প্রতীকী ছবি।
“আঠারো বছর বয়স হলে কী হয়, বলতে পারেন?” প্রশ্নটা করল সনিয়া দণ্ডপাট। ভোট দেওয়ার বয়স সবার হয়, কিন্তু বিয়ে দেওয়া হয় কেবল মেয়েদের। মগরাহাটের ১৯ বছরের সনিয়া তার কিশোরী বাহিনীর সঙ্গীদের নিয়ে বেশ কিছু নাবালিকা-বিবাহ আটকেছে, কখনও ব্যর্থও হয়েছে। সনিয়ার অভিজ্ঞতা, ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে থামানোর আর্জি শোনে পুলিশ-প্রশাসন। আর আঠারো পেরোলে? “নিজেরা মিটিয়ে নিন,” বলে কাজ সারে। সে বিয়েতে যতই আপত্তি থাক মেয়েটির।
তা হলে ‘বেটি পড়াও’ স্লোগান কেন, কেনই বা কন্যাশ্রী? একই প্রশ্ন নুরজাহান খাতুনের। লালগোলার তেঁতুলিয়া পঞ্চায়েতের এই কন্যারও বয়স ১৯। প্রায় সব সহপাঠীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে কন্যাশ্রী আর রূপশ্রীর টাকায়। “ওই টাকা চলে যায় শ্বশুরবাড়িতে, কোনও মেয়ে হাতে
পায় না।”
যা হওয়ার কথা ছিল পড়াশোনায় সহায়তার প্রকল্প, অনেকের ক্ষেত্রে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ বছরে বিয়ে দেওয়ার সরকারি ছাড়পত্র। নুরজাহান অবশ্য কন্যাশ্রীর টাকা থেকে কিনেছেন স্মার্টফোন, যাতে অনলাইনে কম্পিউটার সায়েন্সের ক্লাস করতে পারেন। কিন্তু ক’জন তা পারছে? তাঁর আক্ষেপ, ভোটের আগে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু কমবয়সি মেয়েদের কথা কেউ বলছে না।
কী সেই কথা? বছর আটেক আগে বাম আন্দোলনে মেয়েদের মধ্যে থেকে একটা স্লোগান ওঠে, “খাপসে আজ়াদি, বাপসে আজ়াদি।” ‘খাপ’ বা গ্রাম-সমাজের মোড়লরা, আর বাপ-মা, মেয়েদের ইচ্ছের খোঁজ না নিয়েই যারা বিয়ে দিতে চায়। এদের অধীনতা থেকে মুক্তি চায় মেয়েরা। পথ খুঁজে না পেয়ে পালিয়ে বিয়ে করে অনেকে। পাচার, অকালমাতৃত্ব, বধূনির্যাতন, নানা সঙ্কটের শুরু হয় সেখানে।
নারীপাচার রুখতে কাজ করেন সমাজকর্মী বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়। দেখছেন, লকডাউনের পর থেকে নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে, পালিয়ে বিয়ে করাও বাড়ছে। “বাড়ির লোক প্রায়ই এসে দাবি করে, মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে ‘পাচারকারী’ বলে পুলিশে দিতে হবে। এটা আগে এত দেখিনি।” আর সনিয়া দেখেছে, মেয়েরা কাউকে ‘বন্ধু’ বা ‘বয়ফ্রেন্ড’ পরিচয় দিলে পুলিশ তেড়ে ওঠে। এমনকি, মেয়ে পুলিশও।
কাকে ভালবাসবে, কবে বিয়ে করবে, এ সব সিদ্ধান্ত মেয়েদের হাতে ছাড়তে নারাজ পরিবার। সিপিআইএমএল নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য মনে করেন, স্বাধীনতায় এই হস্তক্ষেপ অল্পবয়সী মেয়েদের রাজনীতিতে সক্রিয় করে তুলছে। “আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের মস্ত অংশ মেয়েরা। নাগরিকত্ব আন্দোলন, কৃষক, পরিবেশ বা শ্রম আন্দোলন, সর্বত্র তরুণীরা বিপুল সংখ্যায় আসছে। তারাই যেন চালিকাশক্তি।” মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে গেলে স্বাধীনতা ছাঁটতে হবে, এ হল ভুল রাজনীতি। “চাই স্বাধীনতার নিরাপত্তা।”
মেয়েদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারের কথা নির্বাচনী রাজনীতিতে ঠাঁই পায় না। তবে এ বার বিধানসভা ভোটে সে কথাটা টেনে এনেছে ‘লাভ জিহাদ।’ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী বলেছেন, এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বিজেপি ‘লাভ জিহাদ’ রুখতে আইন করবে। বাংলার বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু বলেছেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়ায় ‘লাভ জিহাদ’-এর সমস্যা উত্তরপ্রদেশের চাইতেও বেশি। তৃণমূলের উত্তর — কে কী খাবে, কী পরবে, তা বিজেপি ঠিক করবে না।
তবে তৃণমূল শাসনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অনেক মেয়েরই অভিজ্ঞতা, ভিন-সম্প্রদায়ে বিয়ের পরে যখন কোনও এক পক্ষ, বা দু’পক্ষ থেকে
ভয় দেখানো শুরু হয়, তখন পাশে পুলিশ, প্রশাসনকে পাওয়া যায় না। “এমন একটা ঘটনায় শেষে গ্রামের মেয়েরা রুখে দাঁড়িয়েছিল নবদম্পতির পাশে। তখন পিছু হঠল ভয় দেখাতে-আসা লোকগুলো,” জানালেন বারুইপুরের একটি সংস্থার কর্ণধার মীনা দাস।
নেতাদের প্রশ্রয়-পাওয়া গুন্ডা বনাম জোট বেঁধে বাঁচতে-চাওয়া মেয়ে, এই হল গ্রামবাংলায় রাজনীতির আসল লড়াই। সেখানে নেতার ধমক ছাপিয়ে ওঠে ১৯ বছরের সনিয়ার প্রশ্ন, “কেন অন্য ধর্মে বিয়ে করা যাবে না? মানুষের মনটাই বড়, ধর্ম বা জাত নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy