প্রতীকী ছবি।
স্বয়ং কেশব চন্দ্র নাগও ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে যাবেন। এ অঙ্ক মেলানো বড় কঠিন যে!
বোরো ধানের শিসের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় শালবনিতে গেরুয়া পতাকার আন্দোলন দেখে যদি সকালে মনে হয়, নাহ! পশ্চিম মেদিনীপুরে এ বার বুঝি ঘাসফুলের ধস নামতে চলেছে, তবে দুপুরে মাথা চুলকোতে হবে। কারণ, তত ক্ষণে গড়বেতায় বুক ঠুকে পথে নেমে পড়েছেন বহু বিতর্কে জড়িত সিপিএম নেতা তপন ঘোষ। তাঁর পিছনে মানুষের মিছিল। সন্ধ্যায় খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকায় মাঝবয়সি মহিলা শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে বলছেন — ভোট তো দিদিকেই দেব।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ, ভুমিপুত্র মানস ভুঁইয়াকে গো হারান হারিয়ে দেন। ঘাটাল থেকে তৃণমূলের নায়ক প্রার্থী দেব-কে সে বার বাঁচিয়ে দিয়েছিল কেশপুরের লিড। সাধারণ অঙ্কের নিয়মে কেশপুর ও জেলার হাতে গোনা আর কয়েকটি কেন্দ্র ছাড়া প্রায় সব ক’টিতেই বিজেপি এগিয়ে। বলা হয়, সে বার জেলার সিপিএমের ভোটের একটা বড় অংশ হাওয়ায় ভেসে ভেসে বিজেপি-র ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায় শান্ত স্বরে বলেন, ‘‘গত দু’বছরে সেই ভোট অনেকটাই আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। তা ছাড়া মানুষ তৃণমূলের উপরে বীতশ্রদ্ধ। বিজেপি-কে বিশ্বাস করে না। ফলে, এ বারে আমাদের ফল ভাল হবে।’’ শালবনিতে এ বার তাঁদের প্রার্থী রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। কেউ কেউ তপন-সুশান্তের জেতার অঙ্কও শুরু করে দিয়েছেন।
নিন্দুকেরা বলছেন, বিজেপি-র সেই ভোট কাটতে পারে বলে সিপিএম প্রার্থীদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে নাকি চওড়া হাসি ফুটে উঠছে তৃণমূল নেতাদের চোখে-মুখে। এও যেমন এক অঙ্ক, তেমনই জেলার এক পোড় খাওয়া আইনজীবীর মতে, ‘‘আরে! সিপিএম যে ভোট টানবে তার মধ্যে তো সংখ্যালঘু ভোটও থাকবে। সেই ভোট তো যাবে তৃণমূলের ঘর থেকে। ফলে, খাল কেটে কুমীর ডাকা হয়ে যাচ্ছে না তো?’’
মেদিনীপুর, খড়্গপুর গ্রামীণ, শালবনি, গড়বেতা, কেশিয়াড়ি, দাঁতন — এই ছ’টি কেন্দ্রের ভোট ২৭ মার্চ। স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার, রেশনে চাল, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সাইকেল, ট্যাব — সরকারি প্রকল্পের সরাসরি সুবিধায় খুশি এই সব এলাকার হাজার হাজার মানুষ। তবে শুধু তাঁদের ভোট নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না তৃণমূলের নেতারা। জেলার দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা, খড়্গপুর গ্রামীনের প্রার্থী দীনেন রায়। এলাকার অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে মাটিতে বসে করা বৈঠক সেরে, ‘‘বিজেপি নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, তা অনেকটা কমে গিয়েছে’’- বললেও তাঁর মুখ-চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
কারণ, সরকারি সুবিধা পাওয়া, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজেদের ঘরের লোক মনে করা মানুষগুলো স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের উপরে ‘খুশি’ নন। কান পাতলে স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতি, দুর্ব্যবহারের হাজার ফিরিস্তি শোনা যায়। সাধারণ ছা-পোষা গৃহবধূর মুখ থেকে ছিটকে বেরোয়, ‘‘একশো দিনের কাজ করে হকের টাকা চাইতে গেলে ধমক খেতে হয়।’’ তাঁর কাছ থেকে সরে যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দেন — ‘‘দেখবেন, নামটাম আবার লিখে দেবেন না।’’ গত দু’দশক ধরে জেলা যে ‘আতঙ্ক’-র বদনামের ভাগী, তার বোধকরি আজও মেটেনি।
কেশিয়াড়িতে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের কথায়, ‘‘আপনারা আজ দেখছেন দিদি-র বাঁ পা ভেঙেছে।
একটু তলিয়ে দেখুন। গত দশ বছর ধরে স্থানীয় নেতারা তো দিদির দু’টো পা-ই ভেঙে রেখে দিয়েছে। দিদিকে পছন্দ করা মানুষগুলোই তো বলছে, তাঁকে ভোটে জেতালে তো এই মানুষগুলো ফিরে আসবে।’’ স্নাতকোত্তর পাস করে, শিক্ষকতার চাকরির আশায় চার বছর ধরে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা দাঁতনের যুবকের গলা থেকে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, ‘‘কেন আমরা বঞ্চিত হব, বলতে পারেন!’’ আবার শালবনির অন্য এক যুবক ঝাঁঝিয়ে ওঠেন — ‘‘২০১৮ সালে কয়েকটা পঞ্চায়েত জিতে, ২০১৯ সালে লোকসভা জিতে, এরা তো ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছে। এখনই গেরুয়া শিবিরের যা দাপাদাপি দেখছি। হাতে মাথা কাটতে শুরু করেছে। এ বার যদি কোনও কারণে ভোটে জিতে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে, তা হলে না জানি, কী করবে!’’
ফলে, অঙ্ক মেলানো কঠিন। যে যার নিজের মতো জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। সবাই বুক বাজিয়ে বলছেন, তিনিই জিতবেন। তলায় তলায় অঙ্ক কষছেন তাঁরাও। মেদিনীপুর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী শমিত দাস এক সময়ে জেলার সভাপতি ছিলেন। এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার ফাঁকে বললেন, ‘‘আমাদের সংগঠন বেড়েছে। সর্বত্র বুথ কমিটি তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ এদের নিয়ে বীতশ্রদ্ধ।’’ কিন্তু, পেট্রল-ডিজেল বা রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি? শমিতের মুচকি হাসি, ‘‘গ্রাম-গঞ্জের লোক এ সব নিয়ে বেশি প্রশ্ন করেন না।’’
তাঁর বিপক্ষে জুন মালিয়া। অভিনেত্রীকে ঘিরে রাখছেন সেই স্থানীয় নেতারাই। শহর, শহরের উপান্তে ঘুরে ঘুরে সভা, রোড-শো করছেন জুন। বলছেন, ‘‘দিদি আমাকে পাঠিয়েছে। আমি তো আপনাদেরই লোক।’’ মঞ্চ থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন প্রশ্ন, ‘‘খেলা হবে?’’ শহরের বড়তলা চকে এমনই এক জনসভায় অভিনেত্রীর এই প্রশ্ন শুনে দূরে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এক যুবকের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘জিতলে কি দেখা হবে?’’
কারণ, জুন-কে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর এক অভিনেত্রীর ইমেজ। শহরবাসীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, আগে এক অভিনেত্রী এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জিতে লোকসভায় গেলেও তাঁকে হাতের কাছে পাওয়া যায়নি।
ফলে, অঙ্ক বেশ কঠিন! কার যে হিসেব মেলে, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy