এগরায় বিজেপি-র মঞ্চে শিশির অধিকারী।
বিজেপি-র মঞ্চে শিশির অধিকারী। চার শব্দের একটি বাক্যে গোটাটা লেখা গেলেও ‘ইতিহাস’ তা মানবে না। সেটা অনেক দীর্ঘ। তাই প্রকাশ্যে না বললেও তৃণমূল নেতারাও মানছেন গেরুয়া শিবিরের মঞ্চে অমিত শাহর পাশে কাঁথির সাংসদের উপস্থিতি আসলে একজন ‘অভিভাবক’ হারানো। শিশিরের নেতৃত্বেই কাঁথি ছিল তৃণমূলের গড়। শুধু কাঁথি কেন, গোটা পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের জমি ছিল মজবুত। তবু তৃণমূল নয়, কাঁথি ও পূর্ব মেদিনীপুরকে বলা হত অধিকারী গড়। আর তার পিছনে শিশিরের ‘একক’ অবদান অনেকটা।
চাইলে হয়ত আগেই ছেলেকে অনুসরণ করে পদ্মশিবিরে যেতে পারতেন শিশির। কিন্তু হাওয়ার গতি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বরাবরই সিদ্ধহস্ত তিনি। তাই ছেলে শুভেন্দু আগেভাগে চলে গেলেও, পদ্ম-প্রতীকের কাটআউটের পিছনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে তিন মাস সময় নিলেন তিনি। প্রায় আড়াই দশক আগে ঠিক যে ভাবে কংগ্রেসের শরণ ছেড়ে সপরিবারে মমতার ঘাসফুল শিবিরে এসে উঠতে লম্বা সময় নিয়েছিলেন। আজ সেই ইতিহাসের কথা শোনা গিয়েছে শিশিরের মুখেও। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পরিবার এই জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ভোট পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ দিন রয়েছে। অত্যন্ত বেদনা ও দুঃখের সঙ্গে,ব্যথিত হৃদয়ে আপনাদের জানাতে চাই, যে ভাবে আমাদের তাড়ানো হয়েছে, আমাদের পরিবারকে নিপীড়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে, ইতিহাসে লেখা থাকবে।’’
শিশিরের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে মেদিনীপুর এবং পারিবারিক ঐতিহ্য বরাবরই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুরের মাটিতে অধিকারী পরিবারের বসত বাড়ি বিপ্লবী কাজকর্মের অন্যতম আখড়া ছিল। শিশিরের বাবা কেনারাম অধিকারী লবণ সত্যাগ্রহে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইংরেজদের হাতে জেল খেটেছেন কাকা বিপিন অধিকারীও। পারিবারিক ধারা রেখেই কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনীতির পথ চলা শুরু শিশিরের। সেই সময় অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং শিশির, বাংলার রাজনীতিতে প্রায় একে অপরের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন।
ইতিহাস বলছে, ১৯৬৩ সালে কাঁথির ভবানীচকে পঞ্চায়েত প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন শিশির। ১৯৬৯ সালে কাঁথি পুরসভার প্রথম কাউন্সিলরদের একজন। ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন কাঁথি দক্ষিণ থেকে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে বিরোধের জেরে টিকিট পাননি। তবু সেই সময়েও কাঁথির মুখ্যমন্ত্রী বলা হত শিশিরকে। দীর্ঘ তিন দশক সেখানকার পুরপ্রধান ছিলেন শিশির। তাঁর প্রতাপে বামেরা পর্যন্ত সেখানে পা রাখতে পারেনি। এ হেন শিশির যে কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেবেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠরা পর্যন্ত আঁচ করতে পারেননি।
১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তৃণমূল তৈরি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রদেশ কংগ্রেসের মমতা-ঘনিষ্ঠ বহু নেতাই সেই সময় তাঁর ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেন। শিশির কিন্তু চটজলদি তেমন কোনও সিদ্ধান্ত নেননি। বরং প্রদেশ কংগ্রেসের মূলস্রোতটাকে মমতা কতটা নিজের দিকে টানতে পারেন, তা দেখেছিলেন। পরে সঠিক সময় বুঝে দলবদল করেন। এ বারও তাঁর শিবির বদল সঠিক সময়ে হল কিনা তা বলবে ভবিষ্যৎ। কিন্তু এটা ঠিক যে একটা ‘ইতিহাস’ হারাল তৃণমূল। স্বাধীনতার আগে জন্ম নেওয়া আর কোনও প্রথম সারির নেতাই রইলেন না তৃণমূলে। সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পরে কাঁথির শিশির সেই ধাক্কাটাই দিলেন।১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া শিশির তৃণমূলের গোড়ার দিকে ২০০১ সালে কাঁথি দক্ষিণ থেকে জোড়াফুলের বিধায়ক হন। এর পরে ২০০৬ সালে তৃণমূলের বিধায়ক হয়েছেন এগরা বিধানসভা থেকে। পরে ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে কাঁথির সাংসদ হওয়া শিশির প্রথম মনমোহন সিংহ সরকারে প্রতিমন্ত্রীও হয়েছেন। রবিবার সেই সব কথা মনে করিয়ে শিশির বলেন, ‘‘যে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে আমি এসেছি, তা প্রকাশ করতে চাই না। গ্রাম পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধায়ক, মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে আজ প্রায় ৬০-৬২ বছর রাজনীতিতে আপনাদের সঙ্গে রয়েছি। আজ বিজেপি পার্টিকে সমৃদ্ধ করে আমার, আপনার ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হবে।’’
১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হলেও প্রথম রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল ২০০১ সালে। হয়েছিল দিঘায়। কারণ, তখনও পর্যন্ত তৃণমূলের কাছে রাজ্য সম্মেলন করার মতো শক্তি দেখানোর জায়গা পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না। এ সব কথা মনে করিয়ে এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘মুকুল রায় কিংবা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছাড়ায় সাংগঠনিক ধাক্কা হলেও শিশিরের ক্ষেত্রে সেটা বলা যাবে না। উনি যে পদ্ম শিবিরে চলে যেতে পারেন সেটা অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছিল। তাই তেমন কিছু ধাক্কা হবে না দলের কাছে। তবে একটা অধ্যায়ের শেষ যে হল তা মানতেই হবে।’’ ওই নেতা এটাও বলছেন, ‘‘এখনও কাঁথি তো বটেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেও প্রবীণ শিশিরবাবুর কথার একটা দাম আছে।’’
খাতায় কলমে এখনও তিনি তৃণমূলের সাংসদই থাকছেন। যেমন আছেন বিজেপি-তে যোগ দেওয়া পূর্ব বর্ধমানের সাংসদ সুনীল মণ্ডল। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের হিসেব ধরলে লোকসভায় বাংলার প্রতিনিধিত্বের হিসেবে এখন তৃণমূল ও বিজেপি সমান সমান। দুই দলেরই সাংসদ সংখ্যা ২০। তৃণমূল ২২ থেকে ২০ তে নামল আর বিজেপি ১৮ থেকে ২০ তে উঠল। গেরুয়া শিবির এমনটাও আশা করছে খুব তাড়াতাড়ি তমলুকের সাংসদ দিব্যন্দু অধিকারীকে নিজেদের শিবিরে টেনে লোকসভায় তৃণমূলের থেকে ২১-১৯ ‘স্কোর’-এ এগিয়ে যাবে রাজ্য বিজেপি।
শিশির রবিবার পদ্মের মঞ্চে থাকলেও, বক্তব্য রাখলেও তাঁর হাতে বিজেপি-র পতাকা দেখা যায়নি। তবে তৃণমূলকে আক্রমণ শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও নেননি তিনি। বলেছেন, ‘‘এটা আমার আত্মসম্মানের লড়াই, চিরকাল লড়াই করেছি, আগামী দিনেও লড়ব। এটা মেদিনীপুরের সম্মানরক্ষার লড়াই।’’ আর নন্দীগ্রামে মমতার বিরুদ্ধে মেজ ছেলের লড়াই নিয়ে শিশিরের দাবি, ‘‘নন্দীগ্রামে শুভেন্দু জিতবেই। পূর্ব মেদিনীপুরে সাফ হয়ে যাবে তৃণমূল।’’ সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। আর রবিবারই হয়তো প্রথমবার, শিশিরের মুখে প্রকাশ্যে শোনা গেল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy