দিনভর প্রচারের ফাঁকে আলাপচারিতা। ক্যারাভ্যানে দিলীপ ঘোষ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রী হলে আপনার অগ্রাধিকার কী হবে?
দিলীপ: ইস্তাহারে সব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি। প্রথম আইন-শৃঙ্খলা। এক সপ্তাহের মধ্যে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। জঙ্গলরাজ থেকে সুরাজ। তার উপর দাঁড়িয়ে বাকি কাজ শুরু হবে। যেটা উত্তরপ্রদেশে আমরা করেছি।
প্রশ্ন: আরএসএস থেকে এসেছেন বলেই কি মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য দলের কাছে আপনি বেশি আস্থাভাজন?
দিলীপ: সেটা দল জানে। আমি ভাবছি না। আমি পরিবর্তনের কথা ভাবছি। হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ কর্মী আমার মতো জীবন যাপন করেন। তবে তা ছাড়াও কিছু বিশেষ বিষয় আছে, যা রাজনীতিতে লাগে। আমার মনে হয়, সেটা আমার মধ্যে কেউ কেউ দেখেন।
প্রশ্ন: তা হলে মুখ হতে পেরেছেন?
দিলীপ: আমি তো মুখ সব সময় ছিলাম। আছি। কিন্তু এখন আরও অনেক মুখ আমাদের আছে।
প্রশ্ন: আপনার প্রতি এই বাড়তি আকর্ষণের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
দিলীপ: আমি তো কারও কাছ থেকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ নিইনি। আমি নির্দেশ পেয়ে সামাজিক কাজ থেকে রাজনীতির কাজে চলে এসেছি। অনেকের পছন্দ হয়নি। বলেছেন, এ কিছুই বোঝে না, অরাজনৈতিক লোক। বিরোধিতা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও এ নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটা করেছি। বাকিরা আজ হয়তো তা স্বীকার করেছেন। আমি একটা নতুন ‘স্টাইল’ শুরু করেছি, পরম্পরাগত রাজনীতির বাইরে। হয়তো তাতে লোকে বিশ্বাস করছেন। কর্মীরাও অনুকরণ করেছেন। হয়তো তাতে সাফল্য এসেছে। বিশ্বাসও বেড়েছে।
প্রশ্ন: আপনি যা যা বলেন, তা নিয়ে বহু সময় বিতর্ক হয়েছে। যেমন— মারব, হাত ভেঙে দেব, স্ট্রেচারে বাড়ি যাবে ইত্যাদি। এগুলো কি আপনি বিশ্বাস থেকে বলেন নাকি শুধু ভোট পাওয়ার জন্য?
দিলীপ: এটা মানুষ বিশ্বাস করেন বলে আমি বলি। সাধারণ মানুষ যা চান, সেটা কেউ বলে না। বলার সাহস বা নৈতিকতা থাকে না। আমার আছে, আমি বলেছি। বেশিরভাগই আমি বিশ্বাস করি বলে বলেছি। তবে এখন আর বলার দরকার নেই, মানুষ প্রতিরোধ করেছেন। যখন আমার দলের লোকেরা মার খাচ্ছিলেন, পুলিশের সহযোগিতা নেই, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারাও তখন এ নিয়ে কিছু করেননি। আমাকে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, এই ভাবে কর্মীদের মনোবল বাড়াবার দরকার আছে।
প্রশ্ন: বিজেপি দল হিসেবে সঙ্ঘ-অনুশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অথচ অল্প দিন আগেও তৃণমূলে থাকা যাঁদের আপনারা খারাপ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বলতেন, তাঁদের জন্য আজ আপনাদের অবারিত দ্বার। তাঁদের দলে নিলেন। টিকিটও দিলেন। তার মানে কি আপনারা পুরনো কর্মীদের নিয়ে দল বাড়াতে পারেননি?
দিলীপ: রাজনীতিতে সংখ্যার একটা গুরুত্ব আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গেলে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন পেতে হয়। ভোটে জিততে হলে, একটা সংখ্যক ভোটার চাই। আমাদের মনে হয়েছে, সেটা এখনও যথেষ্ট নয়। তাই আমরা বাইরের লোককে নিচ্ছি। আর রাজনীতিতে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আমার বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ এবং মামলা হয়েছে। সব সত্যি এমন নয়।
প্রশ্ন: তা হলে কি আপনি মনে করেন, যাঁদের বিজেপি দুর্নীতিগ্রস্ত বলত, তাঁদের দেখেও মানুষ আপনাদের ভোট দেবেন?
দিলীপ: যাঁরা আসছেন, তাঁরা বিজেপি নন। তাঁদের দেখে মানুষ ভোট দেননি বা দেবেন না। আমাকে দেখে বা আমার পুরনো কর্মীকে দেখে, নরেন্দ্র মোদীকে, অমিত শাহকে দেখে ভোট দেবেন। কিন্তু রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় অনেক লোককে নিতে হয়, আমরা নিয়েছি। বিজেপি সাময়িক ভাবে একটা নীতি নিয়েছে— আগে সবাইকে নাও, জেতো, ক্ষমতায় এস, তার পর সকলকে পরিশুদ্ধ কর। বিভিন্ন রাজ্যে আমরা এটা করেছি, এখানেও করব।
প্রশ্ন: সঙ্ঘ কি এ ব্যাপারে সহমত?
দিলীপ: সঙ্ঘ জানে, রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবতা আছে। সেখানে মাটিতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, হার-জিতের জবাব দিতে হয়। আফটার অল রেজাল্টই শেষ কথা।
প্রশ্ন: প্রার্থী তালিকা নিয়ে এত বিক্ষোভ, ভাঙচুর। এই শৃঙ্খলাহীনতা নিয়ে কী বলবেন?
দিলীপ: কিছু লোক থাকেন, যাঁরা সব ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হন। যাঁরা টিকিট পাবেন ভেবেছিলেন, তাঁদের অনেকে পাননি। আবার অন্য জায়গা থেকে এই বিক্ষোভে ইন্ধনও আছে। টাকাপয়সাও দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের মানসিকতা হল, কেউ সহজে পরিবর্তনটা মেনে নিতে চান না। কিন্তু পরিবর্তনটাই নিয়ম। যাঁরা মানতে পারবেন না, দল হয়তো তাঁদের বাদ দিয়ে এগোবে।
প্রশ্ন: এত জন সাংসদকে টিকিট দিতে হল কেন?
দিলীপ: আমাদের কাছে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ প্রার্থী কম আছেন। জিতে সরকার গড়তে গেলে মানুষের বিশ্বাস দরকার। লোক প্রশ্ন করবে, আপনাদের মন্ত্রী কে? সরকার কারা চালাবে? সর্বোপরি একটা গুরুত্ব বোঝাতে যে, আমরা সরকার গড়ার ব্যাপারে সিরিয়াস। আগে অন্য দলও এমন করেছে।
প্রশ্ন: ধরা যাক, আপনারা বিরোধী হয়েই থেকে গেলেন। সে ক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পনা কী হবে?
দিলীপ: আমরা তো লড়ছিই, লড়াই চলতে থাকবে। তবে এ বার জেতার পরিবেশ তৈরি করেছি। প্রশ্নের জায়গা নেই। আমরাই জিতছি।
প্রশ্ন: বিজেপি-র সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ী সম্পর্কে বিরোধীদেরও শ্রদ্ধা ছিল। জনসঙ্ঘের নেতা হরিপদ ভারতীর বক্তৃতা বিরোধী দলের লোকেরাও মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। বিজেপি নেতা হিসাবে বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর বক্তৃতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটত। কিন্তু তাঁদের কারও বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ওঠেনি। এখনকার বিজেপির বিরুদ্ধে ওঠে। কী বলবেন?
দিলীপ: বিরোধীরা ওই নেতাদের থ্রেট বলে মনে করেননি। ভাল মানুষ, ভাল বক্তৃতা করেছেন, ব্যস। দল কী পেয়েছে? দল যদি জিততে না পারে, ভাল আদর্শ, ভাল মানুষ, ভাল বক্তৃতা ধুয়ে কি জল খাব? যিনি দলকে জেতাবেন, যেমন, অমিত শাহ আমার এক নম্বর নেতা, নরেন্দ্র মোদী আমার এক নম্বর নেতা। এঁরাই দলকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। একাধিক রাজ্যে দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। এখন যেমন বাংলা জেতা ‘মিশন’। রাজনীতি করলাম কীসের জন্য? শখের রাজনীতি বলে কিছু হয় না।
প্রশ্ন: কিন্তু লোকে যে আপনাদের দিকে আঙুল তুলে সাম্প্রদায়িক বলে, এতে মানসিক অস্বস্তি হয় না?
দিলীপ: আমরা জানি এ সব মিথ্যা। মানুষও জানেন। তাই আমরা ২.৩ কোটি ভোট পেয়েছি। কিছু তো একটা বিরোধীদের বলতে হবে! বলবেটা কী?
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মেরুকরণের রাজনীতির অভিযোগ তোলেন। কিন্তু সংখ্যালঘু তোষণ যদি অন্যায় হয়, তা হলে সংখ্যাগুরু বা হিন্দু তোষণও কি একই রকম অন্যায় বা অসাংবিধানিক নয়?
দিলীপ: আমরা কাউকে তোষণ করি না। যিনি এত দিন ধরে মুসলিমদের তোষণ করেছেন, তিনি এখন তাঁদের শোষণ করছেন। মোদীজি বলেছেন, সব কা সাথ, সব কা বিকাশ। দলের ভিতর থেকে সরকারের উপর পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি সেই নীতিতে চলছি। আমাদের নীতি-আদর্শ আছে। কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না।
প্রশ্ন: আপনারা তো হিন্দুত্ববাদী দল। আপনারা ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী দাঁড়াবে?
দিলীপ: কেউ হিন্দুত্ববাদী বলতে পারে, কেউ রাষ্ট্রবাদী বলতে পারে। আমরা, আমরা। আমরা ভারতীয় জনতা পার্টি। আমাদের নীতি-আদর্শ আছে। দেশের সংবিধান আছে।
প্রশ্ন: একটা ভয়ের কথা বলা হয়, আপনারা ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেবেন। আপনার বক্তব্য?
দিলীপ: পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার সবচেয়ে বড় শিকার সংখ্যালঘু মুসলিমরা। তার জন্য তো বিজেপি দায়ী নয়। বিজেপি ক্ষমতায় এলে এই অবস্থা বদলাবে। মুসলিমরাও সেটা বুঝতে পারছেন।
প্রশ্ন: দেখা যাচ্ছে, এই নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যেন কেন্দ্রীয় শাসন জারি হয়েছে। পুরো দল দখল করেছেন দিল্লির নেতারা। আপনাদের উপরে কি তাঁদের আস্থা নেই?
দিলীপ: আমাদের অভিজ্ঞতা নেই কী ভাবে জিততে হয়। কেন্দ্রের নেতারা বিভিন্ন রাজ্যে জিতেছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের গাইড করবেন, এটা আমাদের কাছে গর্বের।
প্রশ্ন: তপন সিকদার, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়রা যখন রাজ্য সভাপতি ছিলেন, তখনকার এবং এখনকার রাজ্য বিজেপির মধ্যে কী ভাবে তুলনা করবেন?
দিলীপ: তাঁরা আমাদের ভিত। কিন্তু রাজনৈতিক সাফল্য পেতে হলে যে লড়াই করা উচিত, তা হয়তো তাঁরা করেননি। তাই মানুষ গ্রহণ করেননি।
প্রশ্ন: আপনি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কি আর কোনও নেতা তৈরি করতে পেরেছে?
দিলীপ: নেতা তৈরি হয়েছে কি না, ক্ষমতায় এলে বোঝা যাবে। মানুষ যখন বনে যায়, বনমানুষ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: এত ব্যস্ত রুটিন। কলকাতায় খুব কম সময় থাকেন। সকালে এক জায়গায়, বিকেলে আর এক জায়গায়। এখন সঙ্গে সর্বত্র প্রচার। এই চাপ সামলাচ্ছেন কী করে?
দিলীপ: খড়্গপুরে যখন থাকি, যে ভাবে থাকি, সে ভাবেই আছি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারি। কেউ ভাববেন না, আমি বিজেপির রাজ্য সভাপতি বলে দূরত্ব বজায় রাখি। এটা নতুন কিছু নয়। আমাকে হেলিকপ্টার দেওয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে ঘুরি। গাড়ি নিয়েও একটার পর একটা বিধানসভায় প্রচার করছি। আমি জানি, রাজনীতি মাটিতে দাঁড়িয়ে করতে হয়। আমার দলের লোকেরা করেননি বলে বোধহয় ফল পাননি।
প্রশ্ন: আপনি যে সব রকম সুবিধে-যুক্ত বিশেষ বাস ব্যবহার করছেন, তা কি কেন্দ্রীয় কমিটি দিয়েছে?
দিলীপ: না, নিজে ভেবে বানিয়ে নিয়েছি। এক কর্মী বানিয়ে দিয়েছেন। তিন মাস ধরে গুড়গাঁও গিয়েছি। এ রকম অনেক গাড়ি দেখে যে মডেলটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটা দু’মাস ধরে বানানো হয়েছে। একটা ছোট বাসে লিফট, টিভি, বাইরে স্ক্রিন আছে। অডিয়ো, ভিডিয়ো চলবে। ছোট শৌচালয়, খাবার গরম করার ব্যবস্থা আছে। সোফা, বিছানা, ইন্টারভিউ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই গাড়ি বাংলার রাজনীতিকে আমার উপহার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy