তৃণমূলের তাপস চট্টোপাধ্যায়, বিজেপি-র ভাস্কর রায়, সিপিএমের সপ্তর্ষি দেব। ফাইল চিত্র।
লড়াইটা কার সঙ্গে কার?
কিছু ক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ হেসেই ফেললেন আসলাম। বললেন, ‘‘আকাশে তিনটে ঘুড়ি। কে যে কার সঙ্গে প্যাঁচ কষছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।’’ তাঁর এই সংক্ষিপ্ত উত্তরই রাজারহাট-নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্রের লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট তুলে ধরছে।
এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী তাপস চট্টোপাধ্যায়, জোট-সমর্থিত বাম প্রার্থী সপ্তর্ষি দেব এবং বিজেপি-র প্রার্থী ভাস্কর রায়। বিধাননগর পুরসভার ১১টি ওয়ার্ড এবং নিউ টাউন-রাজারহাটের পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে তৈরি রাজারহাট-নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্র। উচ্চ থেকে নিম্নবিত্ত— আছেন সব শ্রেণির মানুষই। সংখ্যালঘুদের অবস্থানও বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। মুসলিমদের পাশাপাশি আছেন মতুয়া, উদ্বাস্তু এবং দলিতরাও। গত এক দশকের বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে ধারে ও ভারে এগিয়ে রাখতে হয় তৃণমূলকেই। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল ২৮ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে ছিল। সে বার বাম ও কংগ্রেসের ভোট কমেছিল, তুলনায় ভোট বেড়েছিল বিজেপি-র। ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে অবশ্য লড়াইটা সীমাবদ্ধ ছিল তৃণমূল এবং সিপিএমের মধ্যেই।
তবে এ বার ছবিটা ভিন্ন। জমি অধিগ্রহণ বা সিন্ডিকেটের মতো পুরনো সমস্যার চেয়েও এখন বেশি ভাবাচ্ছে দল বদল, অন্তর্ঘাত, রুটি-রুজি এবং মেরুকরণের রাজনীতির বিষয়টি। এমনটাই মনে করছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে তৃণমূলের পাল্লা ভারী হলেও জোরদার লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে তাদের।
বাসিন্দারা মজা করে বলছেন, এ বার প্রাক্তন লালের সঙ্গে বর্তমান লালের লড়াই। এই লড়াইকে দ্বিমুখী হিসেবে দেখতে নারাজ বিজেপি প্রার্থী। ভাস্করবাবুর অভিযোগ, ‘‘এই কেন্দ্রের একাংশে একটি আধুনিক শহর গড়ে উঠলেও বাকি এলাকা এখনও অনুন্নয়নের অন্ধকারে। সেই কারণেই উন্নয়ন-প্রত্যাশী মানুষ বিজেপি-র পথ চেয়ে বসে আছেন। এখানে প্রতিপক্ষ আর কেউ থাকছে না। মানুষ শুধুই ডবল ইঞ্জিন চালু হওয়ার জন্য দিন গুনছেন।’’
তৃণমূল প্রার্থী তাপসবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘একটি ইঞ্জিনেই দেশ অন্ধকার। ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গ।’’ বাম প্রার্থী সপ্তর্ষি দেবের কথায়, ‘‘পেটে ভাত নেই, কাজ নেই। আন্দোলন করতে গিয়ে বেকারদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। রাজ্য আর কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।’’
রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারে এমন তরজা চলতে থাকবে। বাসিন্দাদের মতে, ভোট আসে-যায়। তাঁদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় না। তাঁদের অভিযোগ, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত এলাকার কোনও মানোন্নয়ন ঘটেনি। জল, নিকাশি, স্বাস্থ্য, আলোর মতো পরিষেবার নিরিখে ওই এলাকা অনেকটাই পিছিয়ে। আবার নিউ টাউনেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবহণ নিয়ে দাবি রয়েছে বিস্তর। সেই অভিযোগকে সমর্থন করেছে বাম এবং বিজেপি। তৃণমূল প্রার্থী তাপসবাবু বললেন, ‘‘উন্নয়নের কাজে ইতিমধ্যেই হাত দিয়েছে রাজ্য সরকার। রাতারাতি সব কিছু হয় না। সময় যে লাগে, তা এলাকার মানুষ জানেন।’’
রাজনৈতিক মহল অবশ্য মনে করছে, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা, জনসংযোগ এবং সমাজসেবার নিরিখে তাপসবাবুই এগিয়ে। তুলনায় নবাগত হলেও ভাস্করবাবু লড়াই দেবেন বলে ধারণা তাঁদের। যদিও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং তা রফতানির ব্যবসায় যুক্ত ভাস্করবাবুকে নিয়ে দলেই নানা জল্পনা রয়েছে। আদি-নব্যের দ্বন্দ্বের মতো বিষয় নিয়েই সেই জল্পনা। ভাস্করবাবু বা বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা অবশ্য তা মানতে নারাজ।
বাম প্রার্থী সপ্তর্ষি আবার এলাকার আবাসিকদের সমস্যা নিয়ে সরব হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক নানা লড়াইয়ে অংশ নিয়ে নিজের ভিত তৈরি করেছেন। তিনি নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি। উপরন্তু তাঁর বাবা প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব। তাই সপ্তর্ষিও জোর লড়াই দেবেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তবে প্রার্থীরা সকলেই বলছেন, ব্যক্তির লড়াই নয়, এ বার নীতির লড়াই।
এলাকাবাসীর বক্তব্য, সব কিছুর মধ্যে মেরুকরণের রাজনীতি হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে। ভাস্করবাবুর কথায়, ‘‘তৃণমূল ও বামেদের বিভাজনের নীতি সকলেই দেখেছেন। বিভাজন নয়, সকলের বিকাশই আমাদের লক্ষ্য।’’ যদিও তাপসবাবু বলছেন, ‘‘বিভাজনের রাজনীতি কোনও দিন করিনি। এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়, বিজেপি আমদানি করছে। এ প্রসঙ্গে বামেদের ভূমিকাও মানতে পারছি না।’’ সপ্তর্ষির কথায়, ‘‘বিভাজনই বিজেপি, তৃণমূলের রাজনীতির বড় অংশ। আমাদের লক্ষ্য, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে উন্নয়নের দিশা তৈরি করা।’’
মেরুকরণের সঙ্গে সিন্ডিকেট পাড়াও আলোচনায় উঠে আসছে। যদিও সিন্ডিকেট পাড়া এখন কার্যত নিশ্চুপ। সিন্ডিকেট চাঁইদের বক্তব্য, এখন হাতে কাজ নেই। ভোট নিয়েও তাঁরা ভাবিত নন। যদিও সব রাজনৈতিক দলই বলছে, নিয়ম মেনে কেউ ব্যবসা করলে আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবসার নামে গুন্ডামি বরদাস্ত করা হবে না।
আশঙ্কা আরও রয়েছে। বিশেষত, অন্তর্দ্বন্দ্বের গোপন কাঁটা। যদিও তৃণমূল প্রার্থী তাপসবাবু বললেন, ‘‘এ সব
মিথ্যা প্রচার। ঐক্যবদ্ধ ভাবেই কাজ করা হচ্ছে। জয় অনিবার্য, ব্যবধান বাড়ানোই লক্ষ্য।’’ বামেদের আবার আশা সংগঠনের পুনরুজ্জীবনের। সেই নিরিখে পুরনো ভোট ফেরার অপেক্ষায় তারা। সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ভোটেও রয়েছে নজর। বাম প্রার্থী সপ্তর্ষি তাঁর প্রচারে বলছেন, ‘‘আদর্শ আর নীতিই আমাদের সম্বল। আমরা দল বদল করি না। সংগঠনের জোর কতটা, আগামী দিনে প্রমাণ হবে।’’ দ্বন্দ্বের গোপন কাঁটা নিয়ে জল্পনা রয়েছে বিজেপি-র অন্দরমহলেও। তবে সে জল্পনা উড়িয়ে বিজেপি নেতা অনুপম ঘোষের দাবি, জয় সম্পর্কে নিশ্চিত তাঁরা। প্রার্থী ভাস্করবাবুর কথায়, ‘‘শুধু সময়ের অপেক্ষা। এলাকাবাসী ক্রমশ সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি ঘটাচ্ছেন।’’
এ সব শুনে বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘সবই বুঝছি, যা ভাবার তা ভাবছি। শুধু একটাই অনুরোধ, যে দলই জয়ী হোন না কেন, দয়া করে দল বদল করবেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy