মনোরঞ্জন ব্যাপারী। ফাইল চিত্র
তিনি এই আছেন। আবার নেই। বুধবার সন্ধ্যায় এক ঝলক দেখা হয়েছিল হুগলির বলাগড়ের খামারগাছি স্টেশন সংলগ্ন বাজারে একটি দলীয় পথসভায়। সেখানে বক্তা ছিলেন বলাগড় বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মনোরঞ্জন ব্যাপারী। কিন্তু কাছে যাওয়া গেল না। তাঁকে ঘিরে থাকা তরুণ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বলয় কোনও ভাবেই ভেদ করা গেল না। মিনিট পনেরোর বক্তৃতা শেষ হতেই ফের বলয়গ্রাসে মনোরঞ্জন। হাত তুলে তখনকার মতো বিদায় জানিয়ে রওনা দিলেন অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।
বৃহস্পতিবার নাগাল পাওয়া গেল মনোরঞ্জনের (‘গেছোদাদা’ও বলা যায়)। তাঁর সমর্থনে বলাগড়েরই গুপ্তিপাড়ায় দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভা। তার কিছুক্ষণ আগেই মাথার উপর ঘূর্ণিপাক দিয়ে গিয়েছে চপারের শব্দ। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। মাইক্রোফোনে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন মনোরঞ্জন। এই সময়েই মঞ্চে উপস্থিত হলেন দলনেত্রী। গুপ্তিপাড়া ২ নম্বর পঞ্চায়েত অফিস লাগোয়া ময়দানে তখন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের কানফাটানো চিৎকার। ফের মনোরঞ্জনের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাতের কাছে পাওয়া গেল জনসভার শেষে। ভাঙা মেলা হলেও তখনও তাঁকে ঘিরে তরুণ-তরুণীদের বৃত্ত। কেউ দু’চার কথা শুনতে চাইছেন। কারও আব্দার নিজস্বীর। এ বার অবশ্য সটান ঢুকে পড়া গেল বৃত্ত ভেদ করে। প্রাথমিক সৌজন্য শেষ করে দ্রুত পৌঁছনো গেল জিজ্ঞাস্যে— আপনাকে ঘিরে তরুণ-তরুণীদের উচ্ছ্বাস নজরকাড়া। কিন্তু আপনার নিজের তো বয়সের গাছপাথর নেই? প্রশ্ন শুনেই মুচকি হাসলেন রাজ্যের দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি। বললেন, ‘‘আমার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার তারিখটা ছিল অদ্ভুত। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখ। মানে ০৭/০৭/৭৭। বেরিয়ে মনে হল, কত দিন জ্যোৎস্না দেখিনি। কত দিন সূর্য,চাঁদ দেখিনি। অথচ বয়স হয়ে গেল। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তখনই স্থির করেছিলাম, এ বার থেকে ভাবব, আমার মাস ৩০ দিনে নয়, ৩৬৫ দিনে। সেই হিসাবে আমার বয়স এখন বেড়েছে সামান্যই। আমি বুড়ো নই।’’
আলাপচারিতায় হঠাৎ ছন্দপতন। দলের এক কর্মী ‘দাদা’ বলে ডাকলেন মনোরঞ্জনকে। তাঁর হাত ধরেই আরও এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীর সঙ্গে পরিচয়পর্ব শুরু হল। ফিরে আসতেই ফের প্রশ্ন— আপনি তো বলাগড় বিধানসভায় বহিরাগত? মনোরঞ্জনের উত্তর, ‘‘বলাগড়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক দিনের। জিরাটে বইমেলা উদ্বোধনে এসেছিলাম। সে দিনের ছবিটা এখনও জীবন্ত। এখন আরও গভীর ভাবে চিনছি। এই কথাটাই বার বার বলাগড়বাসীকে বলছি, আপনারা আমাকে সামান্য জায়গা দিন। প্রত্যেকে একটা করে আধলা ইট দিন। ওই দিয়েই বলাগড়ে নিজের বাড়ি তৈরি করে নেব।’’
জীবনে রিকশা চালিয়েছেন। রাঁধুনির কাজও করেছেন। কিন্তু এখন কি সেই পরিস্থিতি আছে? রিকশা চালিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে কি চমক দেওয়ার চেষ্টা করলেন? প্রশ্ন শুনে রাগলেন মনোরঞ্জন। দলের লাইন মেনেই বলাগড়ের তৃণমূল প্রার্থীর সপাট উত্তর, ‘‘আপনিও রিকশা চালানোটা শিখে নিন। পেট্রোল আর গ্যাসের যা দাম বাড়ছে, তাতে সকলকেই এটা শিখে নিতে হবে।’’ উত্তর শুনে আশপাশে থাকা দলীয় কর্মীদের মুখেও তখন হাসির ঝিলিক।
এক সময়ের বামদুর্গ বলাগড়ে বিজেপি-র চমকপ্রদ উত্থান ঘটেছে গত লোকসভা ভোটে। গত লোকসভা ভোটের নিরিখে ওই কেন্দ্রে ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে গেরুয়া শিবির। মনোরঞ্জন অবশ্য অবাক করে দেওয়া আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বললেন, ‘‘আমরাই এখানে জিতছি। এই কেন্দ্রে আমি ছাড়া আর কোনও প্রার্থী নেই। মোদী এসে দাঁড়ান না! তাতেও কিছু আসবে-যাবে না।’’ বলাগড় কেন্দ্রে তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক ‘ভূমিপুত্র’ অসীম মাঝি। দলনেত্রী ‘‘অসীম ভাল ছেলে’’ বলে প্রশংসা করলেও এ বার টিকিট পাননি তিনি। অনেকের মতেই বলাগড়ে ‘প্রার্থীবদল’ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে দলের একাংশের মধ্যে। আবার সেই অসীমের সঙ্গে তৃণমূলের হুগলি জেলার সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ রায় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্বন্দ্ব’-এর কথাও শোনা যায় জোড়াফুলের অন্দরে। এ সব প্রশ্নের মুখে অবশ্য‘‘বিতর্কে জড়াব না’’ বলেই ইতি টানার চেষ্টা করলেন মনোরঞ্জন।
তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র বলাগড়। রাজ্যের আরও কয়েকটি কেন্দ্রের মতো এখানেও নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে মতুয়া ভোট। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালুর আশ্বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বিজেপি-র পক্ষে? মতুয়া সম্প্রদায়ের এক জন হয়ে মনোরঞ্জনের দাবি, ‘‘অমিত শাহ যাই প্রতিশ্রুতি দিন না কেন, মতুয়ারা সিএএ-তে নাগরিকত্ব পাবেন না। এটা মতুয়ারা বুঝে গিয়েছেন। কারণ, তাঁরা যে ধর্মীয় কারণে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তার কোনও নথিপত্র নেই। তাই তা প্রমাণই বা হবে কী করে?’’
এ বার গুপ্তিপাড়া থেকে ‘রিকশা’র বিদায় নেওয়ার পালা। পরের গন্তব্য বলাগড় কেন্দ্রেরই মগরা। যেখানে আপাতত থাকছেন মনোরঞ্জন। সঙ্গী স্ত্রী মঞ্জু এবং পুত্র মানিক। ক্রমাগত ওঠার তাড়া আসছে। শেষ মুহূর্তে কোনওমতে ছুড়ে দেওয়া গেল প্রশ্নটা— এক সময় বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের কথা বলতেন। এখন ভোটের জন্য বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেন? এতক্ষণে একটা মনের মতো প্রশ্ন পাওয়া গিয়েছে— এমন ভাব করে মনোরঞ্জনের সংযত জবাব, ‘‘বিপ্লব কবে হবে তার জবাব নকশালদের কাছে নেই। ওদের সব কথা মানি। কিন্তু কাঁধের বন্দুকটা ছাড়া। ধ্বংসাত্মক আন্দোলন নয়। মানুষ সৃষ্টি চায়। বুলেট নয়, মানুষই শেষ কথা বলেন।’’
বলাগড় তথা রাজ্যের মানুষ কী বলবেন সে উত্তর মিলবে ২ মে। মনোরঞ্জন ব্যাপারী কিন্তু একটা ‘ব্যাপার’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy