Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Assembly Election 2021

Bengal Polls: দলের প্রভাব ভালই, তবু মন্ত্রী গড়েছেন রাম মন্দির

গত বিধানসভা নির্বাচনে সাড়ে ৩৭ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে স্বপনবাবু জিতলেও লোকসভায় তা কিছুটা কমেছে।

রাম-সীতার মন্দির উদ্বোধনে খোলের বোলে স্বপন দেবনাথ। ফাইল চিত্র

রাম-সীতার মন্দির উদ্বোধনে খোলের বোলে স্বপন দেবনাথ। ফাইল চিত্র

সুরজিৎ সিংহ
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২১ ০৬:২৭
Share: Save:

তিনি রাজ্যের মন্ত্রী। পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূলের সভাপতিও। পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের এমনই হেভিওয়েট প্রার্থী স্বপন দেবনাথ ভোটের ঠিক আগেই নিজের উদ্যোগে এলাকায় রাম-সীতার মন্দির তৈরি করেছেন। বিজেপি নেতৃত্ব যখন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে তৃণমূলকে বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণের অভিযোগে বিঁধছে, সে সময় মন্ত্রীর এই উদ্যোগের কারণ কী?

গত বিধানসভা নির্বাচনে সাড়ে ৩৭ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে স্বপনবাবু জিতলেও লোকসভায় তা কিছুটা কমেছে। ব্যবধান কমেছে মন্ত্রীর ‘খাসতালুক’ শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতেও। তবুও সার্বিক ভাবে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রভাব ভালই। ‘‘বিজেপিও কিন্তু বাড়ছে’’— মনে করিয়ে দেন এলাকার এক হোটেল ব্যবসায়ী। সে জন্যই কি মন্দির করতে হল? ফোঁস করে ওঠেন স্বপনবাবু, ‘‘এটা কি কোনও অপরাধ? ইতিহাস ঘেঁটে জেনেছি, ভাতশালায় এক সময়ে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-হনুমানের মন্দির ছিল। তাই প্রতিষ্ঠা করেছি। আগে মাজার, মসজিদের সংস্কার করেছি, চৈতন্যদেবের মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেছি।’’মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক অবশ্য হিসেব রাখছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা কত, সংখ্যালঘু ভোটার কত। তিনি বলেন, ‘‘এনআরসি-তে অসমে লাখ লাখ হিন্দু বাঙালির কী করুণ অবস্থা হয়েছে, প্রচারে বলছি।’’

স্বপনবাবুকে ভরসা দিচ্ছেন শ্রীরামপুর মোড়ের পান বিক্রেতা বাম-মনস্ক দিলীপ ঘোষ থেকে সেলুন দোকানের মালিক চাঁদু শীলেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘হাওয়া কিছুটা এলোমেলো মনে হলেও স্বপনদার কাছে অনেকে উপকৃত। তাঁর পক্ষেই বাজি ধরছি।’’

পূর্ব বর্ধমানের আট বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে কাটোয়া ও গলসিতেই শুধু বিজেপি এগিয়েছিল। বাকি ছয় কেন্দ্রে এগিয়েছিল তৃণমূল। তবুও ধর্মীয় মেরুকরণের হাওয়ার ঝাপটা এ বার ‘কিছুটা বেড়েছে’। গলসি ১ ব্লকের রাকোনা গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপ্টারের বিকল্প হেলিপ্যাডের জন্য খেলার মাঠ ছাড়তে আপত্তি তুলেছিলেন। সে গ্রামের যুবক জয়দেব অধিকারী বলেন, ‘‘হিন্দু-প্রধান গ্রাম, হাওয়া কোন দিকে বুঝতেই পারছেন।’’ আবার ওই কেন্দ্রেরই সংখ্যালঘু প্রধান পুরষ্যা গ্রামের চায়ের দোকানে বসে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘‘দিদি কী দিতে বাকি রেখেছেন?’’

তৃণমূলের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব নিয়ে বিজেপির তোলা অভিযোগ খণ্ডন করতে যে তাঁকে সময় দিতে হচ্ছে, তা মানছেন কাটোয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী, পাঁচ বারের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও। লোকসভা ভোটে শুধু কাটোয়া শহরের ভোট প্রাপ্তিতেই বিজেপি এই বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে গিয়েছিল। এ বার বিজেপির প্রার্থী রবিবাবুর সঙ্গে দীর্ঘ দিন কংগ্রেস করা শ্যামা মজুমদার। সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন দীর্ঘ দিনের কাউন্সিলর অমর রাম। দু’জনেই রবিবাবুকে হারাতে প্রচারে ঝাঁপিয়েছেন। তবে রবিবাবুর দাবি, ‘‘লোকসভা ভোটে কাটোয়া শহরে আমার দল (আগে ছিল কংগ্রেস) পিছিয়ে গেলেও বিধানসভা ভোটে মানুষ আমাকেই চান। এটাই এ শহরের ধারা।’’

লোকসভা নির্বাচনে কেতুগ্রাম কেন্দ্রে গত বিধানসভার তুলনায় ভোট অনেকটা বাড়ায় কিছুটা স্বস্তিতে তৃণমূলের বিধায়ক-প্রার্থী শেখ সাহানেওয়াজ। তবে কেতুগ্রাম ২ ব্লকে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। সাহানেওয়াজ দাবি করেন, ‘‘মতুয়াদের বোঝাচ্ছি, সব রকম কার্ড রাজ্য সরকার যখন দিয়েছে, নাগরিকত্ব নিয়ে ভয় কীসের? এই কেন্দ্রের ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটের ২৮ শতাংশ পাচ্ছি, বাকিদেরও ২২ শতাংশ পাব।’’ তবে কেতুগ্রাম কেন্দ্রের অন্তর্গত কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র না হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রশ্নে জমিদাতাদের অনেকে রাজ্য সরকারের ভূমিকায় অখুশি। সাহানেওয়াজের অবশ্য দাবি, ‘‘আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারেরই আগ্রহ নেই।’’

কেতুগ্রাম ১ ব্লকের মতো কিছু জায়গায় তৃণমূলে দ্বন্দ্ব-কাঁটার খচখচানি রয়েছে। যেমন ব্লক তৃণমূল সভাপতি অপূর্ব চৌধুরীর (ওরফে অচল) সঙ্গে মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর আকচাআকচির সাক্ষী মঙ্গলকোট। সিদ্দিকুলাকে মন্তেশ্বর কেন্দ্রে সরিয়ে অপূর্বকে দল মঙ্গলকোটে প্রার্থী করেছে। দ্বন্দ্ব-ক্ষতে কি মলম পড়েছে? অপূর্বর দাবি (বিরোধী কটাক্ষে ‘অচল-যুক্তি’), ‘‘মমতাদি আছেন, অনুব্রত মণ্ডল রয়েছেন। আর কী চাই?’’

তাই কি? কোটালঘোষ গ্রামের যুবক সোহেল শেখের অভিযোগ, ‘‘বাবা ও তাঁর বন্ধুরা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর অনুগামী ছিলেন বলে, তৃণমূলেরই এক নেতার নির্দেশে দু’বার গাঁজা-কেসে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। বাবা এখনও জেলে। যদি ভোট দিই, অন্যদের দেব।’’ সালন্দা গ্রামে মিছিল করছিলেন অপূর্ব। গ্রামে বিজেপির পতাকা বা দেওয়াল লেখা নেই বললেই চলে। তবে কি এখানে বিজেপি নেই? এক যুবক হেসে বলেন— ‘‘বিজেপি আছে, মাঠে-ঘাটে।’’ যদিও অপূর্ব দাবি করেন, ‘‘২০১১ সালে আমার ১২৪ ভোটে হারার দুঃখ এ বার ঘুচবে।’’

আবার গলসি কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদলের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে গলসি ১ ব্লকে দামোদরের বালির ভাগ নিয়ে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের দিকে আঙুল তুলছেন। তবে দল সেখানকার বিদায়ী বিধায়ককে অন্য কেন্দ্রে সরিয়ে নতুন মুখ এনেছে। বিতর্কিত এলাকায় বালি তোলাও মার্চের শেষ থেকে কার্যত বন্ধ। উল্টো দিকে, এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী বদল করায় নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষের আঁচ পাওয়া গিয়েছে।

বিজেপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরে আউশগ্রাম, কেতুগ্রাম ও পূর্বস্থলী উত্তরে কর্মীদের বিক্ষোভে। তার উপরে পূর্বস্থলী উত্তরের গত বারের বিজেপি প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য সম্প্রতি তাদের দলে যাওয়ায় উল্লসিত তৃণমূল শিবির। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, হাওয়া যদিও বা পক্ষে থাকে, ব্যালটে তার প্রতিফলন ঘটানোর মতো সংগঠন বিজেপির নেই। এই পরিস্থিতিতে পূর্বস্থলী উত্তরে সিপিএমের বিধায়ক-প্রার্থী প্রদীপ সাহার জন্য ঝাঁপিয়েছেন বামকর্মীরা। আবার লোকসভা ভোটে দল এগিয়ে থাকায় আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল প্রার্থী তপন চট্টোপাধ্যায়ও। আর ১৩-১৪টি দেশে শিক্ষকতা করা, বর্তমানে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির শিক্ষক গোবর্ধন দাস এলাকা ঘুরে দাবি করছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটে তাঁর প্রশংসা করার পরে আউশগ্রামের বিজেপি প্রার্থী কলিতা মাজিকে নিয়ে দলে আর ক্ষোভ নেই বলে দাবি করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠেরা। তপ্ত দুপুরে তাঁকে পাওয়া গেল চার গাড়ি পুলিশ আর মোটরবাইকে সিভিক ভলান্টিয়ারের ঘেরাটোপে, বোলপুর-বর্ধমান রাস্তায়। তাঁর পিছনে সাউন্ড-বক্স ঘিরে জটলার ভিড় সাকুল্যে ৪০। তবুও কলিতার আশা, তৃণমূলের বিধায়ক-প্রার্থী অভেদানন্দ থান্দারকে ঘিরে বিক্ষোভের সুফল বিজেপি পাবে। তবে লোকসভায় এখানে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। সে তথ্যে ভরসা রেখে অভেদানন্দের দাবি, ‘‘ক্ষোভ কোথায়?’’

লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের ভোটের একাংশ বিজেপিতে গেলেও এ বার সে সুযোগ নেই বলে দাবি করছেন পূর্ব বর্ধমানের জেলা সিপিএম সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক। যদিও বিজেপির কাটোয়া
সাংগঠনিক জেলা সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষের দাবি, ‘‘বামেদের তো বটেই, তৃণমূলের ভোটও পাব।’’ যা শুনে হাসছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি স্বপন দেবনাথ।

তবে পানাগড় বাজারের চা বিক্রেতা, আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা হরিশ মিশ্রের মতো কিছু মানুষ ধর্মের বিভাজনে যেতে নারাজ। হরিশের কথায়, ‘‘বরাবর বিজেপিকে ভোট দিই। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী ‘কাজের মানুষ’ হওয়ায় তাঁকেই ভোট দিয়েছিলাম। এ বারও কাজের মানুষকেই ভোট দেব।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy