড়্গপুরের সঙ্গে নয়াগ্রাম ব্লকের দূরত্ব অনেকটাই কমেছে। আবার কমেছে কলকাতার সঙ্গে দূরত্বও। নয়াগ্রামে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, নয়াগ্রাম স্টেডিয়াম, কিষাণ বাজার, প্রকৃতি উদ্যান হয়েছে।

যদিও সুবর্ণরেখা ও কংসাবতীর গর্ভ থেকে বেআইনি ভাবে অবাধ বালি তোলার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জঙ্গলমহল ঘুরলেই কানে আসে। বালিগেড়িয়ায় দেখা হয় বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সহ-সভাপতি উৎপল দাস মহাপাত্রের সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বেআইনি বালি খাদান ব্যবসার সঙ্গে তৃণমূলের একাংশ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সঙ্গে রয়েছে পুলিশ-প্রশাসন।’’ স্থানীয় মানুষজনেরও অভিযোগ, বালির লরির যথেচ্ছ চলাচলের জন্য এলাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে, রাস্তারও ক্ষতি হচ্ছে।’’ যদিও তৃণমূলের দুলালবাবু এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘বেআইনি বালি খাদানের সঙ্গে আমাদের দলের কেউ যুক্ত নয়।’’

এদিক-ওদিক এমন চোরাবালিতে কি আটকে যেতে পারে তৃণমূলের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ নাকি উন্নয়ন সে পথ সত্যিই মসৃণ করে দিয়েছে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy