মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
ভোটের আগে ও পরে যত সমীক্ষা হয়েছে, তার কিছুই ‘সত্যি’ প্রমাণিত হয়নি। যে সব সমীক্ষা তৃণমূলকে অনেক এগিয়ে রেখেছিল, সেখানেও সংখ্যাটা ২১৩–র ধারেকাছে ছিল না। কিন্তু একজন বরাবর বলে গিয়েছেন, এ বার সরকার গড়ার থেকে অনেকটা বেশি শক্তি থাকবে তাঁর সঙ্গে। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবারের নির্বাচনের ফলাফল বলে দিল, বাস্তবিকই ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। আর বাংলার মেয়েও বোঝালেন, তিনিই চেনেন বাংলার মন।
কিন্তু কী ভাবে এল এই সাফল্য? পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য আরও একটি সময় লাগবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তবে প্রাথমিক ভাবে একটা কথা স্পষ্ট বেশ কয়েকটি ‘ম’ জিতিয়েছে ‘ম’ আদ্যাক্ষরের মমতাকে। এর একটি ‘ম’ যদি মুসলমান ভোট হয় তবে আর একটি মহিলা ভোট। বিজেপি প্রথম থেকেই রাজ্যে প্রকাশ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের পথ ধরে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ থেকে দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীরা বারবার মমতাকে এবং তৃণমূলকে মুসলমান সম্প্রদায়ের তোষণকারী বলে এসেছে। না, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ এখানে প্রযোজ্য নয়। মমতাকে সরাসরি ‘বেগম’ বলে সম্বোধন করে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের দিকেই যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও একটি ‘ম’ অতীতেও মমতার সহায় হয়েছে। সেটি মহিলা ভোট। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের হ্যাট্রিকের পিছনেই শুধু নয়, বিরোধী দল থাকার সময়েও যাবতীয় সাফল্যের পিছনে মহিলা ভোট সহায় হয়েছে মমতার। না, তিনি মহিলা বলেই শুধু নয়, কালীঘাটের মেয়ের ‘অগ্নিকন্যা’ এবং মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটাকে রাজ্যের মানুষ বরবারই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, ‘মমতা’ নামটার মধ্যেই একটা টান আছে। নানা কাজে তাঁকে যখন ‘হঠকারী’ বলে তোপ দেগেছেন অনেকে, তখন আবার অনেকেই সেই কাজের মধ্যে ‘মমত্ব’ দেখতে পেয়েছেন। কারণ যাই হোক না কেন, একজন মহিলাকে হারাতে এত ‘খ্যাত’ পুরুষের দলবদ্ধ প্রচেষ্টাকেও হারাতে চেয়েছেন আটপৌরে মহিলারা। হুইলচেয়ার নিয়ে লড়াই করা মেয়েটাকেই আঁচল ভরে ভোট দিয়েছেন তাঁরা।
আরও এক ‘ম’ আছে এই জয়ের পিছনে। ‘মধ্যবিত্ত’। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও মমতা কথায়, কাজে বরাবর নিজেকে ‘মধ্যবিত্ত’ করে রেখেছেন। তাঁর কথাবার্তায় উচ্চবিত্তের আভাস নেই। তিনি বরং যে ভাষাটায় কথা বলেন, সেটা মধ্যবিত্তের কাছের। সেই কথা রুক্ষ হলেও আম ভোটারের কান তাকে ঘরোয়া হিসেবে নেয়। একই সঙ্গে প্রচার পর্বে তিনি বারবার মধ্যবিত্তের সমস্যার কথা তুলেছেন। পেট্রল, গ্যাসের দামবৃদ্ধি থেকে রোজকার চাল-ডাল-তেল সব দিয়েই তো মধ্যবিত্তের কথা বলেছেন। বলে গিয়েছেন। বিজেপি-র তত্ত্বকথায় ভরা ইস্তেহার আর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ‘সঙ্কল্প পত্র’ তাই কাজে দেয়নি।
শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিল্প থেকে চাকরির হিসেব কষলে পশ্চিমবঙ্গকে ‘নেই’ রাজ্য বলাটা অত্যুক্তি হবে না। তবু বাংলার মানুষ এটাকেই নিজের ‘ঘর’ মনে করেছে। যে ঘরের চাল মমতা। গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ মডেলকে নেয়নি বাংলার মানুষ। যে কথাটা বারবার প্রচারে বলেছেন মমতা। মেনে নিয়েছেন বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার। প্রাথমিক হিসেব বলছে রাজ্যের প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট গিয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
আরও একটা ‘ম’ মমতা নিজে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের লড়াই দেখেছে বাংলা। মমতার অনশন দেখেছে বাংলা। নীলবাড়ির লড়াইয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে ঠিক সেই লড়াকু হিসেবেই দেখেছে বাংলা। দলের কঠিন সময় বলে যখন অনেক তৃণমূল নেতা মনে করছিলেন, বিজেপি-কে ভাল আশ্রয় বলে যখন অনেকেই মেনে নিচ্ছিলেন তখন সেই ‘কঠিন’ লড়াইয়ের ময়দানে স্ট্রাইকারের ভূমিকা নিয়ে নেন। বিপদের গন্ধ থাকতে পারে জেনেও বেছে নেন নন্দীগ্রামকে। সেই ‘হার’ ছোট নয়। কিন্তু সার্বিক ‘জয়’ এত বড় যে সব আড়াল করে দিয়েছে। নন্দীগ্রাম নামের ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ নিয়েই খুশি থাকতে হয়েছে প্রধান প্রতিপক্ষকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy