শত ফুল: তিনি চিরকালই আলাদা। বহুমুখী প্রতিভাধর। রাজনীতিক, মন্ত্রী, নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক, অধ্যাপক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক আরও কত কী! আগে নাট্যকার পরিচয়টাই প্রথমে রাখতেন। ভোটের বাজারে অঙ্ক কষেই রাজনীতিক হিসেবে নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করছেন। তৃণমূলে এমন প্রতিভা আর কারও নেই। নাহ্, আছে। দিদি। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিনী। বস্তুত, ব্রাত্যের চেয়ে একটা বিষয়ে এগিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখতে পারেন। ব্রাত্যের লেখা কবিতার কথা খুব একটা কেউ মনে করতে পারেন না। ভাগ্যিস!
ব্রাত্য নন: পিতৃদত্ত নাম ছিল ব্রাত্যব্রত। ব্রাত্যের পিতা কবি বিষ্ণু বসু। কিন্তু ইস্কুলে ভর্তির সময় ব্রতটা ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে তিনি ব্রাত্য। কিন্তু নামের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারিক জীবনের কোনও মিল নেই। সমাজের কোনও স্তরেই তিনি ব্রাত্য নন। বরং বন্ধুবৎসল ব্রাত্য ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সর্বত্র বিরাজমান।
আঠেরো আসুক নেমে: ঘরের বাতানুকূল যন্ত্র সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে। সর্বত্র। অফিস, পার্টি অফিস বা বাড়ি— তাঁর নির্দেশে যন্ত্রের মেজাজ সবসময় এক। সবসময় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কবি সুকান্ত সেই কবে লিখেছিলেন, ‘এ দেশের বুকে আঠেরো আসুক নেমে’। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে লিখলেও লিখতে পারতেন, ‘১৮-য় এসি চলে এখানে বারো মাস’।
নব্য বাম: গোটা পৃথিবীর বাম আন্দোলনের খবর রাখেন। কথায় কথায় বলে দেন ব্রাজিল বা ভেনেজুয়েলায় কী ভাবে গতি পাচ্ছে বাম আন্দোলন। নিজের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘নিও লেফ্ট’ বলতে পিছপা হন না। বিশ্বাস করেন, ভারতে বামপন্থী আন্দোলন ও বামপন্থাকে নতুন রূপ দিয়েছেন একমাত্র মমতাই। বামপন্থায় বিশ্বাস। কিন্তু ব্যক্তি কেন্দ্রিকতায় অগাধ আস্থা। ওপরে জননেত্রী। নীচে জনগণ। আর মাঝে ঢিলেঢালা পার্টি।
ভক্তের ভগবান: তৃণমূল আসলে কোনও রাজনৈতিক দল নয়। ফ্যান ক্লাব। ১০ বছর মমতার সংসারে কাটিয়ে দেওয়ার পর উপলব্ধি ব্রাত্যের। কারণ, যাঁরা তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থক, তাঁরা সকলেই দিদির অনুরাগী। চিত্রকর থেকে নাট্যকার, গায়ক থেকে নায়ক, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার— নানা পেশার হরেক মানুষ মমতার অনুরাগেই রাজনীতির অংশ হয়েছেন।
একই বৃন্ত, দুই কুসুম: একটা সময়ে লড়াই করেছেন সিপিএমের বিরুদ্ধে। এখন লড়াই বিজেপি-র বিরুদ্ধে। দর্শন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু দুটোই ‘রেজিমেন্টেড পার্টি’। তাই নাট্যকার-রাজনীতিক দু’দলকেই এক নজরে দেখেন। সিপিএমের যেমন লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি, জেলা কমিটি, রাজ্য কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটব্যুরো। তেমনই বিজেপি বা আরএসএসের শাখা, মণ্ডল, লোকসভা ভিত্তিক জেলা কমিটি, রাজ্য কমিটি ও সংসদীয় কমিটি।
চাই কিন্তু পারি না: তাঁর নাটক দেখে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখেও প্রশংসা ছুটে ছুটে আসে। করোনাকাল শুরুর আগে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ ছবিতে গোয়েন্দা বরদাচরণের ভূমিকায় তাঁকে দেখে দর্শকরা হেসেই খুন। ‘বোমা’-র মতো নাটক সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে করুণ বেহালার সুর— ‘‘ভাল নাটক লিখতে চাই। কিন্তু কোনও দিনও পারব না। ভাল নাটক করতে চাই । কিন্তু কোনওদিনও পারব না। ভাল অভিনয় করতে চাই। কিন্তু কোনওদিনও পারব না। ভাল ছবি বানাতে চাই। কিন্তু কোনওদিন পারব না।’’
কোট-আনকোট: অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। পড়াশোনা ও কাজের প্রতি চরম অধ্যবসায়। তবে দুষ্টু লোকেরা বলে, কথায় কথায় কোটেশন ঝাড়েন। বিদেশি মনীষীদের বক্তৃতা কণ্ঠস্থ। লিও তলস্তয়, চিয়াং কাইশেক, হাকুসাইদের উদ্ধৃতি দিতে দিতেই কথা বলা অভ্যাস। সে ভাবে কেন কওন ভারতীয় মনীষীর উদ্ধৃতি ব্যবহার করে না? দুষ্টু লোকেরা বলে, নিকোলাস মাদরো, রাউল কাস্ত্রোদের খবর রাখলে কি আর দেশের মনীষীদের কথা মনে থাকে!
লাদেন ফ্যান: তিনি কি ওসামা বিন লাদেনের ভক্ত? ? প্রশ্ন শুনে ব্রাত্য স্মিত হাসেন। ২০০৩ সালে তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘রাস্তা’। মুখ্য ভিলেন রজতাভ দত্ত সবসময় সংলাপ বলতেন, ‘‘লাদেন, লাদেন।’’ ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবে সফল হয়নি। কিন্তু ডায়ালগটি জনপ্রিয় হয়েছিল। তাই অনেকেই ভাবেন ব্রাত্য কী লাদেনের ফ্যান? ঘটনাচক্রে, সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া মিঠুন চক্রবর্তীও ওই ছবিতে খলনায়কের একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মিঠুন অভিনীত জগু হালদার ডায়ালগ ‘হ্যালু-উ-উ-উ-উ-উ-উ’ খুবই হিট হয়েছিল।
মাইরা ফ্যালাম, কাইট্যা ফ্যালাম: কট্টর বাঙাল। এবং ইস্টবেঙ্গলের কড়া সমর্থক। লাল-হলুদের খেলা থাকলে মন্ত্রিত্ব করতে করতেও মন পড়ে থাকে সেখানেই। দেখতে না পারলেও খোঁজখবর রাখেন। স্পনসর নিয়ে ক্লাবের সঙ্গে বিবাদের খবরও রাখেন।
পর্যটক মন্ত্রী: ঠিকই পড়লেন। পর্যটক মন্ত্রী। পর্যটন নয়। রাজ্য মন্ত্রিসভায় ব্রাত্য পর্যটকের মতোই ঘুরে বেড়িয়েছেন। ২০১১ সালে দমদম থেকে প্রথমবার জিতেই উচ্চশিক্ষামন্ত্রী। তার কয়েক মাস পর স্কুলশিক্ষাকে জুড়ে মমতা শিক্ষামন্ত্রী করেন ব্রাত্যকে। ২০১৩ সালে শিক্ষা দফতর থেকে সরিয়ে পর্যটনে। ২০১৮ সালে দফতরবিহীন মন্ত্রী। কারণ, দক্ষিণ দমদম এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন নিহত হওয়ার পর শাসকদলের সর্বস্তরের নেতারা ঘটনাস্থলে গেলেও দেখা যায়নি ব্রাত্যকে। মন্ত্রিসভায় তাঁর এক সতীর্থ শীর্ষনেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন (আসলে চুকলি করেছিলেন), ব্রাত্য তখন নাটকের মহড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ব্যস, দফতর-হীন। কিন্তু আবার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী। এখনও তা-ই আছেন। পর্যটক তো বটেই।
নাইট্যশালার নৃপতি: তৃণমূলের নাট্যমঞ্চে ব্রাত্য বসুর ভুমিকা ঠিক কী? ব্রাত্য বললেন, ‘‘অনেকটা নৃপতির মতো।’’ কিন্তু নৃপতি অর্থ তো রাজা! তৃণমূলে থেকে রাজা? বলেন কী মশয়! ঠিকই বলেন। এ নৃপতি সে নৃপতি নয়। ব্রাত্য নিজেকে বলেন, সাদাকালো ছবির যুগে কৌতুকাভিনেতা নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। তখনকার দর্শকদের কাছে কমিক রিলিফ। নিজেকে বাংলার শাসকদলে সেই ভূমিকাতেই দেখে খুশি ব্রাত্য।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy