ফাইল চিত্র।
কিসের ভোট? কেন ভোট? কাদের জন্য ভোট? বৃহস্পতিবার শেষ দফার ভোটদান পর্বে পাড়ার বুথে করোনা-বিধি না মানার যে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখলাম, তার পর এই প্রশ্নগুলোই মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল দিনভর। মনে হল, এ বার ভিড় করে ভোট দেওয়া মানে অন্যায় করা। যে মৃত্যুমিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, তা আরও বাড়ার সুযোগ করে দেওয়া। বুথের পথে যেতে পা কাঁপল। বুথে ঢুকে বোতাম টিপতে গেলে হয়তো হাতও কাঁপত। এই অন্যায় করব না বলেই এ বার ভোট দিলাম না। যাঁরা করোনাবিধি মানেন না, ৫৫ বছর বয়সে এসে তাঁদের বিরুদ্ধে এটাই প্রতিবাদ।
আমার বাড়ি উত্তর কলকাতার রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটে। বাড়িতে সদস্য বলতে সাত জন। দুই দাদার পরিবারের ছ’জন আর আমি। বিয়ে করিনি। স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ করেই এত বছর কেটে গিয়েছে। শিক্ষা, চাকরি, নিরাপত্তা, খাদ্য, বাসস্থানের ইসুতে প্রতি বারই বেলেঘাটা কেন্দ্রে ভোট দিয়েছি। এ বারের ভোট ছিল অন্য রকম। বাংলা কার দখলে থাকবে, তার চেয়েও এখন বড় প্রশ্ন, বাংলা বাঁচবে কি না। বাংলার মানুষ জরুরি সময়ে হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন আর অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা পাবেন কি না। কিন্তু এই সাধারণ নাগরিক হিসেবে যেটা আমি বুঝেছি, সেটা কি এ দেশের গণ্যমান্য নেতারা বোঝেন না? দিল্লি মৃত্যুপুরী হয়ে যাচ্ছে দেখেও যাঁরা এ দিন ভোটের লাইনে বেপরোয়া ভিড় জমালেন, তাঁরাও কি বোঝেন না?
এ দিন বেলার দিকে আমাদের বুথ শ্রী বিদ্যামন্দির স্কুলের কাছে গিয়েছিলাম। ভিড় দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। গড়পাড়ের এই এলাকার বেশির ভাগই বস্তি। দেখি, সেখান থেকে যাঁরা ভোট দিতে আসছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই মাস্ক পরা নেই। ভোটের লাইনে দূরত্ব-বিধি কী বস্তু, তা তাঁরা হয়তো জানেনই না। সব থেকে অবাক হলাম, ভোট যাঁরা করাচ্ছেন, তাঁদের সচেতনা বোধের অভাব দেখে। শুধু কলকাতা পুলিশের কয়েক জন সদস্য চড়া রোদে দাঁড়িয়ে ভিড় সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তা সত্ত্বেও বুথে ঢোকার মুখে কোনও রকম স্যানিটাইজ়ার দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। থার্মাল গান দিয়ে ভোটারদের দেহের তাপমাত্রা দেখারও ব্যাপার নেই। এক জন ভোট দিতে ঢুকলে তাঁর গায়ের উপর দিয়েই লোক ঢুকে যাচ্ছেন। আরও অবাক হলাম, এই করোনাকালেও দলগুলি নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করছে দেখে। স্বাভাবিক সময়ের মতোই দেখলাম, এজেন্ট বসতে না দেওয়ার চোখরাঙানি, বাইরে বেরোলেই দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি। লজ্জা হল। আরও লজ্জা হল ভোটে দাঁড়ানো নেতাদের দেখে। না তাঁদের মুখে মাস্ক আছে, না কোনও ভোটারকে তাঁরা সচেতন করছেন! ভোট মিটলেই এর পরে দেখা যাবে, এই নেতারাই করোনায় মৃতের বাড়িতে গিয়ে জনসংযোগ করছেন! দেখলাম, কেন্দ্র থেকে বেরিয়েই তাঁরা মাস্কহীন মুখে মানুষকে ভোটের স্বার্থকতা বোঝাচ্ছেন!
ভোট-বুথের সামনে আরও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে মনে হল, সারা কলকাতা যে একটা মহামারির সঙ্গে লড়াই করছে সেটা নিয়ে কারও হুঁশই নেই। পশ্চিমবঙ্গে যে করোনা আছে সেটা মনেই হচ্ছে না। ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর চেয়ে কারও জন্য অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড়ের চেষ্টা করা ভাল। এই ভোট নিয়েই আবার প্রচার হয়, এটা নাকি গণতান্ত্রিক উৎসব। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি চলছে, সেখানে কী করে উৎসব পালিত হয়? জোর করে যাঁরা আট দফার ভোট উৎসব করালেন, তাঁরা মৃত্যু মিছিলের দায়িত্ব নেবেন?
বাড়ি ফিরে শুনি, আমার বড়দার পরিবারও বুথমুখো হবে না ঠিক করে নিয়েছে। গত বছর করোনার সময়ে আমার এই দাদার মৃত্যু হয়। তখন কত হয়রানি আমাদের সহ্য করতে হয়েছে তা আমরাই জানি। ইউরিনের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লোকটা কী কারণে মারা গেলেন, জানাই যায়নি। হাসপাতাল করোনার পরীক্ষাও করেনি। আমরা মামলা করেছি। তা এখন স্বাস্থ্য কমিশনে বিচারাধীন। বড়দার ছেলে আমায় বলল, “করোনা হোক, আর যে কারণেই হোক, মৃত্যুর পথ প্রশস্ত হতে পারে এমন কিছুই মানুষের উৎসব হতে পারে না। মানুষ হিসেবে তাই ভোট উৎসব বয়কট করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy