মোহনবাবু: ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়ার মিত্তির বাড়ির ছেলের নাম বাবা জ্যোৎস্নাকুমার মিত্র রেখেছিলেন মদনমোহন। সেই নামেই স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কর্মজীবন পর্যন্ত কাটিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিতে এসে বাদ পড়েছে ‘মোহন’। সকলের কাছেই তিনি ‘মদনদা’। তবে নাম থেকে ‘মোহন’ বাদ যাওয়ায় কোনও আক্ষেপ নেই মদনের। বলেন, ‘‘আসল তো কর্ম। তা মদনমোহন নামেই হোক বা মদন নামে। কী বা এসে যায়!’’
দীপ-শিখা: তৃণমূলের ছোট-বড়-মেজ-সেজ নেতারা সকলেই নিজেদের কর্মসূচিতে ঘোষণা রাখেন— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়। কিন্তু কামারহাটির ভোটযুদ্ধে নেমে মদনের মননে প্রয়াত কিংবদন্তি গায়ক মান্না দে। ব্যস্ত প্রচারসূচির মাঝে তাঁর মুখে ঘুরেফিরে মান্নার জনপ্রিয় গানের লাইন— ‘দীপ ছিল, শিখা ছিল। শুধু তুমি ছিলে না বলে আলো জ্বলল না’। এ আবার কী? ও কেন? মদন বলছেন, ‘‘২০১৬ সালে ভোটে প্রার্থী হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সশরীরে ময়দানে ছিলাম না। পরিবার মাঠে নেমে জোর প্রচার চালালেও শেষরক্ষা হয়নি। তাই এবার গোড়া থেকে এলাকার প্রতিটি কোণায় পৌঁছে শারীরিক উপস্থিতির জানান দিচ্ছি। যে, এবার আমি আছি। যাতে ভোটাররা বলতে না পারেন, ‘দীপ ছিল, শিখা ছিল। শুধু তুমি ছিলে না’।’’
মদন-বাণী: দলে সম্মান না পেয়ে তৃণমূল-ত্যাগ প্রসঙ্গে— ‘‘এ বিষয়ে আমি একমত যে, ওঁরা দলে প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। যেমন অর্জুন সিংহের নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। মমতা দিতে পারেননি। শুভেন্দুর বিশ্বভারতীর ভাইস চ্যান্সেলর হওয়া উচিত ছিল। সেটা মমতা দিতে পারেননি। বা দক্ষিণেশ্বরের মতো একটা মন্দির করে দেওয়া উচিত ছিল মুকুল রায়ের নামে। অথচ মমতা একটা কাঁচরাপাড়ার ছেলেকে দেশের রেল মিনিস্টার করেছিলেন! আর বেহালার ‘কানন’-কে ‘শোভন’ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, সেটা ‘শোভন-বৈশাখী’ হয়ে গেল। এখন তারা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না কী করবে!
ধুতি-পাগড়ি: রঙিন মেজাজের নেতা হিসেবেই তাঁকে চেনেন বাংলার মানুষ। জমকালো পোশাক আর রং-বেরংয়ের চশমা তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। সেই মদনই এবার প্রচারে কখনও ধুতি পরে বাঙালিবাবু সাজছেন। কখনও মাথায় গেরুয়া পাগড়ি দিয়ে ‘রাজস্থানী সুরমা’ হয়ে ময়দানে দাপাচ্ছেন। প্রশ্ন করলে বলছেন, ‘‘ধুতি-পাঞ্জাবি পরছি, কারণ বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়— সকলেই ধুতি পরতেন। ধুতি পরলে যেন বাঙালিয়ানা একটু বেশি জেগে ওঠে। আর যেখানেই যাচ্ছি, মাথায় কেউ না কেউ পাগড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘আপনি তো রাজা। তাই আপনাকে পাগড়িতে মানায়’।’’
ওড়না-তিলক: প্রচারপর্বে মদনের সঙ্গে থাকছে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর আশীর্বাদপূত একটি ওড়নাও। সেটি কখনও থাকছে গলায় জড়ানো। কখনও হাতে। প্রচারে বেরোনোর আগেই অবশ্যই কপালে থাকছে গেরুয়া তিলক।
অনুরাগের ছোঁয়া: হনুমানের বিরাট ভক্ত। তিনি অন্তর থেকে মনে করেন, সঙ্কটমোচনের জন্যই তাঁর জীবনের যাবতীয় সঙ্কটের অবসান হয়েছে। তাই নিয়মিত ‘হনুমানচালিশা’ পাঠ করেন। গলায় পবনপুত্রের ছবি সংবলিত একটি লকেটও ঝুলিয়েছেন। প্রচারের সময় ঘনঘন সেই লকেট ছুঁতে থাকেন। সঙ্গীরা বলেন, ওটা দাদার মুদ্রাদোষ হয়ে গিয়েছে।
গোখরোর ভ্যাকসিন: ভোটের ময়দানে এটি মদনের নবতম আমদানি। দাবি করলেন, গোখরোর ছোবলের ভ্যাকসিন নিয়েছেন! সম্প্রতি কামারহাটিতে প্রচারে এসেছিলেন মিঠুন চত্রবর্তী। যিনি বিজেপি-র প্রচারমঞ্চ থেকে নিজেকে ‘জাত গোখরো’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। মিঠুন কামারহাটিতে আসার আগে পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা ভাবেননি মদন। কিন্তু গোখরোরূপী মিঠুন কামারহাটিতে প্রচার করে যাওয়ার পরেই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। বলছেন, ‘‘করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু জীব রয়েছে। তাদের জন্যই ভ্যাকসিন নিতে হল!’’
শাহরুখ না ফাটাকেষ্ট: দলীয় সতীর্থ ফিরহাদ হাকিম প্রায়শই বলেন, ‘‘মদন মিত্র হল তৃণমূলের শাহরুখ খান!’’ সহকর্মী তথা বন্ধু প্রশংসা হাসিমুখেই নেন মদন। তবে সম্প্রতি তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে বিরোধী শিবিরের তারকা প্রচারক মিঠুনের ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’ ছবির সংলাপ। তবে তাতে মদন-স্পর্শ দিয়ে, ‘‘মদন মিত্র খবর দেখে না। খবর শোনে না। খবর তৈরি করে!’’
মহারূপেণ সংস্থিতা: শরীর কামারহাটিতে। প্রাণ পড়ে রয়েছে ভবানীপুরে। সেই প্রাণের নাম মহারূপ। বয়স পাঁচ বছর। মদনের নাতি। মহারূপ ভুমিষ্ঠ হওয়ার সময় সারদা-কাণ্ডের জেরে কারাবাসে মদন। কিন্তু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে আদরের নাতিকে কাছছাড়া করেননি। প্রাণের চেয়েও প্রিয় নাতিকে ভবানীপুরের বাড়িতে রেখে এখন কামারহাটিতে মদন। প্রচারের ব্যস্ততার জন্য একদিনও যেতে পারছেন না মহারূপকে দেখতে। ঘনিষ্ঠমহলে কেঁদে উঠছে ঠাকুর্দার মন।
কফি আর প্যাটি: কেয়ারি করা গোঁফ, উড়ুউড়ু চুল, রংদার লম্বাঝুলের কুর্তা আর জমকালো স্নিকার্সের মদনকে দেখে বোঝা মুশকিল, যে তিনি ষাট পেরিয়েছেন। ফলে ভোটের ময়দানে যথেষ্ট সংযমী। গরমে শরীর যাতে কোনওরকম গোলমাল না করে, সেই কারণে নিজের মতো করে একটি ‘ডায়েট চার্ট’ বানিয়েছেন। খিদে পেলেই খাচ্ছেন কফি আর প্যাটি। বলছেন, ‘‘এই সময়টায় কোনও পাওয়ার মিল নয়। শরীর সুস্থ রাখার দিকে নজর দিচ্ছি। যাতে ভোটযুদ্ধে কোনও প্রভাব না পড়ে।’’
মানসিক: কামারহাটির ভোটযুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে সিপিএমের মানস মুখোপাধ্যায়কেই চেয়েছিলেন। ২০১১ সালের হারের বদলা ২০১৬ সালে জেলবন্দি মদনের থেকে উসুল করে নিয়েছিলেন মানস। মদন-মানস খেলার স্কোর ছিল ১-১। তাই মদন ভেবেছিলেন, ২০২১ সালে পাল্টা চাল দিয়ে ২-১ স্কোরে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু মানস ভোটযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ওই আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থী তাঁর শ্যালিকার পুত্র তথা সিপিএমের যুবনেতা সায়নদীপ মিত্র। বিজেপি-র প্রার্থী রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য রাজনীতিতে বয়স ও অভিজ্ঞতায় দু’জনেই মদনের তুলনায় নবীন। তবে মদনের অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে সিপিএম বিজেপি-র হয়ে কাজ করছে। মানস নেই। ভোটে লড়ার মজাও নেই।
খেলা হবে: তৃণমূলের মদন রাজ্যের প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী। বিজেপি-র রাজু প্রাক্তন ফুটবলার। খেলেছেন মোহনবাগানেরও। ভোটের ময়দানে নেমেই চিনেছেন পরস্পরকে। দু’জনের খেলায় জমজমাট কামারহাটি।
চলছে-চলবে: ২০১৬ সালে কামারহাটিতে হারের পর ২০১৯ সালে ভাটপাড়া বিধানসভার উপনির্বাচনেও হারতে হয়েছিল তাঁকে। রাজনৈতিক জীবনে সেই কঠিন সময়েও কিন্তু মদন ডুবে যাননি। আলোচনায় ভেসে ছিলেন তাঁর ‘ফেসবুক লাইভ’ নিয়ে। আপাতত তাঁর পেজের ফলোয়ার ২,৬৭,৬৪৪। মদন ফেসবুকে ‘অন’ হলেই হু-হু করে দর্শক আসতে থাকে। কমেন্টের হুড়োহুড়ি। তাতে যেমন ইতিবাচক মন্তব্য যেমন থাকে, তেমনই থাকে টিপ্পনি আর সমালোচনাও। মিম আর ট্রোলিংয়ের শেষ নেই। তাতেও পরোয়া নেই মদনের। প্রচারে বেরোলেই আট থেকে আশি— সকলেরই প্রশ্ন, ‘‘জিতলেও ফেসবুক লাইভ থাকবে তো?’’ রঙিন মেজাজের মদন জবাব দিচ্ছেন, ‘‘ফেসবুক লাইভ চলছে-চলবে।’’
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy